আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনকে রাষ্ট্রীয় এজেন্ডা হতে দেওয়া যাবে না
Published: 6th, April 2025 GMT
প্রথম আলো:
কয়েক মাস ধরেই সংস্কার নিয়ে অনেক কথাবার্তা শোনা গেছে। সংস্কার নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
হোসেন জিল্লুর রহমান: সংস্কার বর্তমান সময়ে খুব চালু একটি শব্দ, কিন্তু সংস্কার বিষয়টি আসলে কী? প্রথম থেকেই একটি ধারণা তৈরি হয়েছে, যাতে মনে হতে পারে সংস্কার মানে হচ্ছে সবকিছু ওলট-পালট করে ফেলা এবং বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসা। আমাদের দেখা দরকার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাগুলো আসলে কোথায়। আমি মনে করি, তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রয়োজনীয়তাগুলো দেখা জরুরি।
প্রথমত, আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ানো। আমাদের বিস্তৃত রাষ্ট্রযন্ত্র রয়েছে, কিন্তু সেখানে কাঙ্ক্ষিত সেবা ও তা ডায়নামিকভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। কাগুজে নীতির আধিক্য রয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নের অক্ষমতার বৃত্তে আটকে থাকার বাস্তবতা রয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ বলেন, শিক্ষা বিভাগ বলেন, ওয়ান-স্টপ সার্ভিসের কথা বলেন বা অন্য বহু বিভাগের কথা বলেন, সংস্কারের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা ও সেবার মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন আনা।
এখানে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে গেড়ে বসা প্রশাসনিক সংস্কৃতির, যেখানে মেধা, দক্ষতা ও সেবাধর্মী মানসিকতার পরিবর্তে বিভিন্ন গোষ্ঠীচিন্তা ও দাপটের রাজত্ব লক্ষণীয়। প্রশাসন ক্যাডারের আলোচিত বিষয়টি এখানে উল্লেখ্য, যেমন উল্লেখ্য স্থানীয় সরকারগুলোকে ক্ষমতাহীন করে রাখার মানসিকতা। এখানে আরও উল্লেখ্য বিভিন্ন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন দলীয় পেশাজীবীর বিভাগীয় কর্মকাণ্ডে অযৌক্তিক দাপট।
দ্বিতীয়ত, যে ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি, তা হলো ক্ষমতাকাঠামো ও ক্ষমতাবিন্যাসের সংস্কার। স্বৈরাচারী প্রবণতাগুলো রোধে সুনির্দিষ্ট কাঠামোগত ও প্রায়োগিক জায়গাগুলো চিহ্নিত করা এই কাজের একটি অংশ। অন্য অংশটি হচ্ছে কার্যকর পরিবর্তনের সুপারিশ নিয়ে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে ঐকমত্য তৈরি করা, গত ১৫ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলের অন্যতম স্তম্ভগুলো ছিল প্রধানমন্ত্রী পদের অতি ক্ষমতায়ন, এলাকায় ‘এমপিরাজ’ প্রতিষ্ঠা, পুলিশ প্রশাসন ও বিচার প্রশাসনের চূড়ান্ত ও নিষ্ঠুর অপব্যবহার। ন্যূনতম এই তিন জায়গায় ক্ষমতাকাঠামোর সংস্কার ছাড়া অর্থবহ সংস্কার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ানো ও স্বৈরাচারী প্রবণতা রোধে ক্ষমতাকাঠামোর সংস্কারের বাইরে তৃতীয় একটি দৃষ্টিকোণ থেকেও সংস্কারের আলোচনা প্রাসঙ্গিক। সেটি হচ্ছে একটি উন্নত সমাজ তৈরির জন্য কিছু সংস্কার। একটা সময়ে আমরা একটি দারিদ্র্যক্লিষ্ট দেশ ছিলাম। এখন আমাদের একধরনের আর্থিক সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, সমাজে নানা ধরনের গতিময়তার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বাসযোগ্য শহর, উন্নত মানের কানেকটিভিটি, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ—আমাদের চাহিদার পরিধি সম্প্রসারিত করার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নতুন চিন্তা, নতুন উদ্ভাবনের প্রয়োজন হবে, সেটাও সংস্কারের অংশ।
এই তিন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সংস্কারের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হবে। সংস্কারের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। আমরা কেন সংস্কার চাইছি? শেষ বিচারে সেটা তো এ রকম যে মানুষের জীবন যেন আরেকটু সুস্থির হয়, আরেকটু উন্নত হয়। তাঁরা যেন মনে করেন যে তাঁরাও এই দেশের একজন অংশীদার। এই দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে তাঁদেরও ভূমিকা রাখার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সংস্কার নিয়ে এখন যে আলোচনাগুলো হচ্ছে, আমি তার মধ্যে একটি একমাত্রিক প্রবণতা লক্ষ করছি।
প্রথম আলো:আরেকটি বহুল আলোচিত বিষয় হলো ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’। এ বিষয়ে আমাদের অগ্রগতি কত দূর?
হোসেন জিল্লুর রহমান: ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ শব্দটা হয়তো তাত্ত্বিক কর্মকাণ্ড বা একাডেমিক জগৎ থেকে আমাদের এখানে এসেছে। কিন্তু আমি এখন একটু চিন্তিত, একটু উদ্বিগ্ন এই কারণে যে সংস্কারের মতো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আলোচনায়ও সাধারণ মানুষ মানে জনগণের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় একধরনের ‘এলিটিস্ট অ্যাপ্রোচ’ লক্ষ করা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এগুলো ‘ওপর মহল’-এর একটা আলোচনা। যে নতুন দল গঠিত হয়েছে, তাদের বক্তব্যে সংস্কার, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত—এসব শব্দ বেশি বেশি করে শোনা গেলেও তাদের ক্ষেত্রেও একই ‘এলিটিস্ট অ্যাপ্রোচ’ই দেখা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বন্দোবস্ত শুধু রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের বিষয় নয়, এতে জনগণেরও অংশীদারত্ব থাকতে হয়। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঠে যারা আছে, অর্থনীতির মাঠে যারা আছে, শুধু তারা মিলেই বন্দোবস্ত তৈরি করবে—এটা একটা এলিটিস্ট ধারণা। এভাবে বন্দোবস্ত তৈরি হলে তাতে জনগণের চেয়ে এলিটদের স্বার্থই প্রাধান্য পাবে।
সবাই দাবি করছে, জনগণের পক্ষে তারাই দায়িত্বপ্রাপ্ত, ক্ষমতাপ্রাপ্ত, নৈতিকভাবে তারাই দাবিদার। কিন্তু সত্যিকার অর্থে জনগণ কোথায়? এসব আলোচনায় জনগণের ভয়েসটা কোথায়? রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক পরিসরে আমি গত সাত মাসে সবচেয়ে বড় অনুপস্থিত ‘ফ্যাক্টর’ যেটা দেখছি, তা হলো জনগণ।
প্রথম আলো:জনগণকে যুক্ত করার প্রক্রিয়াটা কেমন হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান: সরকারের কথা যদি বলি, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা নিজেদের মূলত দাপ্তরিক কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। জনসম্পৃক্ততার কাজে তাঁরা পুরোপুরি অনুপস্থিত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই তাঁদের একটা প্রধান কাজ বলে আমি মনে করি।
রাজনীতিবিদেরা কীভাবে জনসম্পৃক্ত হবেন, সেই প্রক্রিয়া তাঁদেরকেই উদ্ভাবন করতে হবে। তাঁদের যদি সে রকম উদ্দেশ্য থাকে, আমরা তা বুঝতে পারব। তাঁরা কি চেষ্টা করছেন কৃষকের সঙ্গে বসে কৃষির সমস্যা বোঝার, শ্রমিকদের সঙ্গে বসে তাঁদের কথাগুলো শোনার? এই যে বিভিন্ন ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বিনিয়োগের জায়গাগুলো কেন স্থবির হয়ে আছে, উদ্যোক্তাদের সঙ্গে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কি এগুলোর সমাধানের বিষয়ে কোনো আলোচনা করা হচ্ছে?
কিছু আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়তো হচ্ছে। কিন্তু এগুলো খুবই একতরফা। এখানে অল্প কিছু লোক বলেন, অন্যরা ‘অডিয়েন্স’ (দর্শক বা শ্রোতা) হিসেবে উপস্থিত থাকেন। এ ধরনের আলোচনায় জনসম্পৃক্ততা বা জনগণের সঙ্গে সংযোগ তৈরি হয় না।
ড.হোসেন জিল্লুর রহমান
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হ স ন জ ল ল র রহম ন জনগণ র র আল চ আম দ র প রথম ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কার ইস্যুতে সব দল ঐক্যবদ্ধ থাকলেও বিএনপি অবস্থান পরিবর্তন করে
সংস্কার ইস্যুতে সব দল ঐক্যবদ্ধ থাকলেও বিএনপি হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) সকালে কুমিল্লার সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ অডিটোরিয়ামে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা ভোট কেন্দ্র পরিচালক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ অভিযোগ করেন।
ডা. তাহের বলেন, “আরপিও, সংস্কার কিংবা হ্যাঁ/না গণভোট—কোনোকিছুই এখন বিএনপি মানছে না। সরকার যদি তার নিরপেক্ষতা হারায়, তাহলে দেশের জনগণ তার প্রতি আস্থা হারাবে। তখন জনগণ আন্দোলনে নামবে।”
তিনি আরো বলেন, “জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট নিয়ে সরকার যদি অপকৌশল করে, তাহলে জনগণ আন্দোলনের প্রস্তুতি নেবে।”
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা মাহফুজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম, কুমিল্লা অঞ্চল টিমের সদস্য ও সাবেক জেলা আমির আব্দুস সাত্তার, কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শাহজাহান, কুমিল্লা মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি মুফতি মাহবুবুর রহমান এবং শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মজিবুর রহমান ভূঁইয়া।
উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি বেলাল হোসাইনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন চৌদ্দগ্রাম পৌরসভা জামায়াতের আমির মাওলানা ইব্রাহীম, জামায়াত নেতা আয়ুব আলী ফরায়েজী, শাহ মিজানুর রহমান, উপজেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি আব্দুর রহিম এবং পৌর সেক্রেটারি মোশাররফ হোসেন ওপেল প্রমুখ।
ঢাকা/রুবেল/রফিক