মানিকগঞ্জে শিল্পীর বাড়িতে আগুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৮ জন জেলহাজতে
Published: 17th, April 2025 GMT
পহেলা বৈশাখের মোটিফ তৈরির শিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার আটজনকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুর সন্দেহভাজন হিসেবে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার আটজন হলেন- খান মো. রাফি সৃজন ওরফে রাফু (১৮), মো. আল আমিন খান তমাল (২২), মঈন উদ্দিন আহমেদ পিয়াস (২২), মো. বাবুল হোসেন (৬০), মো.
মানিকগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এসএম আমান উল্লাহ বলেন, পহেলা বৈশাখে মোটিফ তৈরির শিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে। এই মামলায় ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ওসি এসএম আমান উল্লাহ আরও বলেন, জিঞ্জাসাবাদে এখন পর্যন্ত তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি। তাদের সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আজ বিকেলে আদালতে পাঠানো হয়। তবে রিমান্ড শুনানি না হওয়ার কারণে তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার রাতে মধ্যরাতে মানিকগঞ্জের গড়পাড়া গ্রামে শিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় মানবেন্দ্র অন্য একটি ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। অন্যদের চিৎকারে জেগে ওঠেন। স্থানীয় লোকজন আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। আগুনে মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, ধান ভাঙানোর মেশিনসহ শিল্পকর্ম পুড়ে গেছে।
মানবেন্দ্র জানান, দু-তিন দিন ধরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে অপপ্রচার চলছিল। এসব কথাবার্তাকে তিনি হুমকি বলে মনে করছিলেন। এ জন্য মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি মানিকগঞ্জ সদর থানায় জিডি করেন। মধ্যরাতে দুর্বৃত্তরা তার বাড়িতে আগুন দেয়। তিনি অন্য একটি ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। অন্যদের চিৎকারে জেগে ওঠেন। স্থানীয় লোকজন আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। আগুনে মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, ধান ভাঙানোর মেশিনসহ শিল্পকর্ম পুড়ে গেছে।
জেলা ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল হামিদ মিয়া জানান, ভোর ৪টার দিকে তারা ঘটনাস্থলে যান। প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা যায়নি।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমান উল্লাহ জানান, শিল্পী মানবেন্দ্র মামলা করেছেন।
ফেসবুকে অপপ্রচার
ফেসবুকে ‘বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ’, ‘মুজিববাদ’সহ আওয়ামী লীগের নামসংবলিত কয়েকটি পেজে প্রকাশ করা হয়, ‘শেখ হাসিনার বিকৃত মুখাবয়ব তৈরির দায়িত্ব নিয়েছেন মানবেন্দ্র ঘোষ। তার বাড়ি মানিকগঞ্জের গড়পাড়ায়।’ আইনজীবী নিঝুম মজুমদার তার ফেসবুকে এটি শেয়ার করেন।
পরে মানবেন্দ্র ফেসবুকে লেখেন, ‘এবারের পহেলা বৈশাখ উদযাপনে বাঘের মোটিফ ছাড়া অন্য কোনো কাজে আমি নিয়োজিত ছিলাম না।’
পরিদর্শন ও তদন্ত
গতকাল বুধবার দুপুরে শিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়ি পরিদর্শন করেন মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সদস্যরা, জেলা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা।
জেলা প্রশাসক মানোয়ার বলেন, ‘এ ঘটনায় ছয় সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে।’
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য গোলাম আবেদীন কায়সার সমকালকে বলেন, ‘বিএনপি মনে করে, এই অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক রয়েছে। কারণ সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বাড়ির পাশে এই চিত্রশিল্পীর বাড়ি।’
বাড়ি পুনর্নির্মাণ করে দেবে সরকার
চিত্রশিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করে দেবে সরকার। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য জানিয়েছে। পরে রাত পৌনে ৮টায় জানানো হয়, এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
নিন্দা-সমাবেশ
ভাস্কর মানবেন্দ্রর বাড়িতে আগুন দেওয়ায় নিন্দা জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ও বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল।
গতকাল বিকেলে প্রতিবাদী সমাবেশ করেছে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। সমাবেশে সংগঠনের আহ্বায়ক আবদুল কাদের দুটি দাবি জানান। তিনি বলেন, শিল্পী ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা এবং ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাষ্ট্রকে। জড়িতদের বিচার করতে হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম ন কগঞ জ ম ন কগঞ জ র সদস য ফ সব ক ব এনপ ঘটন য়
এছাড়াও পড়ুন:
এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না
অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।
এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।
ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।
তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।
আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।
এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।
আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।
মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।
‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’