আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক এখন কঠিন এক অবস্থায় রয়েছে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এই দুই সংস্থা বৈশ্বিক নিয়মনীতির রক্ষক এবং উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু আজ তারা একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো জাতীয়তাবাদী ও ক্ষমতাধর অংশীদারের মুখোমুখি, অন্যদিকে রয়েছে বাকি বিশ্ব।

তারা যদি সত্য কথা বলে, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনের রোষানলে পড়তে পারে; আর চুপ থাকলে তাদের নিজেদের বৈধতা ও দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এই দ্বিধার বাস্তব উদাহরণ দেখা গেছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক বসন্তকালীন বৈঠকে।

আইএমএফের কাজ হলো দেশগুলোর মুদ্রা বিনিময় হার এবং এমন নীতিগুলো নজরে রাখা, যেগুলো বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলে। যেসব দেশ প্রতিবেশীদের ক্ষতি করে, তাদের দায়ী করাই সংস্থাটির নীতিগত দায়িত্ব।

এখন পর্যন্ত আইএমএফ যুক্তরাষ্ট্রকে প্রকাশ্যে নিয়মভঙ্গকারী বলেনি। তবে আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতিকে ‘অত্যধিক অনিশ্চয়তা’ তৈরি করছে বলে মন্তব্য করেছেন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।

আরও পড়ুনট্রাম্পের দুনিয়া যখন বিভিন্ন ‘দুর্গের এক সমাবেশ’২৭ এপ্রিল ২০২৫

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বঙ্গাও বলেন, বিশ্বব্যাংক তার মূল লক্ষ্য-উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাস নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইউএসএআইডি বন্ধ করে দেওয়ায় বিশ্বব্যাংকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বড় আঘাত এসেছে। কারণ, ইউএসএআইডি ছিল এসব প্রকল্পের প্রধান সহায়ক।

বঙ্গা এ বিষয়ে কিছু না বলে কর্মসংস্থান এবং প্রযুক্তিনিরপেক্ষ জ্বালানি নিয়ে কথা বলেছেন, যা মার্কিন প্রশাসনের জলবায়ুবিরোধী অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কীভাবে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক সম্পর্ক বজায় রাখবে, সেটিই ঠিক করে দেবে তাদের ভবিষ্যৎ কার্যকারিতা। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম ১০০ দিনেই বোঝা গেছে, এদের জন্য সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।

প্রথমত, এই সংস্থাগুলো সরাসরি টার্গেটে পড়তে পারে। ওয়াশিংটনের জন এফ কেনেডি সেন্টারসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বড় এনজিও ও দাতব্য সংস্থাগুলোও তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আরও পড়ুনডলারের সিংহাসন কি কেঁপে উঠছে২৮ এপ্রিল ২০২৫

আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের নামও এসেছে প্রজেক্ট ২০২৫-এ, যা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের নীতির খসড়া। পাশাপাশি, গত ৪ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ১৮০ দিনের মধ্যে পর্যালোচনার আদেশ দেন। যদিও এই টিম বরখাস্ত হয়ে গেছে, তবে ট্রাম্প প্রশাসনের অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধারা দেখে মনে হয়, এটা তাদের পথে বাধা হবে না।

দ্বিতীয়ত, ভিত্তিহীন হুমকিকে গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো। উদাহরণ হিসেবে, মার্চে কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি ট্রাম্পকে সরাসরি জানান, কানাডার সার্বভৌমত্ব যুক্তরাষ্ট্রকে সম্মান করতে হবে। ট্রাম্প আগের প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোকে প্রায়ই ‘গভর্নর’ বলতেন। কিন্তু কার্নির দৃঢ় অবস্থানে সেই হুমকি কার্যকর হয়নি, কারণ, এতে রাজনৈতিক সমর্থন ছিল না।

তবে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের জন্য বিষয়টি আরও জটিল। বসন্তকালীন বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট ব্যাসেন্ট দুই সংস্থাকে সমালোচনা করলেও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের নেতৃত্বে থাকবে ও বৈশ্বিক প্রভাব বাড়াবে।

এখন অন্য দেশগুলোর ভাবতে হবে, তারা কতটা প্রস্তুত, যদি একটিমাত্র দেশ এককভাবে এমন সংস্থাগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে চায়—যদিও এগুলো সব দেশের টাকায় চলে।

যদিও ট্রাম্প ইউএসএআইডি বন্ধ করে দিয়েছেন, যার ফলে লাখ লাখ শিশু চিকিৎসা পাবে না, বহু মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা যাবে এবং পোলিওতে পঙ্গু হয়ে পড়বে; তারপরও আমেরিকানদের বড় অংশ বিদেশি সহায়তার পক্ষে।

তৃতীয়ত, কেউই একা নয়। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক কেবল নিজেদের সিদ্ধান্তে নয়, বরং বৈশ্বিক একটি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করে। যেমন কিছু মার্কিন আইনজীবী প্রতিষ্ঠান ট্রাম্পের বেআইনি আদেশ মানতে গিয়ে বিচারব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে। এমনটাই হয়েছে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও, যারা সরকারি হস্তক্ষেপে একাডেমিক স্বাধীনতা হারিয়েছে।

আইএমএফের কার্যকারিতা নির্ভর করে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নীতিনির্ধারকদের আস্থার ওপর। সেই আস্থা বজায় রাখতে হলে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ ও তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তারা যে অবকাঠামো বা জ্বালানি প্রকল্প করে, তা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মান নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে।

চতুর্থত, ট্রাম্প ব্যক্তি–সম্পর্ককে অনেক গুরুত্ব দেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি থেকে শুরু করে ব্রিটেনের কিয়ার স্টারমার ও ইতালির মেলোনির মতো নেতারা ট্রাম্পকে সন্তুষ্ট রাখতে সৌজন্য দেখিয়েছেন। তবে বড় প্রতিশ্রুতি দেননি।

আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থার জন্য এটি নতুন অভিজ্ঞতা, কারণ, তারা সাধারণত কাজ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও কংগ্রেসের সঙ্গে। এখন তাদের হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সরাসরি কৌশলী সম্পর্ক গড়তে হবে।

আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্কনীতি কি যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প উৎপাদনের সুদিন ফেরাবে২৬ এপ্রিল ২০২৫

সবশেষে, এই সংস্থাগুলোর মনে রাখা দরকার, শুধু মার্কিন প্রশাসন নয়, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণও তাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ১৯৯০-এর দশকে দারিদ্র্যপীড়িত দেশের ঋণ মওকুফে মার্কিন ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সমর্থন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের পক্ষেও সহায়ক হয়েছিল।

যদিও ট্রাম্প ইউএসএআইডি বন্ধ করে দিয়েছেন, যার ফলে লাখ লাখ শিশু চিকিৎসা পাবে না, বহু মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা যাবে এবং পোলিওতে পঙ্গু হয়ে পড়বে; তারপরও আমেরিকানদের বড় অংশ বিদেশি সহায়তার পক্ষে।

অর্ধেকের বেশি মানুষ প্রতিবছর দান করেন, চারজনের একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন এবং ১৯৬১ সাল থেকে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ পিস কর্পসে অংশ নিয়েছেন।

সুতরাং, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বের উচিত—কখন প্রতিবাদ জানাতে হবে আর কখন কৌশলী হতে হবে, সেই ভারসাম্য বজায় রাখা। শুধু ট্রাম্পকে খুশি রাখলেই হবে না, তাদের দায়িত্ব রয়েছে গোটা বিশ্বের প্রতিও।

নাইরি উডস অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাভাটনিক স্কুল অব গভর্নমেন্টের ডিন

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক জ কর

এছাড়াও পড়ুন:

নিট রিজার্ভও ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল

বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার মোট মজুত বা রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৪১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৭৪১ কোটি ডলার। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ২২ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ২০৪ কোটি ডলার। আজ বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। এর আগে ২০২৩ সালের আগস্টে রিজার্ভ এখন যে রিজার্ভ আছে, এর সমান ছিল।

২০২৪ সালের ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সপ্তাহে মোট রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। তখন বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ফলে মোট রিজার্ভ ও নিট রিজার্ভ—উভয়ই বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, এর আগে ১৪ এপ্রিল রিজার্ভ বেড়ে হয় ২৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৬৩৯ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ বেড়ে হয় ২১ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ১১১ কোটি ডলার।

প্রবাসীদের পাঠানো আয় আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাড়ছে। গত মার্চ মাসে ৩২৯ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় আসে; এক মাসের হিসাবে যেকোনো সময়ের চেয়ে এটি বেশি। আর চলতি মাসের ২৬ দিনে এসেছে ২২৭ কোটি ডলার। ফলে ব্যাংকগুলো উদ্বৃত্ত ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করছে। ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনলে আর বিদেশি ঋণ ও অনুদান এলেই রিজার্ভ বাড়ে। এতে বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

রিজার্ভ বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনের ওপর চাপ কমেছে। ডলারের দাম না বেড়ে ১২২ টাকায় অনেক দিন ধরে স্থির আছে। পাশাপাশি অনেক ব্যাংক এখন গ্রাহকদের চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছে। ফলে বাজারে পণ্যের সরবরাহ ও দাম স্বাভাবিক।

২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে ডলার নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হয়। ৮৫ টাকার ডলার বেড়ে ১২৮ টাকা পর্যন্ত ওঠে। সরকার পরিবর্তনের পর নানা উদ্যোগের কারণে প্রবাসী আয় বেড়েছে। পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়ছে না। এতে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অনেকটা স্বস্তি ফিরেছে। ২০২২ সালের আগের পরিস্থিতিতে ফিরে গেছে অনেক ব্যাংক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নিট রিজার্ভও ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল
  • বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে হবে
  • বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ
  • পাল্টা শুল্ক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে চটাব না: অর্থ উপদেষ্টা
  • আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ এখন নির্ভরশীল নয়: অর্থ উপদেষ্টা
  • আইএমএফ কিস্তি না দিলে নিজেদের মতো করে বাজেট করব: অর্থ উপদেষ্টা
  • সব শর্ত মেনে আইএমএফের ঋণ নেওয়া হবে না: অর্থ উপদেষ্টা