ট্রাম্পের সঙ্গে তাল মেলাতে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংককে যা করতে হবে
Published: 1st, May 2025 GMT
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক এখন কঠিন এক অবস্থায় রয়েছে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এই দুই সংস্থা বৈশ্বিক নিয়মনীতির রক্ষক এবং উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু আজ তারা একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো জাতীয়তাবাদী ও ক্ষমতাধর অংশীদারের মুখোমুখি, অন্যদিকে রয়েছে বাকি বিশ্ব।
তারা যদি সত্য কথা বলে, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনের রোষানলে পড়তে পারে; আর চুপ থাকলে তাদের নিজেদের বৈধতা ও দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এই দ্বিধার বাস্তব উদাহরণ দেখা গেছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক বসন্তকালীন বৈঠকে।
আইএমএফের কাজ হলো দেশগুলোর মুদ্রা বিনিময় হার এবং এমন নীতিগুলো নজরে রাখা, যেগুলো বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলে। যেসব দেশ প্রতিবেশীদের ক্ষতি করে, তাদের দায়ী করাই সংস্থাটির নীতিগত দায়িত্ব।
এখন পর্যন্ত আইএমএফ যুক্তরাষ্ট্রকে প্রকাশ্যে নিয়মভঙ্গকারী বলেনি। তবে আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতিকে ‘অত্যধিক অনিশ্চয়তা’ তৈরি করছে বলে মন্তব্য করেছেন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।
আরও পড়ুনট্রাম্পের দুনিয়া যখন বিভিন্ন ‘দুর্গের এক সমাবেশ’২৭ এপ্রিল ২০২৫বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বঙ্গাও বলেন, বিশ্বব্যাংক তার মূল লক্ষ্য-উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাস নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইউএসএআইডি বন্ধ করে দেওয়ায় বিশ্বব্যাংকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বড় আঘাত এসেছে। কারণ, ইউএসএআইডি ছিল এসব প্রকল্পের প্রধান সহায়ক।
বঙ্গা এ বিষয়ে কিছু না বলে কর্মসংস্থান এবং প্রযুক্তিনিরপেক্ষ জ্বালানি নিয়ে কথা বলেছেন, যা মার্কিন প্রশাসনের জলবায়ুবিরোধী অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কীভাবে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক সম্পর্ক বজায় রাখবে, সেটিই ঠিক করে দেবে তাদের ভবিষ্যৎ কার্যকারিতা। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম ১০০ দিনেই বোঝা গেছে, এদের জন্য সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
প্রথমত, এই সংস্থাগুলো সরাসরি টার্গেটে পড়তে পারে। ওয়াশিংটনের জন এফ কেনেডি সেন্টারসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বড় এনজিও ও দাতব্য সংস্থাগুলোও তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আরও পড়ুনডলারের সিংহাসন কি কেঁপে উঠছে২৮ এপ্রিল ২০২৫আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের নামও এসেছে প্রজেক্ট ২০২৫-এ, যা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের নীতির খসড়া। পাশাপাশি, গত ৪ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ১৮০ দিনের মধ্যে পর্যালোচনার আদেশ দেন। যদিও এই টিম বরখাস্ত হয়ে গেছে, তবে ট্রাম্প প্রশাসনের অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধারা দেখে মনে হয়, এটা তাদের পথে বাধা হবে না।
দ্বিতীয়ত, ভিত্তিহীন হুমকিকে গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো। উদাহরণ হিসেবে, মার্চে কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি ট্রাম্পকে সরাসরি জানান, কানাডার সার্বভৌমত্ব যুক্তরাষ্ট্রকে সম্মান করতে হবে। ট্রাম্প আগের প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোকে প্রায়ই ‘গভর্নর’ বলতেন। কিন্তু কার্নির দৃঢ় অবস্থানে সেই হুমকি কার্যকর হয়নি, কারণ, এতে রাজনৈতিক সমর্থন ছিল না।
তবে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের জন্য বিষয়টি আরও জটিল। বসন্তকালীন বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট ব্যাসেন্ট দুই সংস্থাকে সমালোচনা করলেও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের নেতৃত্বে থাকবে ও বৈশ্বিক প্রভাব বাড়াবে।
এখন অন্য দেশগুলোর ভাবতে হবে, তারা কতটা প্রস্তুত, যদি একটিমাত্র দেশ এককভাবে এমন সংস্থাগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে চায়—যদিও এগুলো সব দেশের টাকায় চলে।
যদিও ট্রাম্প ইউএসএআইডি বন্ধ করে দিয়েছেন, যার ফলে লাখ লাখ শিশু চিকিৎসা পাবে না, বহু মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা যাবে এবং পোলিওতে পঙ্গু হয়ে পড়বে; তারপরও আমেরিকানদের বড় অংশ বিদেশি সহায়তার পক্ষে।তৃতীয়ত, কেউই একা নয়। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক কেবল নিজেদের সিদ্ধান্তে নয়, বরং বৈশ্বিক একটি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করে। যেমন কিছু মার্কিন আইনজীবী প্রতিষ্ঠান ট্রাম্পের বেআইনি আদেশ মানতে গিয়ে বিচারব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে। এমনটাই হয়েছে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও, যারা সরকারি হস্তক্ষেপে একাডেমিক স্বাধীনতা হারিয়েছে।
আইএমএফের কার্যকারিতা নির্ভর করে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নীতিনির্ধারকদের আস্থার ওপর। সেই আস্থা বজায় রাখতে হলে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ ও তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তারা যে অবকাঠামো বা জ্বালানি প্রকল্প করে, তা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মান নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে।
চতুর্থত, ট্রাম্প ব্যক্তি–সম্পর্ককে অনেক গুরুত্ব দেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি থেকে শুরু করে ব্রিটেনের কিয়ার স্টারমার ও ইতালির মেলোনির মতো নেতারা ট্রাম্পকে সন্তুষ্ট রাখতে সৌজন্য দেখিয়েছেন। তবে বড় প্রতিশ্রুতি দেননি।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থার জন্য এটি নতুন অভিজ্ঞতা, কারণ, তারা সাধারণত কাজ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও কংগ্রেসের সঙ্গে। এখন তাদের হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সরাসরি কৌশলী সম্পর্ক গড়তে হবে।
আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্কনীতি কি যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প উৎপাদনের সুদিন ফেরাবে২৬ এপ্রিল ২০২৫সবশেষে, এই সংস্থাগুলোর মনে রাখা দরকার, শুধু মার্কিন প্রশাসন নয়, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণও তাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ১৯৯০-এর দশকে দারিদ্র্যপীড়িত দেশের ঋণ মওকুফে মার্কিন ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সমর্থন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের পক্ষেও সহায়ক হয়েছিল।
যদিও ট্রাম্প ইউএসএআইডি বন্ধ করে দিয়েছেন, যার ফলে লাখ লাখ শিশু চিকিৎসা পাবে না, বহু মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা যাবে এবং পোলিওতে পঙ্গু হয়ে পড়বে; তারপরও আমেরিকানদের বড় অংশ বিদেশি সহায়তার পক্ষে।
অর্ধেকের বেশি মানুষ প্রতিবছর দান করেন, চারজনের একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন এবং ১৯৬১ সাল থেকে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ পিস কর্পসে অংশ নিয়েছেন।
সুতরাং, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বের উচিত—কখন প্রতিবাদ জানাতে হবে আর কখন কৌশলী হতে হবে, সেই ভারসাম্য বজায় রাখা। শুধু ট্রাম্পকে খুশি রাখলেই হবে না, তাদের দায়িত্ব রয়েছে গোটা বিশ্বের প্রতিও।
নাইরি উডস অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাভাটনিক স্কুল অব গভর্নমেন্টের ডিন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক জ কর
এছাড়াও পড়ুন:
চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হবে ৩ শতাংশ, আইএমএফের নতুন পূর্বাভাস
চলতি বছরের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কিছুটা বাড়িয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ (শুল্ক) বৃদ্ধির ঝুঁকি ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
মঙ্গলবার প্রকাশিত আইএমএফের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হার ৩ শতাংশ হবে, যা গত এপ্রিলের পূর্বাভাসে ২ দশমিক ৮ শতাংশ বলা হয়েছিল। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে শূন্য দশমিক ২ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়তে পারে। এ ছাড়া ২০২৬ সালের জন্য ৩ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তবে আইএমএফ জানিয়েছে, প্রবৃদ্ধির হার এখনো করোনাপূর্ব গড় প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৭ শতাংশের নিচে রয়ে গেছে। খবর রয়টার্সের
আইএমএফ জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর গড় শুল্কহার বর্তমানে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এপ্রিল মাসে ছিল ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে এই হার এখনো বছরের শুরুতে প্রাক্কলিত ২ দশমিক ৫ শতাংশের তুলনায় অনেক বেশি।
আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়ের-অলিভিয়ে গৌরিনশাস বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতি এখনো অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। পাল্টা শুল্কহার বহাল থাকলে সেটি কমার সম্ভাবনা নেই।’
এদিকে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালে কমে ৪ দশমিক ২ শতাংশে নামতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ। তবে যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে শুল্কের প্রভাব সরাসরি ভোক্তাদের ওপর পড়তে পারে। ফলে দেশটির মূল্যস্ফীতি আবার বাড়তে পারে।
আইএমএফ বলছে, ওষুধ, কাঠ ও সেমিকন্ডাক্টরের ওপরও শিগগিরই উচ্চ শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এসব নতুন শুল্ক পরিকল্পনা তাদের পূর্বাভাসে ধরা হয়নি। বাস্তবে তা কার্যকর হলে, বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।