‘অবাজি ডাইল আর চইল কিনতে পরাণ বাইর যার, মাছ-গোস্ত হডে পাইয়ুম। গোস্ত হত্তে খাইয়্যি ইয়ান মনতও নাই।’ (বাবা ডাল আর চাল কিনতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, মাছ-মাংস কোথায় পাব? মাংস কখন খেয়েছি সেটা মনেও নেই।)
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলো বলছিলেন পটিয়ার ইন্দ্রপুল এলাকার লবণ শ্রমিক কবির হোসেন (৬৫)। তার গ্রামের বাড়ি চকরিয়ার পেকুয়ায়। তিনি ২০ বছর ধরে লবণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। দুই ছেলে, তিন মেয়ে, স্ত্রীসহ সাত সদস্যের সংসার তার। সংসার তাকে একাই চালাতে হয়। প্রতিদিন কাজ পেলে আয় হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। মাসে গড়ে ২০ দিন কাজ পান। আয় হয় ১০-১২ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে ৭ সদস্যের সংসার চালানো কঠিন। তার ওপর আছে ঋণের কিস্তি শোধের দায়।
কবির হোসেন বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত নৌকা ও ট্রাক থেকে লবণ খালাসের কাজ করি। মেয়ের বিয়ের জন্য ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি এনজিও থেকে। এগুলো প্রতি সপ্তাহে শোধ করতে হয়।’
গত বুধবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত উপজেলার ইন্দ্রপুল এলাকার লবণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। বেশির ভাগ শ্রমিক জানান, তাদের সংসারে অভাব লেগেই আছে। অনেকেই ঋণগ্রস্ত। সরেজমিন দেখা যায়, সারিবদ্ধ কারখানা আর গুদামে ঠাসা সরু গলিতে দিনের আলো ঠিকমতো পৌঁছায় না। প্রতিদিন কোটি টাকার বাণিজ্য হলেও পরিবেশ একেবারেই নোংরা। 
ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০টি লবণ কারখানা আছে ইন্দ্রপুল এলাকায়। ৭৭ বছর আগে ১৯৫২ সালে ইন্দ্রপুলে লবণ শিল্প গড়ে ওঠে। দেশের মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ লবণ সরবরাহ হয় এখানকার কারখানাগুলো থেকে। ৩ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। কক্সবাজারের টেকনাফ, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, মহেশখালী ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীর লবণ মাঠ থেকে নৌপথ ও সড়কপথে পটিয়ার ইন্দ্রপুলে অপরিশোধিত লবণ আসে। এখানকার অর্ধশতাধিক কারখানায় লোড-আনলোড ও ক্রাশিং কাজে যুক্ত শ্রমিকরা। লবণশিল্পের পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে চটশিল্প, সুতা, পলিব্যাগ, রাইস মিল, তুষ ও কালো কাঠের মিল, সেমাই ও ময়দা কারখানা।
লোড-আনলোডের কাজ করেন ভোলার আবুল হাশেম (৬০)। তিনি বলেন, ‘আমরা দিনে হাজার টাকা মজুরি পেলেও সংসার চালাতে কষ্ট হয়। বস্তা বহন করা অতি পরিশ্রমের কাজ। এ জন্য আমাদের অনেক খাওয়া-দাওয়া করতে হয়। প্রতিদিন একজন শ্রমিকের ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ করতে হয় খাওয়ার পেছনে। এতে দিনের আয়ের অর্ধেক চলে যায়। বাকি অর্ধেক টাকা দিয়ে ৫-৬ জন সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।’
মোহাম্মদ রিয়াজ (৩৬) বলেন, ‘আমাদের শ্রমে-ঘামে লবণ আমদানি রপ্তানির কাজ চলে পটিয়ায়। কিন্তু আমাদের জীবন চলে অনেক কষ্টে। অসুস্থ হলে কাজ জোটে না, খাবারও জোটে না। ২ বছর আগে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। এখনও শোধ করতে পারিনি।’
হাবিবুর রহমান (৫৫) বলেন, ‘ভারী কাজ প্রতিদিন করা সম্ভব হয় না। সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়া কাজ করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক আহত হন। কিন্তু আমাদের দেখার কেউ নেই। এ ছাড়া বর্ষা এলে কাজ থাকে না। এতে আমরা অভাবে পড়ি।’
১৯৫২ সালের দিকে চানখালী খালের পাড়ে লবণশিল্পের সূচনা হয়। তখনকার দিনে ওই এলাকায় কোনো লবণ কারখানা ছিল না। সে সময় সাম্পান বা বোটে করে বাঁশখালী এলাকা থেকে কালো লবণ এনে ইন্দ্রপুলে বিক্রি করা হতো। প্রথম দিকে এ শিল্পের সূচনা করেন হাজী চুন্নু মিয়া, পরবর্তী সময়ে চুন্নু মিয়ার ছেলে তোফায়েল আহমেদ সওদাগর লবণশিল্পের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। পরে আবদুল কাদের সওদাগর, আবদুর রহমান, নজু মিয়া, ফজর রহমান, আফাজুর রহমান, আবদুল খালেক, আবদুস ছামাদ, আবদুস সাত্তার, নুরুল হুদা, ইউসুফ, এজাহার মিয়া, মনীন্দ্রলাল, আবদুর রহিম, নজির আহমেদ, আলী আহমেদ, আজিজ সওদাগর, মতি সওদাগর, কবির আহমেদ, গাজী আবদুল কাদের, গাজী আবদুল হক, মুনসেফ আলী, আবুল খায়ের লবণশিল্পের বিকাশে বড় ভূমিকা রাখেন। 
বর্তমানে চানখালী খালের শাখা উপশাখা খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে। ফলে লবণশিল্পও পড়েছে সংকটে। ব্যবসায়ীরা খাল খননের দাবি জানিয়েছেন।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র রহম ন ক জ কর আম দ র র লবণ আবদ ল আহম দ লবণ শ

এছাড়াও পড়ুন:

প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ২০ জনকে ঠেলে দিল বিএসএফ

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মাসুদপুর সীমান্ত দিয়ে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ২০ জনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঠেলে দিয়েছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। গতকাল বুধবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে ভারতের ৭১ ব্যাটালিয়নের সভাপুর ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা শিবগঞ্জ উপজেলার মাসুদপুর সীমান্তের ৪/৫-১ এস আন্তর্জাতিক সীমান্ত পিলারের পাশ দিয়ে তাদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়। ঠেলে দেওয়াদের মধ্যে ৭ নারী ও ১০ শিশু রয়েছে। বিজিবি তাদের আটক করেছে।

৫৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাহাদ মাহমুদ রিংকু জানান, ঠেলে দেওয়া ২০ জন প্রায় ১০ বছর আগে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম এলাকা থেকে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে। তারা ভারতের রাজধানীর দিল্লির হরিয়ান এলাকায় একটি ইটভাটায় কাজ করত। পরে ভারতীয় পুলিশ তাদের আটক করে। ওই ২০ জনকে শিবগঞ্জ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

ঠেলে দেওয়াদের মধ্যে একজন রোজিনা বেগম জানান, কয়েক দিন ধরে বিএসএফ তাদের আটকে রেখেছিল। এ সময় সবাইকে নানা ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে। ঠিকমতো খেতে দেয়নি। বাচ্চারা খাবারের জন্য কাঁদলেও তাদের মন গলেনি। বুধবার ভোরে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে তাদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। এ সময় বৃষ্টিতে ভিজে তাঁর সন্তানসহ অন্য শিশুরা ঠান্ডায় কাঁপছিল। বাংলাদেশিরা আমাদের অনেক সাহায্য করছেন।

এদিকে, ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে আটক আল-আমিন নামে এক কিশোরকে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে বিজিবির কাছে ফেরত দিয়েছে বিএসএফ। মঙ্গলবার রাতে দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত দিয়ে ওই কিশোরকে ফেরত আনে বিজিবি। আল-আমিন হবিগঞ্জ জেলা সদরের কালিগাছতলা মহল্লার মোহাম্মদ আলীর ছেলে।
 
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিজিবি জানায়, আল-আমিন গত ১৫ জুন জাফলং সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল। এরপর মঙ্গলবার হিলি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় বিএসএফ সদস্যরা তাকে আটক করে। তাকে ফেরত পাঠাতে ওই দিনই বিএসএফ পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানায়। এরপর রাত ১০টায় বিজিবির কাছে তাকে ফেরত দেওয়া হয়। আল-আমিনের বিরুদ্ধে মামলা করে হাকিমপুর থানায় সোপর্দ করেছে বিজিবি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ