সৌদি আরবের মক্কা নগরে পবিত্র হজ পালন করতে এসেছেন ফিলিস্তিনের গাজার বাসিন্দা মোহাম্মদ শেহাদে। তবে হজে এলেও তাঁর মন পড়ে আছে গাজায়। তিনি বলছিলেন, জীবনে একবার হজের এই বিরল সুযোগ পেলেও তাঁর মন সব সময় উদ্বিগ্ন থাকে। কারণ, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় আটকে আছেন তাঁর স্ত্রী ও চার সন্তান।

৩৮ বছর বয়সী এই প্রকৌশলী ক্যানসারের জরুরি চিকিৎসার জন্য মিসরে যাওয়ার অনুমতি পেলেও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাঁর পরিবারের সদস্যদের তাঁর সঙ্গে দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।

শেহাদে বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে গাজা ছাড়ার সুযোগ তাঁকে পবিত্র হজে অংশ নেওয়ার ‘সবচেয়ে বড় সুযোগ’ এনে দিয়েছে।

আগামী বুধবার পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হচ্ছে।

শেহাদে বলছিলেন, মক্কার পবিত্র স্থানগুলোয় তিনি থাকলেও তাঁর মন ভারাক্রান্ত। কারণ, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা এখনো গাজায় ইসরায়েলি গোলার মধ্যে পড়ে আছেন।

শেহাদে কাবা শরিফের কাছে একটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলছিলেন, ‘জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো নিজের পরিবার থেকে দূরে থাকা।’

শেহাদে ছাড়াও গাজার কয়েক শ হজযাত্রী এসেছেন সৌদি আরবে। সারা বিশ্বের প্রায় ২০ লাখ মুসলিমের সঙ্গে তাঁরা হজ পালন করবেন।

সাদা কাপড় পরিহিত শেহাদে হজযাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে এএফপিকে বলেন, তিনি গাজায় যুদ্ধের অবসান ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পুনর্মিলনের জন্য দিনরাত আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন।

এই ফিলিস্তিনি আরও বলেন, ‘আপনি দুনিয়ার সবচেয়ে পবিত্র জায়গায় থাকলেও পরিবারের কাছ থেকে যদি দূরে থাকেন, তাহলে সুখী হতে পারবেন না।’

দুই আগুনের মাঝখানে

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকেই ইসরায়েল গাজায় নির্বিচার ও নৃশংস হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধিবরতির সময় তাদের হামলা কিছুটা থেমেছিল।

শেহাদের মতো কেউ কেউ চিকিৎসার জন্য গাজা থেকে বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু অন্যদের জন্য গাজা থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

ছলছল চোখে এই প্রকৌশলী বলেন, ‘আমি পবিত্র হজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু এমন অনেক কথা আছে, যা বলতে পারি না। বললে কান্না চলে আসে।’

শেহাদে যুদ্ধবিরতির সময় গাজা ছেড়েছিলেন। তবে এর কিছুদিন পর থেকে ইসরায়েল আবারও গাজায় নির্বিচার বোমাবর্ষণ শুরু করে। গাজায় কোনো ত্রাণ ঢুকতে দেয়নি। জাতিসংঘ ইতিমধ্যে গাজায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

শেহাদে বলেন, ‘আমি যখন বের হয়েছিলাম, তখন যেন দুই আগুনের মাঝখানে পড়ে গিয়েছিলাম। চিকিৎসার জন্য মিসরে যাওয়া ও পরিবারের কাছে থাকার মধ্যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল আমাকে।’

হামাস–শাসিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে গত ১৮ মার্চ ইসরায়েল আবার নৃশংস হামলা শুরুর পর গাজায় কমপক্ষে ৪ হাজার ১৪৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে মোট মৃত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৪১৮। তাঁদের বেশির ভাগই শিশু ও নারী।

ইসরায়েল দাবি করেছে, ২০২৩ সালে হামাসের হামলায় ১ হাজার ২১৮ জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যেও অধিকাংশ ছিলেন বেসামরিক নাগরিক।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত শুক্রবার বলেছেন, নতুন যুদ্ধবিরতির চুক্তি ‘খুব কাছাকাছি’।

তবে আলোচনার অগ্রগতি আবারও থমকে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

দেড় বছরের বেশি সময় ধরে ব্যর্থ আলোচনা দেখে হতাশ শেহাদে বলেন, ‘আমি এখন আশাবাদী হতে ভয় পাই। কারণ, তখন হতাশ হওয়াটা আরও কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়ায়।’

শান্তির জন্য প্রার্থনা

ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের মতে, এ বছর প্রায় ১ হাজার ৩৫০ জন গাজাবাসী (যাঁরা মূলত মিসরে অবস্থান করছেন) এবং সৌদি বাদশাহর অতিথি হিসেবে আরও ৫০০ জন হজ পালন করছেন।

৪৮ বছর বয়সী রজায়ি রাজেহ আল-খালুত স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে গাজা থেকে মিসরে পালিয়ে যান। তিনি বলেন, তাঁর বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। তাঁর আমদানি-রপ্তানি ব্যবসাও শেষ হয়ে গেছে।

রজায়ি বলেন, ‘হজ সাধারণত যেকোনো মুসলিমের জন্য আনন্দের সময় হলেও আমি কোনো আনন্দ অনুভব করতে পারছি না। আমার পরিবার, ভাই-বোনেরা এখনো গাজায়। প্রতিটি মুহূর্ত আমরা তাদের জন্য দুশ্চিন্তায় থাকি।’

রজায়ি সব হজযাত্রীর কাছে অনুরোধ জানান, তাঁরা যেন গাজায় যুদ্ধের অবসান ও পরিবারগুলোর পুনর্মিলনের জন্য দোয়া করেন।

গাজার এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি যুদ্ধ, মৃত্যু ও ধ্বংস ছাড়া এই পবিত্র স্থানে আসতে চাইতাম।’

ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম হচ্ছে হজ। সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলিমের জীবনে অন্তত একবার পালন করা বাধ্যতামূলক।

সরকারিভাবে নির্ধারিত কোটার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা পবিত্র হজ পালনের অনুমতি পান।

মক্কার আল-নুজহা প্লাস হোটেলে গাজার হজযাত্রীরা অবস্থান করছেন। সেই হোটেলের লবিতে ষাটোর্ধ্ব এক ফিলিস্তিনি বিধবা বলেন, গত বছর চিকিৎসার জন্য তাঁকে গাজা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর পর থেকে তাঁর ১০ সন্তানকে তিনি আর দেখতে পাননি।

এই নারী বলেন, ‘আমি প্রার্থনা করি, ফিলিস্তিনের সেসব শিশুর জন্য, যারা ক্ষুধা ও যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।’

এই ফিলিস্তিনি আরও বলেন, ‘আমার পুরো মন গাজায় পড়ে আছে। আমার জীবনটা সেখানেই। আমার ঘরে আমি ফিরতে চাই।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ও পর ব র পর ব র র ইসর য় ল হজয ত র প রক শ করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

২২ অনাথ কাশ্মীরি শিশুর পড়াশোনার দায়িত্ব নিলেন রাহুল গান্ধী

অপারেশন সিঁদুর চলাকালীন পাকিস্তানি গোলায় ভারত–নিয়ন্ত্রিত জম্মু–কাশ্মীরে যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের পরিবারের ২২ অনাথ শিশুর লেখাপড়ার পুরো দায়িত্ব নিয়েছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। ওই শিশুরা পুঞ্চ জেলার সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা।

স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠে স্নাতক হওয়া পর্যন্ত ওই শিশুদের পড়াশোনার সব খরচ রাহুল গান্ধী বহন করবেন। সেই খরচের প্রথম কিস্তির টাকা বুধবার ওই পড়ুয়াদের স্কুলে পৌঁছে যাবে বলে জানিয়েছেন জম্মু–কাশ্মীরের কংগ্রেস সভাপতি তারিক হামিদ কাররা।

পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল পর্যটকদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল কয়েকজন জঙ্গি। সেই হামলায় নিহত হয়েছিলেন মোট ২৬ জন পর্যটক। প্রত্যাঘাতের জন্য ভারত শুরু করে অপারেশন সিঁদুর। চার দিনের সেই লড়াইয়ের সময় জম্মুর সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রবল গোলাবর্ষণ করে পাকিস্তান। সেই হামলায় মারা গিয়েছিলেন ২৭ জন গ্রামবাসী। আহত হয়েছিলেন ৭০ জনের বেশি। যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, ওই ২২ শিশু ওইসব পরিবারেরই সন্তান। তাদের কেউ বাবা, কেউ মা, কেউ–বা দুজনকেই হারিয়েছে। কারও পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।

রাহুল গত মে মাসে ওইসব এলাকায় গিয়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। অনাথ শিশুদের স্কুলেও গিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি দলীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন অনাথ শিশুদের তালিকা তৈরি করতে। সরকারি নথির সঙ্গে সেই নাম মিলিয়ে ২২ জনের চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত হয়। পুঞ্চ জেলা সফরের সময় রাহুল তাঁর ইচ্ছার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, ওই শিশুদের স্নাতক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনার সব খরচ তিনি দেবেন।

পাকিস্তানের গোলার আঘাতে মারা গিয়েছিলেন ১২ বছরের দুই যমজ ভাই–বোন জাইন আলি ও উরবা ফতিমা। রাহুল তাঁদের স্কুলে গিয়েছিলেন। সেই স্কুলের পড়ুয়াদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাঁদের বলেছিলেন, তোমরা তোমাদের বন্ধুদের হারিয়েছ। সে জন্য তোমাদের মন খারাপ। ওই মৃত্যু আমাকেও দুঃখ দিয়েছে। তোমাদের দুঃখ আমি বুঝি। কিন্তু তোমাদের জন্য আমি গর্বিত। তোমরা ভয়কে জয় করেছ। রাহুল ওই শিশুদের বলেছিলেন, ভয়কে জয় করতে হবে। সুদিন আসবে। সব আবার স্বাভাবিক হবে।

ওই ২২ জনের জন্য বছরে কত খরচ হবে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব তা জানাননি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ