যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নেতা ও মানবাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ম্যালকম এক্স ১৯৬৪ সালের এপ্রিলে জেদ্দায় তৎকালীন ক্রাউন প্রিন্স ফয়সাল আল-সৌদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে হজ পালন করেছিলেন।

সে হজযাত্রা কেবল তাঁর জীবনদর্শনই আমূল বদলে দেয়নি; যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের সংগ্রামেও গভীর প্রভাব ফেলে এবং ইসলামের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। তাঁর এই অভিজ্ঞতা আমেরিকায় ইসলামের সহনশীল ও ঐক্যবদ্ধ বার্তাকে ছড়িয়ে দেয়, যা আজও একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়।

ম্যালকম এক্স ১৯২৫ সালে ম্যালকম লিটল নামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে তিনি হয়ে ওঠেন নেশন অব ইসলামের একজন প্রভাবশালী সদস্য। ১৯৩০-এর দশকে ওয়ালেস ডি.

ফার্দ মুহাম্মদ প্রতিষ্ঠিত এই আফ্রিকান-আমেরিকান রাজনৈতিক-ধর্মীয় আন্দোলন আফ্রিকান-আমেরিকানদের আধ্যাত্মিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কাজ করত।

সে হজযাত্রা কেবল তাঁর জীবনদর্শনই আমূল বদলে দেয়নি; যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের সংগ্রামেও গভীর প্রভাব ফেলে এবং ইসলামের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়।

তবে, এই সংগঠনকে সমালোচকেরা কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যবাদী বলে অভিহিত করতেন। ম্যালকম তাঁর বক্তৃতায় শ্বেতাঙ্গ আমেরিকার বিরুদ্ধে আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রতি অবিচারের তীব্র নিন্দা করতেন, যা তাঁকে অনেকের কাছে একজন সাহসী নেতা এবং অন্যদের কাছে বর্ণবাদী ও সহিংসতার প্রচারক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

আরও পড়ুনইবনে বতুতার হজ সফর২৮ মে ২০২৫

১৯৬৪ সালে মক্কায় হজ পালনের অভিজ্ঞতা ম্যালকমের জীবনে একটি মোড় বদল হিসেবে কাজ করে। তিনি নেশন অব ইসলাম ত্যাগ করেন এবং আল-হাজ্জ মালিক এল-শাবাজ নামে নতুন পরিচয়ে আমেরিকায় ফেরেন। হজে তিনি ইসলামের সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও বর্ণবৈষম্যহীন অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, যা তাঁর পূর্ববর্তী বিশ্বাসকে নতুন করে গঠন করে।

ফিরে এসে তিনি ‘অর্গানাইজেশন অব আফ্রো-আমেরিকান ইউনিটি’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্ণবাদকে আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে, শ্বেতাঙ্গ জাতিকে নয়। এই নতুন দর্শন সিভিল রাইটস আন্দোলনে, বিশেষ করে স্টুডেন্ট নন-ভায়োলেন্ট কো-অর্ডিনেটিং কমিটির নেতাদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ম্যালকমের মধ্যপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি আমেরিকায় ইসলামের একটি নতুন বোঝাপড়ার পথ তৈরি করে।

গত ১১ দিন ধরে আমি মুসলিম বিশ্বে একই থালায় খেয়েছি, একই গ্লাসে পানি পান করেছি, একই চাটাইয়ে ঘুমিয়েছি—একই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি সহযাত্রী মুসলিমদের সঙ্গে।ম্যালকম এক্স

মক্কা থেকে একটি বিখ্যাত চিঠিতে ম্যালকম এক্স লিখেছিলেন, ‘এই প্রাচীন পবিত্র ভূমিতে, আব্রাহাম, মুহাম্মদ ও অন্যান্য নবীদের ঘরে, আমি এমন আন্তরিক আতিথেয়তা ও সত্যিকারের ভ্রাতৃত্বের চর্চা দেখেছি, যা বিভিন্ন রঙ ও জাতির মানুষের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। গত ১১ দিন ধরে আমি মুসলিম বিশ্বে একই থালায় খেয়েছি, একই গ্লাসে পানি পান করেছি, একই চাটাইয়ে ঘুমিয়েছি—একই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি সহযাত্রী মুসলিমদের সঙ্গে।’

তিনি তাঁর চিঠি শেষ করেন এই বলে, ‘আমি কখনো এত সম্মানিত বোধ করিনি, আবার এত বিনয়ী ও অযোগ্যও মনে হয়নি।’ এই চিঠি তিনি রাতভর নকল করে তাঁর স্ত্রী, বড় বোন এলা এবং আমেরিকার গণমাধ্যমের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

আরও পড়ুনমালির সম্রাটের মহাকাব্যিক হজ সফর২২ মে ২০২৫

জেদ্দা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর তিনি ঘানা, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে আগত হজযাত্রীদের বৈচিত্র্য দেখে মুগ্ধ হন।

তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘আমার চোখ যে মানুষের সমাগম দেখেছে, তা চলচ্চিত্রের ক্যামেরায় ধরা পড়ার মতো রঙিন দৃশ্য। চীনা, ইন্দোনেশিয়ান, আফগান—অনেকে এখনো ইহরামের পোশাক না পরে তাদের স্থানীয় পোশাকে ছিলেন। এ যেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের পাতা।’

৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে তাঁর সংগঠনের একটি সমাবেশে বক্তৃতার সময় নেশন অব ইসলামের সদস্যদের হাতে তিনি নিহত হন। এই ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগে তাঁর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

এই অভিজ্ঞতা তাঁকে ইসলামের সর্বজনীনতা ও সমতার শিক্ষা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

ম্যালকমের হজযাত্রা আমেরিকায় ইসলামের প্রচারে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তাঁর এই অভিজ্ঞতা আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলামকে একটি সহনশীল ও ঐক্যবদ্ধ ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করে।

তবে তাঁর এই রূপান্তরের পথ সহজ ছিল না। ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে তাঁর সংগঠনের একটি সমাবেশে বক্তৃতার সময় নেশন অব ইসলামের সদস্যদের হাতে তিনি নিহত হন। এই ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগে তাঁর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

ম্যালকমের মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার আন্দোলনের জন্য একটি বড় ক্ষতি হলেও তাঁর হজযাত্রার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা আজও বিশ্বব্যাপী মানুষকে সহনশীলতা ও ঐক্যের বার্তা দিয়ে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

সূত্র: আরব নিউজ

আরও পড়ুনশতবর্ষ–প্রাচীন হজের ডায়েরি১৫ এপ্রিল ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র আম র ক য ইসল ম র হজয ত র

এছাড়াও পড়ুন:

যুক্তরাষ্ট্রের গতিপথ পাল্টে দেওয়া ম্যালকম এক্সের হজযাত্রা

যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নেতা ও মানবাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ম্যালকম এক্স ১৯৬৪ সালের এপ্রিলে জেদ্দায় তৎকালীন ক্রাউন প্রিন্স ফয়সাল আল-সৌদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে হজ পালন করেছিলেন।

সে হজযাত্রা কেবল তাঁর জীবনদর্শনই আমূল বদলে দেয়নি; যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের সংগ্রামেও গভীর প্রভাব ফেলে এবং ইসলামের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। তাঁর এই অভিজ্ঞতা আমেরিকায় ইসলামের সহনশীল ও ঐক্যবদ্ধ বার্তাকে ছড়িয়ে দেয়, যা আজও একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়।

ম্যালকম এক্স ১৯২৫ সালে ম্যালকম লিটল নামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে তিনি হয়ে ওঠেন নেশন অব ইসলামের একজন প্রভাবশালী সদস্য। ১৯৩০-এর দশকে ওয়ালেস ডি. ফার্দ মুহাম্মদ প্রতিষ্ঠিত এই আফ্রিকান-আমেরিকান রাজনৈতিক-ধর্মীয় আন্দোলন আফ্রিকান-আমেরিকানদের আধ্যাত্মিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কাজ করত।

সে হজযাত্রা কেবল তাঁর জীবনদর্শনই আমূল বদলে দেয়নি; যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের সংগ্রামেও গভীর প্রভাব ফেলে এবং ইসলামের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়।

তবে, এই সংগঠনকে সমালোচকেরা কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যবাদী বলে অভিহিত করতেন। ম্যালকম তাঁর বক্তৃতায় শ্বেতাঙ্গ আমেরিকার বিরুদ্ধে আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রতি অবিচারের তীব্র নিন্দা করতেন, যা তাঁকে অনেকের কাছে একজন সাহসী নেতা এবং অন্যদের কাছে বর্ণবাদী ও সহিংসতার প্রচারক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

আরও পড়ুনইবনে বতুতার হজ সফর২৮ মে ২০২৫

১৯৬৪ সালে মক্কায় হজ পালনের অভিজ্ঞতা ম্যালকমের জীবনে একটি মোড় বদল হিসেবে কাজ করে। তিনি নেশন অব ইসলাম ত্যাগ করেন এবং আল-হাজ্জ মালিক এল-শাবাজ নামে নতুন পরিচয়ে আমেরিকায় ফেরেন। হজে তিনি ইসলামের সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও বর্ণবৈষম্যহীন অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, যা তাঁর পূর্ববর্তী বিশ্বাসকে নতুন করে গঠন করে।

ফিরে এসে তিনি ‘অর্গানাইজেশন অব আফ্রো-আমেরিকান ইউনিটি’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্ণবাদকে আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে, শ্বেতাঙ্গ জাতিকে নয়। এই নতুন দর্শন সিভিল রাইটস আন্দোলনে, বিশেষ করে স্টুডেন্ট নন-ভায়োলেন্ট কো-অর্ডিনেটিং কমিটির নেতাদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ম্যালকমের মধ্যপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি আমেরিকায় ইসলামের একটি নতুন বোঝাপড়ার পথ তৈরি করে।

গত ১১ দিন ধরে আমি মুসলিম বিশ্বে একই থালায় খেয়েছি, একই গ্লাসে পানি পান করেছি, একই চাটাইয়ে ঘুমিয়েছি—একই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি সহযাত্রী মুসলিমদের সঙ্গে।ম্যালকম এক্স

মক্কা থেকে একটি বিখ্যাত চিঠিতে ম্যালকম এক্স লিখেছিলেন, ‘এই প্রাচীন পবিত্র ভূমিতে, আব্রাহাম, মুহাম্মদ ও অন্যান্য নবীদের ঘরে, আমি এমন আন্তরিক আতিথেয়তা ও সত্যিকারের ভ্রাতৃত্বের চর্চা দেখেছি, যা বিভিন্ন রঙ ও জাতির মানুষের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। গত ১১ দিন ধরে আমি মুসলিম বিশ্বে একই থালায় খেয়েছি, একই গ্লাসে পানি পান করেছি, একই চাটাইয়ে ঘুমিয়েছি—একই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি সহযাত্রী মুসলিমদের সঙ্গে।’

তিনি তাঁর চিঠি শেষ করেন এই বলে, ‘আমি কখনো এত সম্মানিত বোধ করিনি, আবার এত বিনয়ী ও অযোগ্যও মনে হয়নি।’ এই চিঠি তিনি রাতভর নকল করে তাঁর স্ত্রী, বড় বোন এলা এবং আমেরিকার গণমাধ্যমের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

আরও পড়ুনমালির সম্রাটের মহাকাব্যিক হজ সফর২২ মে ২০২৫

জেদ্দা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর তিনি ঘানা, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে আগত হজযাত্রীদের বৈচিত্র্য দেখে মুগ্ধ হন।

তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘আমার চোখ যে মানুষের সমাগম দেখেছে, তা চলচ্চিত্রের ক্যামেরায় ধরা পড়ার মতো রঙিন দৃশ্য। চীনা, ইন্দোনেশিয়ান, আফগান—অনেকে এখনো ইহরামের পোশাক না পরে তাদের স্থানীয় পোশাকে ছিলেন। এ যেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের পাতা।’

৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে তাঁর সংগঠনের একটি সমাবেশে বক্তৃতার সময় নেশন অব ইসলামের সদস্যদের হাতে তিনি নিহত হন। এই ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগে তাঁর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

এই অভিজ্ঞতা তাঁকে ইসলামের সর্বজনীনতা ও সমতার শিক্ষা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

ম্যালকমের হজযাত্রা আমেরিকায় ইসলামের প্রচারে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তাঁর এই অভিজ্ঞতা আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলামকে একটি সহনশীল ও ঐক্যবদ্ধ ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করে।

তবে তাঁর এই রূপান্তরের পথ সহজ ছিল না। ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে তাঁর সংগঠনের একটি সমাবেশে বক্তৃতার সময় নেশন অব ইসলামের সদস্যদের হাতে তিনি নিহত হন। এই ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগে তাঁর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

ম্যালকমের মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার আন্দোলনের জন্য একটি বড় ক্ষতি হলেও তাঁর হজযাত্রার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা আজও বিশ্বব্যাপী মানুষকে সহনশীলতা ও ঐক্যের বার্তা দিয়ে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

সূত্র: আরব নিউজ

আরও পড়ুনশতবর্ষ–প্রাচীন হজের ডায়েরি১৫ এপ্রিল ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ