ঘোষিত বাজেটে আ.লীগ আমলের ধারাবাহিকতাই রক্ষা হয়েছে: গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি
Published: 3rd, June 2025 GMT
প্রস্তাবিত বাজেটে আওয়ামী লীগ আমলের ধারাবাহিকতাই রক্ষা করা হয়েছে বলে মনে করে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। তারা বলেছে, বাজেটে বেশির ভাগ খাতে খরচ কমানো হলেও জনপ্রশাসন খাতের খরচ আরও বাড়ানো হয়েছে, কমানো হয়েছে জনগুরুত্বপূর্ণ খাতের বাজেট। বাজেটে আগের মতোই রাঘব বোয়ালদের কাছ থেকে কর আদায়ের ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।
আজ মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ার শিক্ষক লাউঞ্জে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির কার্যনির্বাহী সভা অনুষ্ঠিত হয়। কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের সভাপতিত্বে সভায় কারা হেফাজতে বম নাগরিকের মৃত্যু, শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি নিয়ে টালবাহানা, বাজেটে আওয়ামী আমলের ধারাবাহিকতা রক্ষা, চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে সরকারের অপতৎপরতা, দেশজুড়ে সংখ্যালঘু ও নারীদের ওপর হামলা–হয়রানির ওপর নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়।
সভার শুরুতেই অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আলোচনা হয়। অধিকার কমিটির নেতারা বলেন, নতুন বাজেটে আওয়ামী লীগ আমলের ধারাবাহিকতাই রক্ষা করা হয়েছে। বাজেটে বেশির ভাগ খাতে খরচ কমানো হলেও জনপ্রশাসন খাতের খরচ আরও বাড়ানো হয়েছে, কমানো হয়েছে জনগুরুত্বপূর্ণ খাতের বাজেট। অন্যদিকে বাজেটের কোনো ধরনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়নি। এখনো মানুষের কাছে সরকারের পরিচালন ব্যয়ের আদ্যোপান্ত হিসাব ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিস্তারিত ডকুমেন্ট (নথি) উন্মুক্ত নয়। ফলে বাজেটের কত টাকা লুটপাট হবে, অপচয় হবে, সেটা জানার কোনো সুযোগ জনগণের সামনে রাখা হয়নি। বাজেটে আগের মতোই রাঘব বোয়ালদের কাছ থেকে কর আদায়ের ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।
বাজেটে আগের মতোই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে উল্লেখ করে অধিকার কমিটির সভায় বলা হয়, বাজেটে কর্মসংস্থান বাড়ানোর ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাও নেই। সেই সঙ্গে বিভিন্ন দেশি শিল্পের ওপর যেভাবে শুল্ক চাপানো হয়েছে, সেটা অন্তর্বর্তী সরকারের বিদেশমুখিতাকেই সামনে আনে। আওয়ামী লীগের মতোই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাদের খুশি করার পথে হাঁটছে এবং বাজেটের নানা খাতের হিসাব দেওয়ার সময় ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে। এর উদাহরণ হিসেবে সভায় কমিটির নেতারা সামাজিক নিরাপত্তা খাতের কথা বলেন। তাঁরা বলেন, এ ক্ষেত্রে লাখ–কোটি টাকার ওপর বাজেট দেখানো হলেও আসলে তার মধ্যে পেনশন ও ভর্তুকির টাকা যোগ করা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সভা থেকে বাজেটের সব প্রকল্প ও পরিচালন ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব জনগণের কাছে অবিলম্বে উন্মুক্ত করতে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়।
সভায় বলা হয়, সম্প্রতি ঘটা সংময় বমের মৃত্যু এবং এর আগে লাল ত্লেং কিম বমসহ অন্যান্য বম নাগরিকের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনা কেবল ব্যক্তিগত অবহেলার উদাহরণ নয়; বরং এটি একটি বৃহত্তর ও সুপরিকল্পিত কাঠামোর অংশ। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র বম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি প্রক্রিয়াধীন জাতিগত নির্মূল অভিযান পরিচালনা করছে। এ নির্মূল অভিযান সরাসরি রাষ্ট্রীয় মদদে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় সহযোগিতায় এবং ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ প্রচারণার নামে পরিচালিত হচ্ছে। নির্বিচার আটক বম নাগরিকদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি।
গতকাল কারখানা কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহারের কারণে অপমানিত হয়ে গাজীপুরের শ্রীপুরে জিন্নাত নিটওয়্যার কারখানায় ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু হওয়ার অভিযোগের প্রসঙ্গ তুলে ধরে সভায় বলা হয়, ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভে পুলিশের হামলায় প্রায় ২০ জন শ্রমিক আহত হন। অন্যদিকে এখনো টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিকেরা তাঁদের প্রতিশ্রুত বকেয়া মজুরি পুরোটা পাননি। গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি মনে করে, এসব ঘটনায় শ্রমিক ইস্যুতে সরকারের অসংবেদনশীলতাই প্রকাশিত হয়। কমিটি এ–ও মনে করে, এসবেরই প্রতিফলন ঘটেছে এবারের বাজেটেও। যার কারণে আওয়ামী লীগ আমলের মতোই শ্রমিকদের জন্য সর্বনিম্ন বরাদ্দই রাখা হয়েছে।
যশোরের অভয়নগরে হিন্দুদের ওপর হামলা ঠেকাতে সরকারের ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করা হয় অধিকার কমিটির সভায়। একই সঙ্গে শিক্ষক নাদিরা ইয়াসমিনসহ বিভিন্ন জায়গায় মব তৈরি করে নারীদের ওপর যে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ ও হয়রানি চলছে, সেগুলো ঠেকাতে সরকারের ব্যর্থতার তীব্র নিন্দা জানায় কমিটি।
সভা শেষে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির পক্ষ থেকে ১৪ জুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনা ও ২১ জুন চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক আলোচনার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
এ সভায় গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, মানজুর-আল-মাতিন, বীথি ঘোষ, সীমা দত্ত, মারজিয়া প্রভা, কৌশিক আহমেদ, ফেরদৌস আরা রুমী, সুজিত চৌধুরী, মাহতাব উদ্দীন আহমেদ, হারুন অর রশিদ, আবদুল্লাহ কাফী রতন, আনিস রায়হান, সত্যজিৎ বিশ্বাস, ইকবাল কবীর, দিলীপ রায়, রাফিকুজ্জামান ফরিদ, তামজিদ হায়দার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল গ আমল র গ র মত ই সরক র র পর চ ল র ওপর আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
সালমান, শিবলী ও সায়ান পুঁজিবাজারে ‘আজীবন অবাঞ্ছিত’
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তাঁর ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমান এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামকে পুঁজিবাজারে আজীবন অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া বিএসইসির সাবেক কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ও আইএফআইসি ইনভেস্টমেন্টসের সাবেক প্রধান নির্বাহী ইমরান আহমেদকে পাঁচ বছরের জন্য পুঁজিবাজারে অবাঞ্ছিত করা হয়েছে।
বিএসইসি জানিয়েছে, সালমান রহমান ও তাঁর ছেলেকে আজীবন অবাঞ্ছিত ঘোষণার পাশাপাশি দেড় শ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আইএফআইসি ব্যাংক গ্যারান্টেড শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ড ও বেক্সিমকো গ্রিন সুকুকের অর্থ উত্তোলন-সংক্রান্ত নানা অনিয়মের জন্য এসব ব্যক্তিকে জরিমানার পাশাপাশি শেয়ারবাজারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।
গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বিএসইসির ৯৬৫তম সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব সিদ্ধান্তের কথা আজ বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে বিএসইসি। সংস্থাটি জানায়, আড়াই হাজার কোটি টাকার শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ডটি ২০২৩ সালের ৪ জুন বিএসইসির কমিশন সভায় অনুমোদিত হয়। আর ওই বছরের ১২ জুলাই কমিশনের পক্ষ থেকে সম্মতিপত্র ইস্যু করা হয় শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের নামে। অথচ কোম্পানিটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয় ২০২৩ সালের ২ মার্চ। নিবন্ধনের মাত্র এক মাস পরই ১১ এপ্রিল শ্রীপুর টাউনশিপের পক্ষ থেকে বন্ড ইস্যুর আবেদন করা হয়।
বিএসইসি আরও জানায়, বন্ডটির জামিনদার বা গ্যারান্টার ছিল আইএফআইসি ব্যাংক। পরামর্শক ও অ্যারেঞ্জার ছিল মার্চেন্ট ব্যাংক আইএফআইসি ইনভেস্টমেন্টস। ট্রাস্টি ছিল সন্ধানী লাইফ ইনস্যুরেন্স, নিরীক্ষক ছিল এমজে আবেদিন অ্যান্ড কোং এবং ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ছিল এমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড। আইএফআইসি ব্যাংক এই বন্ড ইস্যু না করলেও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে বন্ডের নাম হিসেবে ‘আইএফআইসি আমার বন্ড’ নাম ব্যবহার করে। এভাবে বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা হয়েছিল। পুঁজিবাজার অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি এ বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষে তাদের প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কমিশন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
এই বন্ড ইস্যুতে অনিয়মের জন্য আইএফআইসি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানকে ১০০ কোটি টাকা জরিমানা ও পুঁজিবাজারে আজীবন অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে ব্যাংকটির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানকে ৫০ কোটি টাকা জরিমানা ও পুঁজিবাজারে আজীবন অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। আইএফআইসি ইনভেস্টমেন্টসের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী ইমরান আহমেদকে পাঁচ বছরের জন্য পুঁজিবাজারে নিষিদ্ধ করা হয়। সেই সঙ্গে আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ারের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি। তবে তাঁর বিষয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা বিএসইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।
একই ঘটনায় ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান এমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেডকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর বাইরে শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ডের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে বিএসইসি।
বিএসইসির ওই সভায় বেক্সিমকোর ৩ হাজার কোটি টাকার পাঁচ বছর মেয়াদি অ্যাসেট-ব্যাকড গ্রিন সুকুক বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে কোম্পানিটিকে বিধিবহির্ভূতভাবে বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় শিবলী রুবাইয়াতকে আজীবন এবং শেখ শামসুদ্দিন আহমেদকে পাঁচ বছরের জন্য অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।
আজীবন অবাঞ্ছিত হওয়া ব্যক্তিরা শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট কী কী কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন বা পারবেন না, তার বিস্তারিত তাৎক্ষণিকভাবে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। এ সিদ্ধান্ত কীভাবে কার্যকর করা হবে, তারও সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা ঘোষণা করা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে কমিশনের পক্ষ থেকে আলাদা নির্দেশনা জারি করা হবে। সে অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে।
তবে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আইনি ভিত্তি ও সক্ষমতা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেই। ফলে শেষ পর্যন্ত এসব সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে, এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাঁরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যেগুলো বাস্তবে সহজে প্রয়োগযোগ্য এবং ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জের মধ্যে না পড়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় বাস্তবভিত্তিক। এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন নয়, যা কার্যকর করা যাবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক অঙ্গনে এ ধরনের অবাঞ্ছিত ঘোষণার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু পুঁজিবাজার ও সিকিউরিটিজ আইনে এ ধরনের ভাষা ও শাস্তির মানে কী, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। এমনকি এর অর্থও আমি বুঝতে অক্ষম।’