দায়সারা জলবায়ু সম্মেলন, বিপদ এখন দোরগোড়ায়
Published: 5th, June 2025 GMT
মহাবিশ্ব বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অসীম। এখন পর্যন্ত ৯৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন বা ৯৩ শত কোটি আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণায় এসেছে। রয়েছে কোটি কোটি গ্যালাক্সি। অনেকগুলো গ্যালাক্সির গ্রুপকে বলে ‘লোকাল গ্যালাটিক’। আর অনেকগুলো লোকাল গ্যালাটিক নিয়ে গড়ে উঠেছে সুপার ক্লাস্টার। আমাদের মিল্কওয়ে গ্যালাক্সি সুপার ক্লাস্টার ‘ ল্যানাকিয়া’তে অবস্থান করছে। এই ল্যানাকিয়াতে আছে এক থেকে দেড় লক্ষ গ্যালাক্সি। শুধু মিল্কওয়ে গ্যালাক্সিতে রয়েছে ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্র ও ব্যাস এক লক্ষ আলোক বর্ষ। অতএব মহাবিশ্বে বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কত গ্রহ আর উপগ্রহ আছে সেটা সংখ্যা দিয়ে উল্লেখ করা খুবই কষ্টসাধ্য। হয়ত আমাদের পৃথিবীর মত বাসযোগ্য স্বপ্নময় গ্রহ অসংখ্য আছে। সন্ধান পেলেও মানুষ কোন দিন যেতে পারবে কিনা সেটা প্রশ্নের বিষয়। আলোর গতিতে চললেও মানুষের আয়ুতে কুলাবে না। তাছাড়া মহাকাশে রয়েছে নানা রকম বিপদ। মানুষ মহাকাশে বিভিন্ন যান ও যন্ত্র পাঠালেও শুধু মাত্র পা রেখেছে ঘরের পাশে চাঁদে। মানুষ কোন সময় স্বশরীরে সৌর জগত বা সূর্যের আওয়াধীন এলাকা অতিক্রম করতে পারবে কিনা সেটা এখনও বড় প্রশ্নের বিষয়।
বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের স্বপ্নের পৃথিবী প্রথম দিকে ছিল লাল অগ্নিগোলক, লক্ষ লক্ষ বছরের ঘটনার পরিক্রমায় এক সময় সাগর সৃষ্টি হয়ে ব্যাপকহারে জলজ উদ্ভিদ জন্মায় এবং এই সময় অক্সিজেন সৃষ্টি হওয়া শুরু করে। তখন পৃথিবীর রং ছিল সবুজ এরপর ঘটনার পরিক্রমায় প্রাণের উপযোগী নীল চেহারায় রুপ নেয়। আর এই গ্রহে রয়েছে মহামূল্যবান জীবনের অগণিত গল্প, ইতিহাস, সভ্যতা, কতকিছু। কিন্তু বিপদ এখন দোরগোড়ায় ।
বিজ্ঞানীদের ভাষায় বর্তমানে পৃথিবী আছে ‘অ্যানথ্রোপসিন এপো’ যুগে। অর্থাৎ এই নীল গ্রহ ভয়ঙ্কর এক দিকে যাচ্ছে। এ জন্য দায়ী মূলত মানবসৃষ্ট জলবায়ুর পরিবর্তন বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। আর এমন দুঃসময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তীব্র গোলযোগ, সংঘর্ষ ও যুদ্ধ বিদ্যমান, অর্থনৈতিক ব্যাপার, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষমতা, আধিপত্য, স্বার্থ ও ভোগ বিলাসে মত্ত মানুষ।
বিজ্ঞানী ও সচেতন মহলের বার বার হুঁশিয়ারি ও পীড়াপীড়িতে পৃথিবীর নেতারা জলবায়ু সম্মেলনে বসছে। কত আলোচনা, নথিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, আর কত প্রতিশ্রুতি! নীতিগত দড়ি-টানাটানি ও ঠেলাঠেলি শেষ নেই। এক দেশ সই করে তো অন্য দেশ করে না বা মানে না। একজন বলে অন্যরা আগে করুক তারপর আমরা করব। প্রতিবছর সম্মেলন যেন হয়ে ওঠে বিশ্ব নেতাদের ও কিছু মানুষের পিকনিক পার্টি। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
প্রকৃতি কাউকে দয়া বা ক্ষমা করেনা, আপন গতিতে চলে। উন্নত বিশ্বের ছলচাতুরি, গরিবের আত্ননাদ, কিছু প্রাপ্তির নীতি, টেন্ডারবাজি, স্বজনপ্রীতি, দায়সারা নীতি কিছুই মেনে নেয় না। নিয়মের বাইরে চলে গেলে, সে যে কত নিষ্ঠুর ও নির্মম হতে পারে সেটা এখন বিশ্ববাসী হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করা শুরু করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে উষ্ণতা বেড়ে চলছে। সর্বত্রই গরমের বিভীষিকা! প্রতিটি গ্রীষ্ম হচ্ছে দীর্ঘায়িত ও সহ্যাতীত। মানছে না কোন ক্যালেন্ডার।
জাতিসংঘের আবহাওয়া ও জলবায়ু সংস্থার মতে, ২০০০ সালের পর থেকে প্রতি বছর তাপমাত্রা চরমভাবে বৃদ্ধি অব্যাহত আছে । তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে গ্রাম, শহরসহ প্রতিটি জনপদ। ৪৬/৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এখন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়মিত তাপমাত্রা। পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকাও তাপে পুড়ে ছারখার হওয়া শুরু করেছে। ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও মিয়ানমারের তাপমাত্রা ৫০/৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাচ্ছে।
বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। ক্রমশ প্রখর থেকে প্রখরতর হচ্ছে প্রতিটি গ্রীষ্ম। কংক্রিটের আধিক্যে প্রচণ্ড গরমে ঢাকা শহর যেন গনগন করে। এই হারে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রীষ্মকালে দেশের সার্বিক গড় তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে, যা চরম পরিস্থিতি বলে ধরা হয়।
গবেষকদের মতে, এসবের মূল কারণ, নানান উৎস থেকে বাতাসে মিশে যাওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। কয়লা এবং পেট্রলিয়ামের মতো জীবাশ্ম-জ্বালানি পোড়ানোর কারণে এই গ্যাসগুলির নিঃসরণ বেড়ে যাচ্ছে । পাশাপাশি অতি আধুনিকতা ও উন্নয়নের নামে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, বনভূমি উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, ইটের ভাটা নির্মাণ প্রভৃতি কারণে সমস্যা বেড়ে চলেছে।
গাছ বাতাস থেকে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিকর কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্যাস শুষে নিয়ে অক্সিজেন ফিরিয়ে দেয় প্রকৃতিতে। যাকে বলা হয় ফটোসিন্থেসিস বা সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া। এর জন্য গাছের প্রয়োজন হয় কার্বন ডাইঅক্সাইড, পানি ও সূর্যালোক। তবে, তাপমাত্রা ১১৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪৬.
জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ’ নামে পরিচিত। এর পূর্ণরূপ ‘কনফারেন্স অব পার্টিস’। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের ‘ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী প্রায় ২০০ দেশ কপের সদস্য।
১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর (কপ-১, জার্মানির বার্লিনে) সদস্যদেশগুলোর প্রতিনিধিরা সম্মেলন করে আসছে। শুরুতে সদস্য দেশগুলোর প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীরা যোগ দিত। তবে স্বার্থের কারণে বড় অর্থনীতি এবং সর্বাধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এখন উপস্থিত থাকে না। প্রতি বছরই জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয় আশা জাগায়, অথচ শেষ পর্যন্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলে না।
সম্মেলনের মধ্যে ছিল ১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটোতে কপ-৩ সম্মেলন। যোগদানকারী দেশগুলো একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যেটাকে কিয়োটো প্রোটোকল বলা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, জলবায়ু-সংক্রান্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নে উন্নয়নশীল দেশগুলোর যে খরচ হবে, তার পুরো দায়ই বহন করবে উন্নত বিশ্ব।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কপ-২১ সম্মেলন ২০১৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬টি অংশগ্রহণকারী দেশ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যা প্যারিস চুক্তি নামে পরিচিত। চুক্তি অনুযায়ী, অংশগ্রহণকারী দেশগুলি শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রির নীচে আটকে রাখার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। এই চুক্তিতে ১৮৫০-১৯০০ সালকে ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়। আরও বলা হয়েছিল যে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন প্রায় ৪৩% কমাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-শূন্য কার্বন নির্গমন অর্জন। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য লড়াই করতে উন্নত দেশগুলোর বছরে ১০ কোটি ডলার অর্থসাহায্য দেওয়ার বিষয়টিও নির্দিষ্ট হয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালেই বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বিপদসীমা অতিক্রম করে। যা ছিল প্রায় ১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। যাকে রাষ্ট্রপুঞ্জ বলছে ‘ক্লাইমেট ব্রেকডাউন’। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’ বলছে, ১৮৮০ সাল থেকে তাপমাত্রার খতিয়ান রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত উষ্ণতম বছরটি ২০২৪-ই।
এমন অবস্থার মধ্যে ২০২৪ সালে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে হল কপ-২৯ সম্মেলন , যাকে বলা হয় ‘ফাইন্যান্স কপ’ বা ‘জলবায়ুর আর্থিক সম্মেলন’।
তীব্র বাদানুবাদ ও দর কষাকষির পর উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার (৩০০ বিলিয়ন ডলার) দেয়ার অঙ্গীকার করে ধনী দেশগুলো। ২০৩৫ সাল পর্যন্ত এ অর্থ দেওয়া হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছে এই অর্থ প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য।
বাকু সম্মেলনের বড় দুর্বলতা হচ্ছে, এই ত্রিশ হাজার কোটি ডলারের কত অংশ সরকারি আর কত অংশ বেসরকারি খাত থেকে আসাবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, উন্নত দেশগুলো বেসরকারি খাতের ঘাড়ে চাপাতে চায়। তবে, বেসরকারি খাতগুলো এসব ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী থাকে না, কারণ এতে লাভের মাত্রা কম। অন্য দিকে, বেসরকারি অর্থ আসে ঋণ হিসাবে, অনুদান হিসাবে নয়। উচ্চ সুদের হার ও কড়া শর্তাবলির কারণে ঋণের জালে বন্দি হয় দরিদ্র দেশগুলো।তাছাড়া, দেখা গেছে পূর্বের অধিকাংশ জলবায়ু তহবিল ও সাহায্যের অধিকাংশই এসেছে ঋণের মোড়কে।
কপ ২৯ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, জলবায়ু সংকটে চরম ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের চাহিদা বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার (১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা)। জলবায়ুর কারণে বার্ষিক ক্ষতি হচ্ছে ১২ বিলিয়ন ডলার। অথচ অনুদান হিসেবে বাংলাদেশ পাচ্ছে ৩৪০ থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার। এর বাইরে ঋণ পাচ্ছে অতিরিক্ত ২৫০ মিলিয়ন ডলার। এ থেকে জলবায়ু তহবিলের কিছুটা বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে।
অভিযোগ রয়েছে, বাকু সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানির বৈশ্বিক ব্যবহার কমিয়ে আনার ব্যাপারে যে চুক্তি হয়েছে তার ভাষা খুবই দুর্বল। উন্নত দেশগুলো কিয়োটো প্রোটোকলের উল্লিখিত ‘ঐতিহাসিক দায়’ থেকে সরে আসতে চায়। এমনকি প্যারিস চুক্তির অঙ্গীকারও ধুয়েমুছে সাফ করতে চায়। বাকু সম্মেলনে শিল্পোন্নত দেশগুলো বেসরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশ গুলোকেও আহ্বান জানানো হয়েছে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসার জন্য। বড় প্যাঁচটা এইখানেই। এত দিন যা ছিল তাদের একক ‘দায়িত্ব’।
গত তিনটি দশকে এটাই স্পষ্ট, উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। ২০২৪ সালের শেষে দেখা গেছে, পূর্বের প্রতিশ্রুত অর্থের কুড়ি শতাংশও তহবিলে জমা পড়েনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতির মাত্র ১৩.৬% দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেছে দু’লক্ষ কোটি ডলারেরও বেশি, কিন্তু লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে দিয়েছে মাত্র ১.৭৬ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিশ্বের ১০০টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যোগ দেন । ড. ইউনূস তার স্বপ্নের ‘থ্রি জিরো’ মডেলের কথা বললেও ক্ষমতাধর দেশগুলোর তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও ভারতের সরকার প্রধানগণ এই সম্মেলনে অনুপস্থিত ছিল । যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ছাড়া জি–২০ দেশের বড় নেতারা সবাই গরহাজির ছিল। অথচ জি-২০ জোটের দখলে বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৮০ শতাংশ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ। আর গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রায় ৮০ শতাংশই এই জোটভুক্ত দেশগুলো নির্গমন করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ডোনাল্ড ট্রাম্প পরিবেশবান্ধব জ্বালানিকে তিনি বরাবরই একটি ‘প্রতারণা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
এদিকে, বিশ্বজুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানির নিঃসরণ বাড়ছেই। কপ২৯ জলবায়ু সম্মেলনে প্রকাশিত গ্লোবাল কার্বন বাজেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে মোট কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ ৪১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মেট্রিক টনে পৌঁছায়, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১ বিলিয়ন বেশি। চীন ও ভারতের মত দেশে নিঃসরণ বেড়েই চলেছে।
২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ সমূহের মধ্যে রয়েছে। চীন ২৭.২ ভাগ, রাশিয়া ৪.৭ ভাগ, ভারত ৬.৮ ভাগ, জাপান ৩.৩ ভাগ, যুক্তরাষ্ট্র ১৪.৬ ভাগ, জার্মানি ২.২ ভাগ ও অনন্যা বিশ্ব ১৫.৮ ভাগ।
বর্তমান সময়ে উন্নত দেশগুলো দুষছে চীন ও ভারতকে, আর তারা দুষছে উন্নত দেশগুলোকে। চীন-ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর বক্তব্য- তাদের শিল্পায়নের ইতিহাস ৫০-৬০ বছরের আর উন্নত দেশগুলোর কয়েক শ’ বছরের। শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে পরিবেশের ‘১২টা বাজিয়ে’ উন্নয়ন করার পর এখন তারা বড়বড় কথা বলছে। অতএব, পরিবেশ বিপর্যয়ের দায় তাদেরই অধিক নিতে হবে।
উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোর ওপর এই পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর। পৃথিবীর মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্র শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ নিঃসরিত হয় বাংলাদেশে। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ।
কিছু দেশ নবায়নযোগ্য শক্তি, সৌরশক্তি-বায়ুশক্তি এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যবহারে অগ্রগতি দেখালেও, এক্ষেত্রে তেমন উন্নতি নেই। কিন্তু গোটা পৃথিবী যেখানে সামরিক খাতে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে, অথচ সবুজ শক্তিতে বিনিয়োগ তেমন নেই।
একাধিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গত দু’বছরে সবুজ শক্তিতে বিনিয়োগ কমেছে ২০ থেকে ২৫%. বিশ্বের বৃহত্তম ব্যাংকগুলো বেশি বিনিয়োগ করে চলেছে কয়লা এবং পেট্রলিয়ামের মতো জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যবসা করা সংস্থাগুলোতে।
এদিকে দাবদাহের কারণে কৃষি উৎপাদনব্যবস্থার সর্বনাশ! প্রচণ্ড গরম ডেইরি ও পোলট্রি খাতে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন খাদ্য অনিশ্চয়তার শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, ধান চাষের জন্য ১৮ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন। সেখানে ৪২/৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুধু ধান নয়, অন্যান্য ফসল ও কৃষির সর্বনাশ হতে চলেছে। অতিরিক্ত গরমে বোরো ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে। সার্বক্ষণিক সেচের পানি দিতে গিয়ে কৃষকদের বোরো ধান উৎপাদনে বাড়তি খরচ বেড়ে চলেছে।এদিকে দ্য লান্সেট প্লানেটারি হেলথ জার্নালে প্রকাশিত কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রাবৃদ্ধির কারণে বদলে যাচ্ছে ভূমি-রসায়ন, যার কারণে ধান বা চালের দানায় বাড়তে পারে আর্সেনিকের মাত্রা। বেশি মাত্রার আর্সেনিকযুক্ত চাল/ভাত খাওয়ার অভ্যাসে ক্যানসারের আশঙ্কা বেড়ে যাবে বহু গুণ।
দাবদাহে অতিষ্ঠ মানুষ ও প্রাণীকুল। কৃষি, নির্মাণ, পরিবহন খাতের মতো বাইরে কাজ করা কর্মীরা অতিরিক্ত গরমের কারণে মৃত্যু ও নানা ঝুঁকিতে পড়ছে। হিটস্ট্রেস, হিটস্ট্রোক, হিটক্র্যাম্পস, র্যাশ, ত্বকে ক্যানসার, হৃদরোগ, শ্বাসজনিত অসুস্থতা, কিডনির রোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েই চলেছে। অন্তঃসত্ত্বা নারীরা নানা জটিলতায় পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত দেশগুলোর আশায় অপেক্ষা না করে তীব্রতার মাত্রা কমানো ও খাপ খাওয়ানোর জন্য নিজেদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও সক্রিয় হতে হবে ও জীবনযাত্রায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা সবাই বলছি ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। কিন্তু কে লাগাবে আর কে বাঁচাবে সেটা একটা প্রশ্নের বিষয়। বিষয়টি এমন, পলিথিন খুবই ক্ষতিকর এবং আমরা সবাই পলিথিনের বিপক্ষে কথা বলি; অথচ দেশে পলিথিন উৎপাদন হচ্ছে এবং আমরা সবাই ব্যবহার করছি। ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ থেকে আমাদের গুরুত্বের বিষয়টি ফুটে ওঠে।
জলবায়ুর এই পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যদ্বাণী নয়, বাস্তবতা। চাইলেই হঠাৎ করে বা রাতারাতি উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। তবে কাজ করলে, পদক্ষেপ নিলে সবই ব্যর্থ হবে এমনও নয়। । খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০-এ গ্রিক দার্শনিক জেনো বলেছিলেন, “জীবনের লক্ষ্যই হল প্রকৃতির সঙ্গে চুক্তি করে জীবনযাপন করা। যেমনটা সম্ভব করেছে ভুটান, পানামা, সুরিনাম ও মাদাগাস্কার। এই চার দেশে যতটুকু কার্বন নিঃসরণ হয়, তা দূষণমাত্রার চেয়ে খুবই কম
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর ভবিষ্যৎ বাণী আছে উষ্ণায়নের কারণে আগামী ৬০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে কোন প্রাণ ও উদ্ভিদ টিকে থাকতে পারবে না। এটি একটি বিরান গ্রহে পরিণত হবে । তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা না গেলে, পৃথিবী ‘একটি বিশাল আগুনের গোলা’ হয়ে যেতে পারে। আমরা যেন সেই দিকে যাই সেটাই হোক বিশ্ব পরিবেশ দিবসের অঙ্গীকার।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
ঢাকা/রাসেল
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর য ক তর ষ ট র ক র বন ড ই ২০২৪ স ল স লস য় স ক র বন ন ব সরক র ব যবহ র জলব য় র র জন য আম দ র ব শ বব পর ব শ প রক ত বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
আলোচিত ছাগলটি এখন কোথায়
বলছি মতিউরের সেই ছাগলের কথা। বাদামি গায়ে ছোপ ছোপ দাগ, আকারে বেশ বড়। ২০২৪ সালে পবিত্র ঈদুল আজহায় সবচেয়ে আলোচিত ছিল এই ছাগল।
যাঁরা ভুলে গেছেন, তাঁদের মনে করিয়ে দিই, ২০২৪ সালের পবিত্র ঈদুল আজহার আগে সাদিক অ্যাগ্রো থেকে ছাগলটি কেনেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তৎকালীন সদস্য মতিউর রহমানের দ্বিতীয় ঘরের সন্তান মুশফিকুর রহমান (ইফাত)। সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন তখন ছাগলটির দাম নেন ১৫ লাখ টাকা।
মতিউরের ছেলে মুশফিকুর ছাগলটির সঙ্গে একটি সেলফি তুলে ফেসবুকে দেন। সে–ই শুরু। নেটিজেন ও পরে সাংবাদিকেরা বের করে ফেলেন, এই ছাগলের ক্রেতা এনবিআরের একজন কর্মকর্তার ছেলে। একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলে কীভাবে এত দাম দিয়ে একটি ছাগল কেনেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মতিউর দাবি করেন, ছাগলের ক্রেতা তাঁর ছেলে নন। পরে অবশ্য অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, মতিউরের আরেক স্ত্রী আছেন। সেই ঘরের সন্তান ছাগলের ক্রেতা মুশফিকুর।
‘ছাগল-কাণ্ডে’ আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মতিউর রহমান এখন কারাগারে