এখনও পাহাড়ের নিচে বাস ২০ সহস্রাধিক মানুষের
Published: 12th, June 2025 GMT
২০১৭ সালের ১৩ জুনের ভয়াবহ পাহাড় ধসের দৃশ্য এখনও চোখে ভেসে উঠলে শিউরে উঠি। এখনও আমার ঘরের আশপাশে সেই পাহাড় ধসের চিহ্ন রয়ে গেছে। তাই অল্প বৃষ্টি হলেই আতঙ্কে থাকি, আশ্রয়কেন্দ্র খুঁজি। কিন্তু আমরা অসহায় ও গরিব, যেখানে পেটের ভাত জোগাতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে নিরাপদ ভাড়া বাসায় থাকার সামর্থ্য কোথায়? তাই মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই পাহাড়ের নিচে বসবাস করছি।
কথাগুলো বলছিলেন রাঙামাটি শহরের ভেদভেদীর লোকনাথ মন্দিরের পাশে সিএনবির পাশে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা পঞ্চাশোর্ধ্ব নূরজাহান। শুধু নূরজাহান নন, রূপনগর, মুসলিমপাড়া, শিমুলতলী, লোকনাথ মন্দির এলাকা, রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন নিচু এলাকা, কিনারাম পাড়াসহ শহরের অন্তত ২৯টি স্থানে ২০ হাজারের বেশি নিম্ন আয়ের মানুষ মারাত্মক ঝুঁকি জেনেও বসবাস করছে পাহাড়ের পাদদেশে। একটু ভারী বৃষ্টি এলেই সবার স্মৃতিতে ফিরে আসে, ২০১৭ সালের এ দিনে শহরে পাহাড় ধসে মাটিচাপা পড়ে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু পুনর্বাসন না হওয়ায় পাহাড়ের নিচে বসবাস বন্ধ হয় না। উল্টো দিন দিন বাড়ে।
এমন অবস্থায় আজ শুক্রবার ২০১৭ সালেই সেই ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনার আট বছর পূর্ণ হলো। ২০১৭ সালের ১৩ জুন ভারী বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধসে রাঙামাটি শহরের ভেদভেদীর যুব উন্নয়ন বোর্ড এলাকা, মুসলিমপাড়া, শিমুলতলী, রূপনগর, সাপছড়ি, মগবান, বালুখালী, জুরাছড়ি, কাপ্তাই, কাউখালী ও বিলাইছড়ি এলাকায় ৫ সেনা সদস্যসহ ১২০ জনের মৃত্যু হয়। মানিকছড়িতে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের ওপর থেকে মাটি সরাতে গিয়ে ৫ সেনা সদস্য পাহাড় ধসে মাটিচাপা পড়েন। ওই সময় পাহাড় ধসে জেলায় ১৬০০ থেকে ১৭০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সারাদেশের সঙ্গে রাঙামাটির সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল এক সপ্তাহ। দীর্ঘ তিন মাসের বেশি সময় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার পর ক্ষতিগ্রস্তরা নিজেদের জায়গায় ফিরে যায়। এ ছাড়া ২০১৮ সালে নানিয়ারচর উপজেলায় পাহাড় ধসে দুই শিশুসহ ১১ জন এবং ২০১৯ সালের কাপ্তাইয়ে ৩ জনের প্রাণহানি ঘটে।
২০১৭ সালের সেই পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল ও বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পরও ঝুঁকিতে থাকা লোকজনদের পুনর্বাসন করতে পারেনি প্রশাসন। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে মাইকিং করেই দায় সারে তারা। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে স্থাপনা নির্মাণ না করতে মাঝেমধ্যে নিষেধাজ্ঞাও জারি হয়। কিন্তু এই সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান আজও হয়নি।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, রাঙামাটি পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে শিমুলতলী, রূপনগর, লোকমন্দির পাড়া, পোস্ট অফিস কলোনি এলাকা, নতুনপাড়া, বিদ্যানগর, কিনারামপাড়া, সিলেটি পাড়াসহ অন্তত ২৯টি স্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া নানিয়ারচর, কাউখালীসহ কয়েকটি উপজেলায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে। এসব এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে এখনও ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন ২০ হাজারের বেশি মানুষ।
গতকাল বৃহস্পতিবার রূপনগর, লোকনাথ মন্দির, মুসলিমপাড়া এলাকায় সরেজমিন দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ওই পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। কথা হয় রূপনগর এলাকার বাসিন্দা সমলা আক্তার, কমলা বেগম, আব্দুল মান্নান ও শাহানা বেগমের সঙ্গে। তারা জানান, ভারী বৃষ্টি হলেই ভয় লাগে। কিন্তু তাদের যাওয়ার কোথাও জায়গা নেই। বেশি বৃষ্টি হলে জেলা প্রশাসন থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য বলা হয়। কিন্তু সম্পদ হারানোর ভয়ে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে চায় না।
তারা আরও জানান, সবাই চায় ভালো ও নিরাপদ স্থানে বসবাস করতে। তাই সরকার যদি তাদের পুনর্বাসন করে তাদের জন্য ভালো হয়।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ বলেন, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের পুনর্বাসন চলমান প্রক্রিয়া। তবে এ ক্ষেত্রে জটিলতা হচ্ছে, যেখান থেকে মানুষজনদের সরিয়ে নেওয়া হয়, সেখানে আবারও নতুন লোকজন বসবাস শুরু করে। এসব এলাকায় লোকজন কম টাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছে। তা ছাড়া পাহাড়ে ভূমি জটিলতা থাকার কারণে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বা পাহাড়ের ঢালুতে মানুষ বসবাস করছে। যারা অবৈধভাবে বসবাস করছে তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নেওয়া হচ্ছে আইনি ব্যবস্থাও। তবে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস বন্ধ করতে সচেতনতা সৃষ্টি জরুরি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ২০১৭ স ল র বসব স করছ প হ ড় ধস র পনগর এল ক য়
এছাড়াও পড়ুন:
শতবর্ষী বিষাদ
আইসক্রিম
জ্ঞান ফেরার পর তার নাকে আসে আইসক্রিমের ঘ্রাণ। বাতাসের শরীর থেকে তখনও মুছে যায়নি বারুদের তীব্র-ঝাঁঝালো গন্ধ। কল্পনায় দেখতে পায় জুলাইয়ের কাঠফাটা রোদে একটি সফেদ মখমল নরম আইসক্রিম থেকে সুস্বাদু দুধ গলে পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। তার সমস্ত শরীর চনমন করে ওঠে। মন কল্পনায় দেখা আইসক্রিমের নাগাল পেতে চায়, জিভ বাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে। মুখের ভেতর সে তার জিহ্বার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে না। হয়তো সেটি অসাড় হয়ে সেঁটে আছে মুখগহ্বরের উপরিভাগের তালুর সঙ্গে; নাকি কেউ কেটে নিয়ে গেছে?
এমন ভয়াবহ আশঙ্কার কথা ভেবে কল্পনার ভেতরেও সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আইসক্রিমের ঘ্রাণ ক্রমেই তীব্র হয়, সে টের পায় শুষ্ক ঠোঁট জোড়ায় কিছুটা অনুভূতি যেন ফিরে আসতে শুরু করেছে। সে আবার জোর প্রচেষ্টা চালায় জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট দুটো চাটতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তাকে মেনে নিতে হয় খানিক আগে করা আশঙ্কার কথা। ঢোক গেলার চেষ্টা করতেই তার সারাশরীরে একটা যেন ইলেকট্রিক শক বয়ে যায়। তার মনে হয় কণ্ঠনালি থেকে পাকস্থলী বরাবর নেমে যাচ্ছে তরল আগুনের স্রোত। সে অনুভব করতে পারে পিঠের মাংসপেশি ফুঁড়ে গরম কিছু একটা যেন তার শরীরে ঢোকার চেষ্টা করছে। এবার সে সহজেই অনুমান করে নিতে পারে যে সে চিৎ হয়ে পড়ে আছে কোথাও, সম্ভবত কোনো রাস্তার ওপর। সে হাত-পা নাড়াতে গিয়ে দেখে সেখানে কোনো প্রকার অনুভূতি নেই। সম্ভবত জিহ্বার সাথে তার হাত-পাগুলোও কেটে ফেলা হয়েছে। নিজেকে জড় বস্তুর মতো এক তাল মাংসপিণ্ড ভাবতেই তাকে ঘিরে ধরে ভয়াবহ এক প্রকার অসহায়ত্ব। কিন্তু কেন? কীভাবে? এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর সে খুঁজে পায় না। স্মৃতিরাও যেন অসাড় হয়ে গেছে হাত-পা ও জিহ্বার মতো। এই এপিসোডটা বেশ খানিকক্ষণ চলার পর তার শরীর আবারও কিছু সময়ের জন্য অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ে। কেবল আইসক্রিমের ঘ্রাণটা সে এখনও টের পায়। এই ঘ্রাণ তাকে শান্তি দেয় কিছুটা। কল্পনায় আবারও ফিরে আসে আইসক্রিম থেকে দুধ গলে পড়ার দৃশ্য। তবে এবার এই দৃশ্যের সাথে যুক্ত হয় আরেকটি দৃশ্য। এটা অনেকগুলো শিশুর হাসিমুখের দৃশ্য। তারা দাঁড়িয়ে আছে গোল হয়ে। তাদের প্রত্যেকের হাতে ধরা আইসক্রিম। তারা খুশিমনে আইসক্রিম খাচ্ছে। হঠাৎই তার শ্রবণেন্দ্রিয় সচল হয়ে ওঠে। সে শুনতে পায় একযোগে অনেকগুলো গুলির শব্দ। দলবেঁধে পাখিরা উড়ে যায় কোথাও। সে শুনতে পায় তাদের আতঙ্কিত ডানা ঝাপটানোর শব্দ। কল্পনা থেকে শিশুদের দৃশ্য মিলিয়ে যায়। সে এবার দেখতে পায় আইসক্রিমের রং লাল এবং সেখান থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে রক্ত। ভয়ংকর রকমের জলতেষ্টায় তার বুক ফেটে যাবার উপক্রম হয়। এবার সে দেখতে পায় নিজেকে। অজস্র মানুষের সাথে সে মিছিলে স্লোগান তুলছে।
সে দেখতে পায় শহর দখল নিয়েছে জলকামান, টিয়ার গ্যাসের অন্ধকার, বুলেটের শব্দ ও মানুষের আর্তচিৎকার। এরপর সে দেখে নিজেকে ঠিক এখনকার মতোই চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে এক ট্যাঙ্কের ওপর। ট্যাঙ্কটি তাকে নিয়ে প্রদক্ষিণ করছে শহরময়। তারপর সে টের পায় কয়েকজন মিলে তাকে ট্যাঙ্কের ওপর থেকে ছুড়ে দিয়েছে শূন্যে। তার মনে হয় তার শরীর ভাসছে হাওয়ায়, পাখিদের সাথে। তারপর হঠাৎই আবার সমস্ত শব্দ, দৃশ্য মিলিয়ে গিয়ে ফিরে আসে অন্ধকার, আইসক্রিমের ঘ্রাণ। একবার তার মনে হয়, সে বোধহয় মরে গেছে? কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারে না, কেননা মৃত মানুষের ঘ্রাণেন্দ্রিয় সচল থাকবার কথা নয়। খানিক পর সে শুনতে পায় বহুদূর থেকে ভেসে আসছে পিতলের টুনটুন ঘণ্টাধ্বনি। শব্দটা বেশ মৃদু-মোলায়েম এবং তা ক্রমেই তার দিকে এগিয়ে আসছে। চোখের পাতাটা আপনাআপনিই প্রথম ও শেষবারের মতো খুলে যায়।
সে দেখতে পায় রাস্তা আটকে রাখা সারি সারি জলপাই রঙের ট্যাঙ্কের পাশ দিয়ে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে তার দিকে এগিয়ে আসছে একটি রঙিন আইসক্রিম ভ্যান।
শতবর্ষী গাছ
শতবর্ষী গাছটা মৃত মানুষের মতো একলা পড়ে আছে সড়কের এক ধারে, ফসলশূন্য জমিটার ওপর। তার সতেজ শাখা-প্রশাখা ও সবুজ পত্রপল্লবে এখনও স্পষ্ট জীবনের চিহ্ন। মাটির বাঁধন থেকে আলগা হয়ে পড়া শেকড়টা মুখ করে আছে আকাশের দিকে। মুহূর্তের ভেতর আশ্রয় হারিয়ে ফেলা পাখিরা সব আপাতত আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী গাছগুলোতে, যা তাদের জন্য যথেষ্ট নয়।
এই দুর্ঘটনা ঘটেছে গতরাতে। আর আজ সকাল থেকে শুরু হয়েছে বিরামহীন বৃষ্টি। দুপুর পেরিয়ে এখন সন্ধে নেমেছে। এই বৃষ্টিপাত এখনও থামেনি। মনে হচ্ছে বৃষ্টিটা যেন আজ এই গাছটারই মৃত্যুর শোক পালন করছে। তবুও এই বিরামহীন বৃষ্টি-জল মাথায় করে একে একে গ্রামের প্রায় সকলেই গাছটিকে দেখে গেছে। এই ঘটনা কম-বেশি ভারাক্রান্ত করে তুলেছে গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সবাইকেই। প্রতি বর্ষাকালেই এই গ্রামটা সাধারণত জলবন্দি হয়ে পড়ে। মাসের হিসাবে বর্ষাকাল নামতে এখনও দিন পনেরো বাকি। অথচ আজ থেকেই যেন জলবন্দি দশার শুরু। এই তুমুল বৃষ্টি-বাদলের ভেতরও গ্রামপ্রধানের দহলিজে জড়ো হয়েছে মানুষ। অন্যান্য দিনের মতো সংখ্যায় যদিও কম, তবুও মাথা গুনলে অন্তত ৩০-৪০ জন হবে।
এদের বেশির ভাগই বয়স্ক এবং তারা এখানে বসবাস করছে গ্রাম পত্তনের শুরু থেকেই। শুরু থেকেই তারা গাছটাকে দেখেছে ফলবান ও পরিণত অবস্থায়। এই গ্রামের অধিবাসীরা গাছটির যে বয়স নির্ধারণ করেছে, মূলত গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণতম অধিবাসীর বয়সের সাপেক্ষে।
সেদিক দিয়ে হিসাব করলে এ গাছই এ গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণতম অধিবাসী। এ মুহূর্তে তারা প্রত্যেকেই কথা বলছে এই গাছ বিষয়েই। তাদের সবার চোখ-মুখে স্পষ্ট সংশয়, আসন্ন কোনো অশুভ ঘটনার ইঙ্গিত।
যুগ যুগ ধরে ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলে ওঠে গাছটা যে এমন ঝড়বৃষ্টি ছাড়া আপনাআপনিই উপড়ে যাবে– এটা তাদের সবার কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকছে। তার মানে নিশ্চিত কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তাদের কথাবার্তায় সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কা ছাড়াও উঠে আসছে গাছবিষয়ক নানা স্মৃতিচারণা। গাছটিকে তারা তাদের প্রচলিত রীতি মেনে পূজা না করলেও এক প্রকার সমীহ করে। গ্রাম উন্নয়নের বিবিধ কাজের প্রয়োজনে গাছটি কেটে ফেলবার অসংখ্য উপলক্ষ তৈরি হলেও গ্রামবাসী একযোগে সেসব প্রতিহত করে গাছটির সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। এই বিশেষ গাছটার ফলের ওপর গ্রামবাসী সকলেরই সমান অধিকার। বহুকাল ধরেই এমন রীতিই চলে আসছে। তাদের এই মুহূর্তের স্মৃতিচারণায় যুগ যুগ ধরে গাছটাকে ঘিরে তৈরি হওয়া অনেক গল্প উঠে আসছে। গাছটা উপড়ে পড়বার পর থেকে তাদের সবারই মানসিক অবস্থা এখন সেইসব নীড়হারা পাখিদের মতো। এখানে তারা বহুক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করছে এই ব্যাপারে গ্রামপ্রধানের বিজ্ঞ মতামতের। তিনি এখনও দহলিজে এসে পৌঁছাননি। ভেতর থেকে ইতোমধ্যেই একজন এসে খবর দিয়ে গেছে যে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি আপাতত বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাঁর আসতে খানিকটা বিলম্ব হবে। তাঁর বিলম্বকে কেন্দ্র করে উপস্থিত সবার ভেতর অস্বস্তি ও চাপা উত্তেজনা বাড়ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি কিছুটা ধরে এলে অবশেষে তিনি এসে পৌঁছান। সবাই তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে উৎসুক ভঙ্গিতে। সবার মুখে একই কথা– ‘মুরুব্বি গাছটা তো চইলে গেলো, আমাগের এহুন কি হবি সরকার?’ গ্রামপ্রধান অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর ফয়সালা দেবার মতো করে উপস্থিত সবার উদ্দেশে বলেন– ‘এহুন কিছু কইরে আর লাভ হবি না। মরা গাছ কি আর বাঁচানির ক্ষমতা তুমাগের আছে? ক্যা সেই পদ্য শোনো নাই, সন্তানের পাপে, মরে মায় বাপে?’ এটুকু বলেই তিনি থামেন। তারপর বাইরের তুমুল বৃষ্টির দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে বলেন, ‘তুমরা মইরে শ্যাষ না হওয়া তোক এই বিষ্টি থামবি নে।’ উপস্থিত সবাই মনে মনে গ্রামপ্রধানের কথা অবিশ্বাস করতে চায়, কিন্তু পারে না। তাদের প্রত্যেকের চোখেমুখে ফুটে ওঠে ভয়াবহ আতঙ্কের ছাপ। বৃষ্টি বাড়ে, একটু পরপর বাজ পড়ে আকাশ কাঁপিয়ে। v