শিক্ষার উন্নতির সঙ্গে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই খাতে বাজেট বরাদ্দের দিকে শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদসহ অনেকেরই নজর থাকে। আগের বছরের তুলনায় বরাদ্দ কতটুকু বাড়ল বা কমল, সেটা খেয়াল করে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মতামতও দিয়ে থাকে। তবে মুশকিল হলো, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ালেই যে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে, ব্যাপারটি মোটেও এ রকম সরল নয়।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, শিক্ষার সঙ্গে কর্মসংস্থানেরও সম্পর্ক আছে। দেশে বিপুল জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে, যাঁরা উচ্চশিক্ষিত; কিন্তু তাঁদের শিক্ষার সুফল থেকে রাষ্ট্র বঞ্চিত রয়ে যাচ্ছে। চাকরির পেছনে ছুটতে গিয়ে তরুণদের অধিকাংশই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় হারিয়ে ফেলছেন। মানতেই হবে, সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিকল্পনায় বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে। কেবল চাকরির পরীক্ষা নিয়মিত করা আর চাকরিপ্রার্থীদের আবেদনের বয়স বাড়ালেই আসল সমস্যার সমাধান হবে না। 

প্রতিবছরই বাজেট ঘোষণার আগে-পরে বিভিন্ন মহল থেকে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি তোলা হয়। কিন্তু বলা হয় না, এই বাড়তি বরাদ্দ কোন খাতে কীভাবে ব্যয় করা হবে। সাধারণত আগের বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাবের ভিত্তিতে পরবর্তী বছরের প্রাক্কলন আয়-ব্যয় নির্ধারিত হয়। নতুন পরিকল্পনা ও প্রকল্প থাকলে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে সুবিবেচনাপ্রসূত পরিকল্পনা ও প্রকল্পের ঘাটতি রয়েছে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট ৯৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি মোট জাতীয় বাজেটের ১২ শতাংশের মতো। আগের বছরগুলোতেও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ১২ শতাংশ পার হয়নি। বরাদ্দের একটা অংশ যায় শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ, আরেকটি অংশ যায় অবকাঠামোগত নির্মাণ ও সংস্কারকাজে। কিন্তু শিক্ষার প্রকৃত উন্নতির সঙ্গে এই দুইয়ের সম্পর্ক পরোক্ষ।

যেসব খাতে বরাদ্দের সঙ্গে শিক্ষার মান বৃদ্ধির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, সেসব খাতে বরাদ্দ থাকে সীমিত। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং শিখনসামগ্রী তৈরির জন্য খুবই অল্প টাকা বরাদ্দ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রকাশনা ও উচ্চতর গবেষণাকাজেও বরাদ্দ থাকে কম। ফলে মেধাবী শিক্ষকদের বড় অংশ এসব কাজে আগ্রহবোধ করেন না। যাঁরা কাজ করেন, তাঁরাও দায়সারাভাবে সারতে চান। 

শিক্ষার সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্পর্ক রয়েছে, অথচ এই সম্পর্কের পথরেখাটি স্পষ্ট করে আমরা দেখাতে পারিনি। ফলে বাজেটে শিক্ষা খাত অবহেলিত রয়ে যাচ্ছে। এর দায় যতটুকু না অর্থনীতিবিদদের, তার চেয়ে বেশি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের।

শিক্ষাক্ষেত্রে গাফিলতি আর অব্যবস্থাপনার নমুনা হামেশা সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন—এসব ক্ষেত্রে অনিয়ম এখন অস্বাভাবিক বা অনিয়মিত কোনো ঘটনা নয়। ভুলে ভরা, খারাপ কাগজ-কালিতে ছাপা বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে আমাদের দ্বিধা হয় না। আবার বরাদ্দের বিপুল অংশ আমরা নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয় করছি, যেখানে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান বাড়ানোর দিকে কোনো নজর নেই। 

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার সংস্কার ও মান উন্নয়নে কমিশন গঠনের প্রস্তাব বারবার এসেছে। কমিশন গঠন করা যায় কি না, গঠন করলে এর কার্যপরিধি ও কার্যধারা কী বা কতটুকু হবে, এসব নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে। কারণ, শিক্ষাব্যবস্থায় এমন কিছু সমস্যা রয়েছে, যেগুলো ঠিকমতো চিহ্নিত হয়নি কিংবা বিবেচনায় আনা হয়নি। এগুলো চিহ্নিত করে এবং বিবেচনায় নিয়েই শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজাতে হবে। 

শিক্ষাবিদেরা বরাবরই বলছেন, শিক্ষকদের প্রাইভেট আর কোচিংমুখী প্রবণতা শিক্ষাক্ষেত্রে ধস নামিয়েছে। বাজারের গাইড বইও বাড়তি কোনো ফল দেয়নি। এরপরও শিক্ষার্থীরা কেন কোচিং আর গাইড ছাড়া পড়াশোনা করতে পারে না, সে প্রশ্নের উত্তর শিক্ষকদেরই দিতে হবে।

আধুনিক প্রযুক্তি পাঠদানের পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে পারত। তবু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা এখনো কেন আধুনিকায়ন করা গেল না, সেটিও একটি প্রশ্ন। উচ্চতর গবেষণাক্ষেত্রে আমরা কেন পিছিয়ে আছি, কেন শিক্ষিত বেকার বাড়ছে, কেন মেধাবীরা শিক্ষকতায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন—এ রকম অজস্র প্রশ্ন রয়েছে, যেগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। 

লক্ষ করলে দেখা যায়, শিক্ষা ধীরে ধীরে দামি ‘পণ্যে’ পরিণত হয়েছে। বাজেটের বরাদ্দ দরিদ্র অভিভাবক কিংবা মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা দেয়নি। সার্টিফিকেট-নির্ভর শিক্ষা আমাদেরকে ‘উচ্চশিক্ষিত’ করেছে, কিন্তু বাজার-উপযোগী করে দক্ষ ও যোগ্য করে তোলেনি। মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখন দেশ ছেড়ে ভিনদেশে চাকরি ও গবেষণায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এসব সংকট থেকে উত্তরণের জন্য মৌলিক ও অভিনব কোনো কর্মপন্থাই আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি। বাজেটেও তার কোনো দিকনির্দেশনা থাকে না।

শিক্ষার সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্পর্ক রয়েছে, অথচ এই সম্পর্কের পথরেখাটি স্পষ্ট করে আমরা দেখাতে পারিনি। ফলে বাজেটে শিক্ষা খাত অবহেলিত রয়ে
যাচ্ছে। এর দায় যতটুকু না অর্থনীতিবিদদের, তার চেয়ে বেশি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের। শিক্ষার উন্নতি যদি চাইতেই হয়, তবে বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে বিবেচনায় নিয়েই কাজ করতে হবে। শিক্ষার রূপান্তরকে অর্থনৈতিক রূপান্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে না পারলে বরাদ্দ বাড়িয়ে লাভ হবে না। 

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ক ষ ব যবস থ শ বব দ য ল ব শ বব দ য বর দ দ র ষ ট কর

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানে নিরাপদে আছেন ৬৬ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। হামলায় ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের তথ্য সামনে আসছে। অবশ্য এই অবস্থায় ইরানে ৬৬ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী নিরাপদে আছেন বলে জানিয়েছেন তেহরানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা ওয়ালিদ ইসলাম।

শনিবার (১৪ জুন) তিনি ফেসবুকে এই তথ্য জানান।

কনসুলার ওয়ালিদ ইসলাম লিখেছেন, “বিভিন্ন গ্রুপে যারা ইরানে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন তাদের জন্য বলছি যে, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা তেহরানে পাঁচজন, কারাজে একজন, গোরগানে আটজন, কোমে ৫০ জন (কিছু কমেছে বর্তমানে), একজন ইসফহানে এবং একজন মাত্র মাসাদে লেখাপড়া করছেন। তাদের সবার সঙ্গেই আমার যোগাযোগ হচ্ছে। তারা সবাই ভালো আছেন।”

আরো পড়ুন:

আড়াইহাজারে জামায়াতের পথসভায় বিএনপির হামলা, আহত ৫

কাছারি বাড়িতে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার ২

তিনি জানান, সেখানে কোন বাংলাদেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সবাইকে ধৈর্য ধারণের অনুরোধ করেছেন তিনি।

শুক্রবার ভোরে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালায় ইসরায়েল। ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের ছয় বিজ্ঞানীসহ ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। এসব হামলায় অন্তত ৩২০ জন আহত হয়েছেন।   

এদিকে ইরানের পাল্টা হামলায় তিনজন ইসরায়েলি মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ৬০ জনেরও বেশি।

শনিবার রাতভর পাল্টাপাল্টি হামলায় উভয় দেশে হতাহতের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

ঢাকা/হাসান/রাসেল

সম্পর্কিত নিবন্ধ