বান্দরবানে ৯ বছরে ২৬ পর্যটকের মৃত্যু
Published: 17th, June 2025 GMT
বান্দরবান ভ্রমণে এসে গত ৯ বছরে ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। সবশেষ গত বুধবার পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছেন তিন পর্যটক। অধিকাংশ পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে বর্ষা মৌসুমে ঝিরি-ঝরনা থেকে পড়ে; পাহাড়ি ঢলে ও নদীতে গোসলে নেমে। সড়ক দুর্ঘটনায়ও মারা গেছেন তিনজন। পাহাড় সম্পর্কে ধারণা না থাকা ও নিয়মকানুন মেনে না চলাই এসব মৃত্যুর কারণ বলে পুলিশ ও পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
পর্যটনশিল্প–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, জুন থেকে সেপ্টেম্বরে, অর্থাৎ ভরা বর্ষায় সবচেয়ে বেশি পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গত ৯ বছরে এই চার মাসেই পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভেসে গিয়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুকনা মৌসুমে নদী-খাল ও বগালেকে গোসলে নেমে ১০ জন এবং সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তিনজন। তাঁদের প্রায় সবাই কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী। প্রবল বৃষ্টি ও প্রতিকূল আবহাওয়ায় আটকে পড়ে স্থানীয়দের সহযোগিতায় বেঁচে ফিরেছেন অনেক পর্যটক। ২০১৯ সালের আগস্টে থানচি উপজেলার দুর্গম জিন্নাহপাড়ায় ১৬ জন তরুণ-তরুণী প্রায় এক সপ্তাহ আটকে পড়েছিলেন। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় তাঁরা ফিরে আসেন।
সবচেয়ে বেশি ১০ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে রুমা উপজেলায়। উপজেলাভিত্তিক প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ২৯ জুন পাইন্দু ইউনিয়নের তিনের সাইথার ঝরনায় পাহাড়ি ঢলে নৌবাহিনীর সাব লেফটেন্যান্ট সাইফুল্লাহ ও একজন কলেজছাত্রী ভেসে যান। দুই দিন পর তাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ওই একই ঝরনায় মারা যান আরেকজন পর্যটক। ২০১৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রিজুক ঝরনায় ডুবে বগুড়া আজিজুল হক কলেজের একজন অধ্যাপকের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালে বগালেকে ও ২০১৮ সালে সাঙ্গু নদে গোসলে নেমে চারজনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া গত ২০ জানুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় রুমায় কেওক্রাডং পাহাড়ে একটি নারী পর্যটক দলের দুজন ও থানচিতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালে একজন ও ২০১৮ সালে একজনের মৃত্যু হয়েছে নাফাখুমের পাহাড়ি ঢলে।
শুষ্ক মৌসুমে পাহাড় নিরীহ। কিন্তু বর্ষাকালে পদে পদে বিপদ। বান্দরবানের ৮০ শতাংশের বেশি পাহাড় খাড়া প্রকৃতির। বৃষ্টিতে ধস নামার আশঙ্কা যেমন থাকে, তেমনি ঝিরি–ঝরনা পাহাড়ি ঢলে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। বৃষ্টি কমে গেলে আধঘণ্টার কম সময়ে আবার শান্ত হয়ে যায়।মাহবুবুল ইসলাম, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট২০২৩ সালে ১২ আগস্ট আলীকদমে মারা যান আতাহার ইসলাম নামের একজন। তিনি ট্যুর এক্সপার্ট নামে পর্যটন দল পরিচালনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর সংস্থাটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন তাঁর স্ত্রী বর্ষা ইসলাম। গত সপ্তাহে ওই সংস্থার ব্যবস্থাপনায় ক্রিস্টং ও রংরাং পাহাড় ভ্রমণে যাওয়া তিন পর্যটক পাহাড়ি ঢলে ভেসে গিয়ে মারা যান। এ ঘটনায় বর্ষা ইসলামকে গ্রেপ্তার করলেও তিনি এখন জামিনে রয়েছেন। গত সপ্তাহে রোয়াংছড়িতে চারজন ও বান্দরবান সদর উপজেলায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। একজনের লাশ এখনো পাওয়া যায়নি।
রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো.
পাহাড়ে পর্যটক অপহরণ, ছিনতাই, যৌন সহিংসতার ঘটনা খুব একটা ঘটে না বলে অভিমত পুলিশ কর্মকর্তাদের। পুলিশ জানায়, গত ৯ বছরে জেলা শহরের দুটি, রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচিতে তিনটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। আবাসিক হোটেলে সঙ্গী পর্যটক কর্তৃক নারীর ওপর সহিংসতা হয়েছে দুটি। সহিংসতার শিকার এক তরুণীর মৃত্যু হয়েছে।
আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মুমিন জানিয়েছেন, উপজেলা সদরে পর্যটনসেবাকেন্দ্র রয়েছে। সেখানে প্রত্যেক পর্যটকের নাম, ঠিকানা, কোন সময়ে কোথায় যাবেন, থাকবেন ও কোন ট্যুরিস্ট গাইডের সঙ্গে যাবেন—সবকিছু লিপিবদ্ধ থাকে। প্রতি ১০ জনের দলে ১ জন নিবন্ধিত ট্যুরিস্ট গাইড নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। প্রশাসনের এ নিয়ম মেনে চললে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু কিছু সংস্থা বেশি লাভের জন্য নিয়মকানুন না মেনে গোপনে পর্যটকদের দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে যান। তাঁদের সঙ্গে কোনো ট্যুরিস্ট গাইড থাকেন না। দুর্ঘটনার প্রবণতা কমাতে হলে নিয়মের মধ্যে ভ্রমণ করতে হবে।
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়, পাহাড়ি ভূমি ও জলধারা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে পাহাড় নিরীহ। কিন্তু বর্ষাকালে পদে পদে বিপদ। বান্দরবানের ৮০ শতাংশের বেশি পাহাড় খাড়া প্রকৃতির। বৃষ্টিতে ধস নামার আশঙ্কা যেমন থাকে, তেমনি ঝিরি–ঝরনা পাহাড়ি ঢলে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। বৃষ্টি কমে গেলে আধঘণ্টার কম সময়ে আবার শান্ত হয়ে যায়।’ মাহবুবুল ইসলাম আরও বলেন, পাহাড়িরা বৃষ্টিতে বাড়ি থেকে সহজে বের হন না। সন্ধ্যার পর চলাফেরা করেন না। বর্ষায় পাহাড়ে দিনের চেয়ে রাতে চলাচলে ঝুঁকি বেশি। পাহাড়ধস ও পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে সাপ ও অন্য প্রাণীর ভয় আছে। চলাচলের সময় বৃষ্টি হলে সতর্ক থাকতে হবে। প্রয়োজনে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিরাপদ জায়গায় অপেক্ষা করতে হবে। শুকনা মৌসুমেও পাহাড়ি নদী ও খালে গোসলে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। অদৃশ্য স্রোত থাকায় খুব সহজে গভীরে টেনে নিয়ে যায়। সাঁতার না জানলে ডুবে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। পাশে নৌকা ও দক্ষ সাঁতারু না থাকলে ডুবন্ত কাউকে উদ্ধার করাও কঠিন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জন র ম ত য দ র ঘটন য় ব ন দরব ন কর মকর ত ইসল ম ৯ বছর উপজ ল ঝরন য়
এছাড়াও পড়ুন:
সব্যসাচী কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন
প্রথিতযশা অধ্যাপক ও পরিসংখ্যানবিদ কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন সব্যসাচী মানুষ। তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তাঁর ঐতিহ্য শিক্ষার্থীদের ধারণ করতে হবে।
জ্ঞানতাপস কাজী মোতাহার হোসেনের ১২৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তৃতা, বৃত্তি, পদক, পুরস্কার ও সনদ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজক কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ এবং পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট।
অনুষ্ঠানে ‘যুগলের বন্ধন: কাজী নজরুল ইসলাম-কাজী মোতাহার হোসেন’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা দেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী। তিনি দুই বন্ধুর সম্পর্কের রসায়নের নানা দিক তুলে ধরেন।
প্রধান অতিথি বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, এই অনুষ্ঠানের দুটো প্রাপ্তি আছে। প্রথমত, মানুষের অবদান ও মেধাকে স্বীকার করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই উপমহাদেশের একজন প্রথিতযশা সব্যসাচী মানুষের ঋণ স্বীকার করা হচ্ছে।
কাজী মোতাহার হোসেন যেকোনো বিবেচনায় একজন দার্শনিক বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। প্রথম সারির পরিসংখ্যানবিদ, বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও তিনি অনেকগুলো সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রভাব বিস্তার করেছেন। একজন মানুষের ছোট জীবদ্দশায় এত গুণ সন্নিবেশিত করা কঠিন। কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেন।
সবাইকে নিয়ে চলা, প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, নিজের জগতের বাইরে নানা কিছুতে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঐতিহ্য কাজী মোতাহার হোসেন করে গেছেন বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, তাঁর সম্মানে যাঁরা আজ স্বীকৃতি পেলেন, তাঁরা এই ঐতিহ্যকে ধারণ করবেন। এটা (বিশ্ববিদ্যালয়) যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সে বার্তা দেবেন। যেসব শিক্ষার্থী সম্মাননা পাচ্ছেন, তাঁদের ছোট প্রোফাইল তৈরি করে ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মাজেদ বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন একজন সব্যসাচী মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞানের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে তাঁর পদচারণা ছিল না। তিনি দাবা খুব পছন্দ করতেন। দাবা খেলার কথা শুনলে তিনি ছুটে যেতেন। কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে তাঁর শোনা নানা গল্প তিনি স্মৃতিচারণা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাফর আহমেদ খান বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন পরিসংখ্যান চর্চার পথিকৃৎ ছিলেন। বিজ্ঞান, দাবাচর্চারও পথিকৃৎ ছিলেন। এমন কোনো পুরস্কার নেই যে, তিনি পাননি। তাঁর দেখানো পথে যেন শিক্ষার্থীরা নিজেদের আলোকিত করতে পারেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রওনাক হোসেন। এই আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের সেরা শিক্ষার্থীদের বই, নগদ অর্থ ও সনদ তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।