বিহান

নগ্ন তুমি এমনই সহজ—যেন তোমার একটা হাত;

এমনই পেলব, মৃন্ময়, ছোট্ট, স্বচ্ছ, গোল।

ধরেছ চন্দ্ররেখা, রেখেছ আপেলবীথিকা,

নগ্ন তুমি যেন এক নগ্ন শস্যকণা—তেমনই একহারা।

কিউবায় নেমে আসা নীল যামিনীর মতো নীল নগ্ন তুমি;

লতাগুল্ম তারাদের রেখেছ তোমারই কেশভারে।

নগ্ন তুমি বিস্তীর্ণ, হলুদ

সোনালি গির্জায় দেখা গ্রীষ্মের মতো।

তোমার একটা নখ যেমন খুদে, তুমি নগ্ন তেমনই;

সূক্ষ্ম, গোলাপরাঙা, বাঁক তাতে আছে,

সকাল জন্মাবার আগে তেমনটা থাকে,

যার পরে চলে যাও পাতালপুরেতে।

পোশাকের, রুটিনের দীর্ঘ এক সুড়ঙ্গ ধরে,

তোমার অমল জ্যোতি নিভু নিভু হয়; জামা পরে নেয়, ঝরায় পত্রালি,

আর হয়ে যায় শুধু নগ্ন একটা হাত, আরও একবার।

(সবচেয়ে দুঃখের লাইনগুলি) আজ রাতে লিখতে পারি

সবচেয়ে দুঃখের লাইনগুলি আজ রাতে লিখতে পারি।

যেমন লিখতে পারি, ‘তারাভরা রাত্রি আর তারাগুলি নীল আর দূরে বসে কাঁপে।’

আকাশে রাতের হাওয়া শুধু পাক খায়, আর কি জানি কি গায়।

সবচেয়ে দুঃখের লাইনগুলি আজ রাতে লিখতে পারি।

তারে ভালোবাসতাম, কখনো বুঝিবা সে–ও বাসত আমারে।

এমনই রাতের মতো রাত্রিগুলিতে তারে জড়িয়ে রাখতাম রাতভর।

বারেবারে চুমু খেতাম তারে

সীমাহীন আকাশের তলে।

সে আমারে ভালোবাসত, কখনো–বা আমিও বাসতাম তারে।

কেমনে কেউ না বাসে ভালো ওই বিরাট অচঞ্চল চোখ দুটিরে?

সবচেয়ে দুঃখের লাইনগুলি আজ রাতে লিখতে পারি।

যেই ভাবি, আমার সে নাই। যেই অনুভব জাগে, হারিয়েছি তারে।

অনন্ত রাত্রির কানে যেই শুনি, তারে ছাড়া যে রাত্রি অনন্ততর—

আত্মার ’পরে ঝরে কবিতার লাইন, মাঠের ওপরে ঝরে যেমনে শিশির।

আমার প্রেম যে তারে পারেনি রাখতে—তাতে কী-বা আসে যায়?

তারাভরা রাত, আর আমার কাছে

নাই, সে তো নাই।

হ, এইটুকুই।

দূরে কে জানি গান গায়।

দূউউরে।

তারে হারিয়ে প্রাণের আমার মোটে শান্তি নাই।

চোখ চাহে খুঁজে আনি তারে, নিয়ে আসি আরও কাছে।

মন তার সন্ধানে, আর মোর সাথে নাই সে তো!

আহা, সেই একই রাত্রি, সেই একই গাছেদের সাদা করে রাখে,

সেই একসময়ের দুইজনা আমরা, আর একই রইলাম কই?

আমি তারে আর ভালোবাসি না, হ—বাসি না নিশ্চিত, তবুও কী ভালোটাই না বেসেছিলাম!

কেমনে বাতাসের খোঁজে থাকত কণ্ঠ মোর, যদি ছোঁয়া যায় একটুকু তার শ্রুতি।

অন্য কারোর। অন্য কারোরই সে হবে। আমার চুমুর আগে সে যেমন ছিল।

তার স্বর, তার দ্যুতি–ঠিকরানো দেহ, তার অনন্ত চোখ।

তারে আর ভালোবাসি না, হ—বাসি না নিশ্চিত, তবু যেন বাসিও–বা ভালো।

ভালোবাসা এইটুকু; ভুলে যাওয়া দীর্ঘ, দীর্ঘ এত।

এমনই রাত্রিভরে জড়িয়ে রাখতাম বলে তারে,

প্রাণের আমার শান্তি নাই—প্রাণ হারিয়েছে তারে।

যদিও এ–ই শেষ। আমারে দেওয়া তার এ–ই শেষ ব্যথা।

তার তরে লেখা মোর শেষ কবিতা।

প্রেম

কী সমস্যা বলো তো তোমার! কী সমস্যা আমাদের?

হচ্ছে কী আমাদের সাথে?

আমাদের প্রেম যেন নিষ্করুণ দড়ি এক, এহ্.

..

বজ্র আঁটুনিতে বাঁধে যত, জখমে আমাদেরকে বিদীর্ণ করে।

আর, জখমকে যদি চাই

পিছে ফেলে যেতে,

আলাদা আলাদা হয়ে যেতে,

নতুন গিঁটের আঁটে বাঁধে আমাদের; শাস্তিবিধান করে

রক্ত বহাবার আর যুগলে পোড়ার।

তোমার কী অসুবিধা বলো তো? যতবার তোমাকে দেখি

কিচ্ছু পাই না... না। শুধু দুটি চোখ পাই

আর সব চোখেদের মতো; একখানি মুখ পাই—

হারিয়ে গেছে আমার চুমু খাওয়া সহস্র মুখেদের মাঝে, বরং ওগুলি ছিল সুন্দরতর।

আর কী? একটা শরীর? আর সব ভুলে যাওয়া শরীরের মতোই,

কোনো স্মৃতি না রেখেই পিছলে গিয়েছে যারা আমার শরীরের তল দিয়ে।

কতখানি শূন্য হয়ে পৃথিবীতে চলেছ যে তুমি

গমরঙা একখানা কৌটার মতো

বায়ুহীন, শব্দহীন, সারবস্তুহীন!

বেহুদাই তোমার মাঝে গভীরতা খুঁজেছি আমি,

ভেবেছি ডুববে তাতে আমার অক্লান্ত বাহু দুটি

যারা শুধু দিনমান খুঁড়ে যায় মাটির তলা:

তোমার ত্বকের তলা, তোমার চোখের তলা,

কিচ্ছু নাই, না।

অল্প উত্থিত তোমার দুইখানা বুকের তলে

ফটিকস্বচ্ছ এক স্রোত বয়ে যায়—

ওই স্রোত জানে নাকো কেন বয়, কেন গান হয়।

কেন, কেন, কেন,

বলো প্রিয়, কেন?

একটা কুকুর মরেছে

আমার কুকুরটা মরে গেছে।

দাফন করেছি তাকে বাগানের মাঝে

জং ধরা একখানা মেশিনের পাশে।

ওখানেই একদিন মিলন ঘটবে জানি মোর সাথে তার,

আজকে যদিও সে চলে গেছে আউলা, লোমশ—

ঠান্ডা নাকটা লয়ে, আকাট ও সহবতহীন,

জড়বাদী বলে আমি বিশ্বাস করিনি কভু

আকাশের শিকায় তুলে রাখা কোনো স্বর্গে।

মানুষের তরে তুলে রাখা সে কি? হা—

তো, জানি স্বর্গে নাই মোর প্রবেশাধিকার।

তবে হ্যাঁ—কুকুরকুলের লাগি তুলে রাখা আছে স্বর্গ এক;

আমার কুকুরটা যেথা আমারই অপেক্ষাতে রবে

দোস্তিতে গদগদ, লেজ নেড়ে ঘূর্ণিত পাখার মতন।

হে—দুনিয়াবি দুঃখ নিয়ে কিছু বলব না

সঙ্গী হারানো হাবিজাবি—

সেবাদাস হয়নি কো যেবা।

কর্তৃত্ব না ফলানো শজারুর মতো

তার সাথে দোস্তি ছিল—নক্ষত্রের সাথে হয় বন্ধুতা যেমন, নিঃসঙ্গ বিধুর,

এক্সট্রা খাতির কিছু ছিল নাকো, মাখামাখি

বাহুল্যবর্জিত:

জামা বেয়ে ওঠে নাই কখনো সে

আগ্রহে ভরেনি মোরে পশমে, খুঁজলিতে,

আমার হাঁটুতে কভু ঘষেনি শরীর

যৌনক্ষুধিত বাকি কুকুরের মতো।

না গো, আমার কুকুর শুধু অপলক চাহনিতে

চাহিদামতন ঢেলে দিত মনোযোগ,

যতটা পাত্তা পাওয়া প্রয়োজন ছিল মোর,

আমার মতন এক ফালতু লোকের তাতে প্রত্যয় হতো—

কুকুর হিসেবে তার অনেক সময় এতে হলো অপচয়।

তবুও সে দুটি চোখ—আমার চোখেরও থেকে বহু শুদ্ধতর,

অপলক আমাতেই পেতে রাখা ছিল

একলা আমারই তরে সংরক্ষিত যেন।

টুকুস, লোমশ তার জীবনটা ছিল

হামেশা আমারই পায়ে, জ্বালাত না মোটে,

প্রশ্নও করত না কভু।

আহা, কত কতবার তার লেজ দেখে হয়েছে ঈর্ষা

সাগরবেলায় তাকে নিয়ে পথ হেঁটেছি যখন—

কাউলাদ্বীপের সেই একাকী শীতের ঋতুতে,

অতিথি পাখির দল যেখানে আকাশ ছেয়ে ছিল

লোমশ কুকুর আমার কেমন লাফাল–ঝাঁপাল,

সাগরের প্রাণশক্তি তার মাঝে সংক্রমিত ছিল।

ঘুরঘুরে অভ্যাসে শুঁকে আর শুঁকে

উত্থিত স্বর্ণালি লেজে

সমুদ্রের ফোয়ারাকে করল মোকাবেলা।

মাস্তিতে, মাস্তিতে, মাস্তিতে।

শুধু সারমেয়রাই যে সুখী হতে জানে

বেহায়া বিন্দাস ও স্বকীয় স্ফূর্তিতে।

আমার যে কুকুরটা মরে গেছে, তারে বিদায় দেবার কিছু নেই,

সে আমারে, আমি তারে, মিথ্যা বলি না আজ; মিথ্যা বলিনি কোনো দিনই।

সে যে আজ চলে গেছে, কবর দিয়েছি আজ তাকে,

এটুকু, এটুকু বটে। এর বেশি আর কিছু নেই।

ট্রেনের স্বপ্ন

স্টেশনে ট্রেনগুলি স্বপ্ন দেখছিল

ইঞ্জিনহীন, নিরস্ত্র–অসহায়, শুয়ে–শুয়ে।

ভোরবেলা ভিতরে গেলাম আমি, একটু কিন্তু–কিন্তু করে:

গোপন যা কিছু আছে, নামলাম তার সন্ধানে,

বগিতে হারিয়েছে যা, ডুবেছে যাত্রার বাসি গন্ধে,

বিগত যারা, তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে

একা লাগল নিজেকে, অচল গাড়িতে।

ভিতরের বাতাসটা থিকথিকে, একতাল

পরিত্যক্ত বাক্যালাপ, চলমান বিষণ্নতারা।

নিখোঁজ আত্মারা বুঝি পড়ে ছিল সিটের তলায়,

তালা–নাই চাবিরা যেমন।

দক্ষিণ থেকে ওঠা জেনানা সওয়ারিগণ

ফুলের স্তবক আর মুরগি ভারাক্রান্ত যারা—

হয়তোবা খুন হয়েছিল,

হয়তোবা তারা ফিরে গিয়ে কেঁদেছিল,

পুষ্পানলে তারা বুঝি খাক করেছিল

এক একটা বগি,

আমি বুঝি সেই তাদের সহযাত্রী হলাম,

ভাবলাম, হয়তোবা যাত্রার বাষ্প,

ভেজা ট্রেনলাইন, সকলই জীবন্ত আজি

এ অচল গতিহীন ট্রেনে, আর

আমি এক ঘুমন্ত সওয়ারি

কপালের দোষে আজ সতর্ক অস্থির।

সিটে বসা আমি, আর ট্রেন চলছিল

এই শরীরের মাঝ দিয়ে, ধ্বংস—ধ্বংস করে আমার পরিসীমাগুলি,

হঠাৎ সে হয় আমার শৈশবের ট্রেন,

কাকভোরে ছেয়ে থাকা ধোঁয়া,

তিক্ত, মধুর গ্রীষ্মকাল।

অন্যান্য ট্রেন হয়ে কারা ভাগছিল,

বগিগুলি বিষাদকণায় গিজগিজ,

কালো কালো পিচে ঠেসে রাখা বগি যেন,

এমনেই গতিহীন ট্রেনটা

এগোতে থাকল

সেই এক সকালে—যে সকাল ক্রমাগত

হাড্ডির চারিধারে চাপ বাড়াচ্ছিল।

একলা ট্রেনে আমি ছিলাম একাকী,

সে একাকিত্ব আমার একলার নয়,

শত একাকিত্ব এসে মেলা করেছিল,

তাদেরও ইচ্ছা ছিল দূরযাত্রার,

প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকা গরিবগুলির প্রায়ই সাধ হয় যেমন।

বাসি–হদ্দ ধোঁয়া হয়ে আমি ট্রেনে বসে

তাদের ধারণে বড় অক্ষম হই,

অসংখ্য মৃত্যুতে অভিভূত,

নিজেকে বেদিশা লাগে এই এক আনোখি যাত্রায়—

ক্লান্ত হৃদয় আমার চলমান এতে, বাদবাকি সবকিছু নিরেট নিশ্চল।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: খ র ল ইনগ ল আজ র ত স ই এক আম দ র আম র চ র আম র আম র ক সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

পাবলো নেরুদার প্রেম ও রেলগাড়ি

বিহান

নগ্ন তুমি এমনই সহজ—যেন তোমার একটা হাত;

এমনই পেলব, মৃন্ময়, ছোট্ট, স্বচ্ছ, গোল।

ধরেছ চন্দ্ররেখা, রেখেছ আপেলবীথিকা,

নগ্ন তুমি যেন এক নগ্ন শস্যকণা—তেমনই একহারা।

কিউবায় নেমে আসা নীল যামিনীর মতো নীল নগ্ন তুমি;

লতাগুল্ম তারাদের রেখেছ তোমারই কেশভারে।

নগ্ন তুমি বিস্তীর্ণ, হলুদ

সোনালি গির্জায় দেখা গ্রীষ্মের মতো।

তোমার একটা নখ যেমন খুদে, তুমি নগ্ন তেমনই;

সূক্ষ্ম, গোলাপরাঙা, বাঁক তাতে আছে,

সকাল জন্মাবার আগে তেমনটা থাকে,

যার পরে চলে যাও পাতালপুরেতে।

পোশাকের, রুটিনের দীর্ঘ এক সুড়ঙ্গ ধরে,

তোমার অমল জ্যোতি নিভু নিভু হয়; জামা পরে নেয়, ঝরায় পত্রালি,

আর হয়ে যায় শুধু নগ্ন একটা হাত, আরও একবার।

(সবচেয়ে দুঃখের লাইনগুলি) আজ রাতে লিখতে পারি

সবচেয়ে দুঃখের লাইনগুলি আজ রাতে লিখতে পারি।

যেমন লিখতে পারি, ‘তারাভরা রাত্রি আর তারাগুলি নীল আর দূরে বসে কাঁপে।’

আকাশে রাতের হাওয়া শুধু পাক খায়, আর কি জানি কি গায়।

সবচেয়ে দুঃখের লাইনগুলি আজ রাতে লিখতে পারি।

তারে ভালোবাসতাম, কখনো বুঝিবা সে–ও বাসত আমারে।

এমনই রাতের মতো রাত্রিগুলিতে তারে জড়িয়ে রাখতাম রাতভর।

বারেবারে চুমু খেতাম তারে

সীমাহীন আকাশের তলে।

সে আমারে ভালোবাসত, কখনো–বা আমিও বাসতাম তারে।

কেমনে কেউ না বাসে ভালো ওই বিরাট অচঞ্চল চোখ দুটিরে?

সবচেয়ে দুঃখের লাইনগুলি আজ রাতে লিখতে পারি।

যেই ভাবি, আমার সে নাই। যেই অনুভব জাগে, হারিয়েছি তারে।

অনন্ত রাত্রির কানে যেই শুনি, তারে ছাড়া যে রাত্রি অনন্ততর—

আত্মার ’পরে ঝরে কবিতার লাইন, মাঠের ওপরে ঝরে যেমনে শিশির।

আমার প্রেম যে তারে পারেনি রাখতে—তাতে কী-বা আসে যায়?

তারাভরা রাত, আর আমার কাছে

নাই, সে তো নাই।

হ, এইটুকুই।

দূরে কে জানি গান গায়।

দূউউরে।

তারে হারিয়ে প্রাণের আমার মোটে শান্তি নাই।

চোখ চাহে খুঁজে আনি তারে, নিয়ে আসি আরও কাছে।

মন তার সন্ধানে, আর মোর সাথে নাই সে তো!

আহা, সেই একই রাত্রি, সেই একই গাছেদের সাদা করে রাখে,

সেই একসময়ের দুইজনা আমরা, আর একই রইলাম কই?

আমি তারে আর ভালোবাসি না, হ—বাসি না নিশ্চিত, তবুও কী ভালোটাই না বেসেছিলাম!

কেমনে বাতাসের খোঁজে থাকত কণ্ঠ মোর, যদি ছোঁয়া যায় একটুকু তার শ্রুতি।

অন্য কারোর। অন্য কারোরই সে হবে। আমার চুমুর আগে সে যেমন ছিল।

তার স্বর, তার দ্যুতি–ঠিকরানো দেহ, তার অনন্ত চোখ।

তারে আর ভালোবাসি না, হ—বাসি না নিশ্চিত, তবু যেন বাসিও–বা ভালো।

ভালোবাসা এইটুকু; ভুলে যাওয়া দীর্ঘ, দীর্ঘ এত।

এমনই রাত্রিভরে জড়িয়ে রাখতাম বলে তারে,

প্রাণের আমার শান্তি নাই—প্রাণ হারিয়েছে তারে।

যদিও এ–ই শেষ। আমারে দেওয়া তার এ–ই শেষ ব্যথা।

তার তরে লেখা মোর শেষ কবিতা।

প্রেম

কী সমস্যা বলো তো তোমার! কী সমস্যা আমাদের?

হচ্ছে কী আমাদের সাথে?

আমাদের প্রেম যেন নিষ্করুণ দড়ি এক, এহ্...

বজ্র আঁটুনিতে বাঁধে যত, জখমে আমাদেরকে বিদীর্ণ করে।

আর, জখমকে যদি চাই

পিছে ফেলে যেতে,

আলাদা আলাদা হয়ে যেতে,

নতুন গিঁটের আঁটে বাঁধে আমাদের; শাস্তিবিধান করে

রক্ত বহাবার আর যুগলে পোড়ার।

তোমার কী অসুবিধা বলো তো? যতবার তোমাকে দেখি

কিচ্ছু পাই না... না। শুধু দুটি চোখ পাই

আর সব চোখেদের মতো; একখানি মুখ পাই—

হারিয়ে গেছে আমার চুমু খাওয়া সহস্র মুখেদের মাঝে, বরং ওগুলি ছিল সুন্দরতর।

আর কী? একটা শরীর? আর সব ভুলে যাওয়া শরীরের মতোই,

কোনো স্মৃতি না রেখেই পিছলে গিয়েছে যারা আমার শরীরের তল দিয়ে।

কতখানি শূন্য হয়ে পৃথিবীতে চলেছ যে তুমি

গমরঙা একখানা কৌটার মতো

বায়ুহীন, শব্দহীন, সারবস্তুহীন!

বেহুদাই তোমার মাঝে গভীরতা খুঁজেছি আমি,

ভেবেছি ডুববে তাতে আমার অক্লান্ত বাহু দুটি

যারা শুধু দিনমান খুঁড়ে যায় মাটির তলা:

তোমার ত্বকের তলা, তোমার চোখের তলা,

কিচ্ছু নাই, না।

অল্প উত্থিত তোমার দুইখানা বুকের তলে

ফটিকস্বচ্ছ এক স্রোত বয়ে যায়—

ওই স্রোত জানে নাকো কেন বয়, কেন গান হয়।

কেন, কেন, কেন,

বলো প্রিয়, কেন?

একটা কুকুর মরেছে

আমার কুকুরটা মরে গেছে।

দাফন করেছি তাকে বাগানের মাঝে

জং ধরা একখানা মেশিনের পাশে।

ওখানেই একদিন মিলন ঘটবে জানি মোর সাথে তার,

আজকে যদিও সে চলে গেছে আউলা, লোমশ—

ঠান্ডা নাকটা লয়ে, আকাট ও সহবতহীন,

জড়বাদী বলে আমি বিশ্বাস করিনি কভু

আকাশের শিকায় তুলে রাখা কোনো স্বর্গে।

মানুষের তরে তুলে রাখা সে কি? হা—

তো, জানি স্বর্গে নাই মোর প্রবেশাধিকার।

তবে হ্যাঁ—কুকুরকুলের লাগি তুলে রাখা আছে স্বর্গ এক;

আমার কুকুরটা যেথা আমারই অপেক্ষাতে রবে

দোস্তিতে গদগদ, লেজ নেড়ে ঘূর্ণিত পাখার মতন।

হে—দুনিয়াবি দুঃখ নিয়ে কিছু বলব না

সঙ্গী হারানো হাবিজাবি—

সেবাদাস হয়নি কো যেবা।

কর্তৃত্ব না ফলানো শজারুর মতো

তার সাথে দোস্তি ছিল—নক্ষত্রের সাথে হয় বন্ধুতা যেমন, নিঃসঙ্গ বিধুর,

এক্সট্রা খাতির কিছু ছিল নাকো, মাখামাখি

বাহুল্যবর্জিত:

জামা বেয়ে ওঠে নাই কখনো সে

আগ্রহে ভরেনি মোরে পশমে, খুঁজলিতে,

আমার হাঁটুতে কভু ঘষেনি শরীর

যৌনক্ষুধিত বাকি কুকুরের মতো।

না গো, আমার কুকুর শুধু অপলক চাহনিতে

চাহিদামতন ঢেলে দিত মনোযোগ,

যতটা পাত্তা পাওয়া প্রয়োজন ছিল মোর,

আমার মতন এক ফালতু লোকের তাতে প্রত্যয় হতো—

কুকুর হিসেবে তার অনেক সময় এতে হলো অপচয়।

তবুও সে দুটি চোখ—আমার চোখেরও থেকে বহু শুদ্ধতর,

অপলক আমাতেই পেতে রাখা ছিল

একলা আমারই তরে সংরক্ষিত যেন।

টুকুস, লোমশ তার জীবনটা ছিল

হামেশা আমারই পায়ে, জ্বালাত না মোটে,

প্রশ্নও করত না কভু।

আহা, কত কতবার তার লেজ দেখে হয়েছে ঈর্ষা

সাগরবেলায় তাকে নিয়ে পথ হেঁটেছি যখন—

কাউলাদ্বীপের সেই একাকী শীতের ঋতুতে,

অতিথি পাখির দল যেখানে আকাশ ছেয়ে ছিল

লোমশ কুকুর আমার কেমন লাফাল–ঝাঁপাল,

সাগরের প্রাণশক্তি তার মাঝে সংক্রমিত ছিল।

ঘুরঘুরে অভ্যাসে শুঁকে আর শুঁকে

উত্থিত স্বর্ণালি লেজে

সমুদ্রের ফোয়ারাকে করল মোকাবেলা।

মাস্তিতে, মাস্তিতে, মাস্তিতে।

শুধু সারমেয়রাই যে সুখী হতে জানে

বেহায়া বিন্দাস ও স্বকীয় স্ফূর্তিতে।

আমার যে কুকুরটা মরে গেছে, তারে বিদায় দেবার কিছু নেই,

সে আমারে, আমি তারে, মিথ্যা বলি না আজ; মিথ্যা বলিনি কোনো দিনই।

সে যে আজ চলে গেছে, কবর দিয়েছি আজ তাকে,

এটুকু, এটুকু বটে। এর বেশি আর কিছু নেই।

ট্রেনের স্বপ্ন

স্টেশনে ট্রেনগুলি স্বপ্ন দেখছিল

ইঞ্জিনহীন, নিরস্ত্র–অসহায়, শুয়ে–শুয়ে।

ভোরবেলা ভিতরে গেলাম আমি, একটু কিন্তু–কিন্তু করে:

গোপন যা কিছু আছে, নামলাম তার সন্ধানে,

বগিতে হারিয়েছে যা, ডুবেছে যাত্রার বাসি গন্ধে,

বিগত যারা, তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে

একা লাগল নিজেকে, অচল গাড়িতে।

ভিতরের বাতাসটা থিকথিকে, একতাল

পরিত্যক্ত বাক্যালাপ, চলমান বিষণ্নতারা।

নিখোঁজ আত্মারা বুঝি পড়ে ছিল সিটের তলায়,

তালা–নাই চাবিরা যেমন।

দক্ষিণ থেকে ওঠা জেনানা সওয়ারিগণ

ফুলের স্তবক আর মুরগি ভারাক্রান্ত যারা—

হয়তোবা খুন হয়েছিল,

হয়তোবা তারা ফিরে গিয়ে কেঁদেছিল,

পুষ্পানলে তারা বুঝি খাক করেছিল

এক একটা বগি,

আমি বুঝি সেই তাদের সহযাত্রী হলাম,

ভাবলাম, হয়তোবা যাত্রার বাষ্প,

ভেজা ট্রেনলাইন, সকলই জীবন্ত আজি

এ অচল গতিহীন ট্রেনে, আর

আমি এক ঘুমন্ত সওয়ারি

কপালের দোষে আজ সতর্ক অস্থির।

সিটে বসা আমি, আর ট্রেন চলছিল

এই শরীরের মাঝ দিয়ে, ধ্বংস—ধ্বংস করে আমার পরিসীমাগুলি,

হঠাৎ সে হয় আমার শৈশবের ট্রেন,

কাকভোরে ছেয়ে থাকা ধোঁয়া,

তিক্ত, মধুর গ্রীষ্মকাল।

অন্যান্য ট্রেন হয়ে কারা ভাগছিল,

বগিগুলি বিষাদকণায় গিজগিজ,

কালো কালো পিচে ঠেসে রাখা বগি যেন,

এমনেই গতিহীন ট্রেনটা

এগোতে থাকল

সেই এক সকালে—যে সকাল ক্রমাগত

হাড্ডির চারিধারে চাপ বাড়াচ্ছিল।

একলা ট্রেনে আমি ছিলাম একাকী,

সে একাকিত্ব আমার একলার নয়,

শত একাকিত্ব এসে মেলা করেছিল,

তাদেরও ইচ্ছা ছিল দূরযাত্রার,

প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকা গরিবগুলির প্রায়ই সাধ হয় যেমন।

বাসি–হদ্দ ধোঁয়া হয়ে আমি ট্রেনে বসে

তাদের ধারণে বড় অক্ষম হই,

অসংখ্য মৃত্যুতে অভিভূত,

নিজেকে বেদিশা লাগে এই এক আনোখি যাত্রায়—

ক্লান্ত হৃদয় আমার চলমান এতে, বাদবাকি সবকিছু নিরেট নিশ্চল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ