তাজউদ্দীন আহমদ দেশের স্বাধীনতার প্রধান পুরুষ
Published: 28th, July 2025 GMT
তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধান পুরুষ ছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট লেখক মঈদুল হাসান। তিনি বলেন, ‘তাঁর (তাজউদ্দীন) সম্পর্কে বলতে গেলে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। ইতিহাস নিয়ে এত দিন যে মিথ তৈরি করা হয়েছিল, তা ভাঙতে হবে। বস্তুনিষ্ঠভাবে ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।’
আজ সোমবার দুপুরে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত শিক্ষার্থীদের রচনা প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় মঈদুল হাসান এ কথা বলেন। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সারা দেশে তাদের নিবন্ধিত বেসরকারি গ্রন্থাগারের পাঠক-শিক্ষার্থীদের জন্য রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।
এই রচনার বিষয় ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের আড়ালের নায়ক: তাজউদ্দীন আহমদ’। এ প্রতিযোগিতায় ৩৬টি পাঠাগার অংশ নেয়। শিক্ষার্থীদের বয়সভিত্তিক ‘ক’ ও ‘খ‘ দুটি বিভাগে প্রতিযোগিতা হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে ৩১ জনকে পুরস্কৃত করা হয়।
অনুষ্ঠানে লেখক মঈদুল হাসান ছাড়াও অতিথি ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে লেখক শারমিন আহমদ, লেখক ও অধিকারকর্মী ফিরোজ আহমদ। সভাপতিত্ব করেন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক আফসানা বেগম। আলোচনা পর্বের শুরুতেই তাজউদ্দীন আহমদের জীবন ও কর্ম নিয়ে পুঁথিপাঠ, তাঁর ডায়েরি থেকে পাঠ ও গান নিয়ে তুষার চন্দনের পরিচালনায় একটি গীতি–আলেখ্য পরিবেশন করেন মিরপুরের আলোকবর্তিকা গ্রন্থালয়ের সদস্যরা।
তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের দিনগুলোর দীর্ঘ স্মৃতিচারণা করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক মঈদুল হাসান। তিনি বলেন, তাজউদ্দীন আহমদ যখন যেভাবে যেসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেসব বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধান করে তুলে আনতে হবে। এত দিন অনেক কথা বলা যেত না। এখনো সেই সময়ের অনেকে জীবিত আছেন। তাঁরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারবেন। এখন তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে এই গবেষণা করতে হবে।
মঈদুল হাসান বলেন, ১৯৭৪ সালে তিনি যখন লন্ডনে জনতা ব্যাংকে কাজ করতেন তখন তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে নিউইয়র্ক সফরের সময় সেখানে ডেকেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী (শেখ মুজিবুর রহমান) এমন একধরনের শাসনব্যবস্থা করতে চাচ্ছেন, যা দেশের মানুষ গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। তাঁর (তাজউদ্দীন) কাছে দুটি প্রস্তাব এসেছে, সহকারী রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী এমন কোনো পদ গ্রহণ করা অথবা পদত্যাগ করা। তিনি (তাজউদ্দীন) বলেছিলেন, ওই ধরনের পরিবর্তনের উদ্যোগের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগ নেই। তাঁর প্রথম কাজ হবে পদত্যাগ করা।
এরপর তাজউদ্দীন আহমদের জীবনে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল উল্লেখ করে মঈদুল হাসান বলেন, তাঁকে (তাজউদ্দীন) মেরে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছিল। শেখ ফজলুল হক মণি এর নেপথ্যে থাকতে পারেন বলে তাঁকে (মঈদুল হাসান) জানানো হয়েছিল।
ন্যাপ নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য এবং আরও একজন লন্ডনে এসে তাঁকে (মঈদুল হাসান) বলেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদকে দেশ থেকে বের করে কোনো নিরাপদ দেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে। তিনি সাধ্যমতো সে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। মঈদুল হাসান বলেন, ১৯৭১ সালে ফজলুল হক মণি আরও একবার তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যার চক্রান্ত করেছিলেন।
মঈদুল হাসান বলেন, ১৯৭৪–এর আগস্টের শেষ দিকে তিনি ঢাকায় এলে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান তখন বলেছিলেন, দেশ একটা দুর্যোগের মধ্য পড়তে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ আছে। তার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। পরে মঈদুল হাসান অনেক ভেবেছেন, জিয়াউর রহমান কেন তাঁকে এটা বলেছিলেন? এসব কথা আগে বলার মতো পরিবেশ ছিল না বলে তিনি উল্লেখ করেন। এমন আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অজানা তথ্য রয়েছে। গবেষকদের তিনি আবেগতাড়িত না হয়ে সত্য অনুসন্ধানের আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদ শিক্ষার্থীদের কাছে তাঁর বাবার স্মৃতিচারণা করেন। বলেন, বাবাকে তিনি খুব কম সময়ই কাছে পেয়েছেন। তিনি খুবই দয়ালু ছিলেন। সহজ–সরল ও সাশ্রয়ী জীবন যাপন করতেন। জামাকাপড় কাচাসহ নিজের কাজ নিজে করতেন। স্বার্থপরতাকে প্রশ্রয় দেননি। আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রচণ্ড। যখন রাষ্ট্রনায়ক হয়েছেন তখন চরিত্রের এ বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁর কাজে প্রতিফলিত হয়েছে।
শারমিন আহমদ আরও বলেন, তাঁর বাবা বলতেন, জনগণের নেতা হতে হলে সবকিছু দিয়েই নেতা হতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর খুবই স্পষ্ট বক্তব্য ছিল। তিনি অনেকবার বলেছেন, ‘এই যুদ্ধ হচ্ছে আমাদের নিজেদের যুদ্ধ। ভারত আমাদের সহায়তা দিয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে।’ তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন, আলোর মতো মানুষ।
সভাপতির বক্তব্যে আফসানা বেগম বলেন, ইতিহাসের অনেক অজানা ঘটনা ও তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ের মুখ থেকে তাঁর সম্পর্কে জানতে পারা শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই আনন্দের বিষয়। ভবিষ্যতে তারা ইতিহাস জানতে আরও আগ্রহী হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন রচনা প্রতিযোগিতার বিচারকমণ্ডলীর সদস্য লেখক সোহান রিজওয়ান। স্বাগত বক্তব্য দেন গ্রন্থকেন্দ্রের উপপরিচালক ফরিদ উদ্দিন সরকার। সঞ্চালনা করেন সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ইনামুল হক।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ত জউদ দ ন আহমদ ত জউদ দ ন আহমদ র অন ষ ঠ ন বল ছ ল ন র রহম ন গ রন থ
এছাড়াও পড়ুন:
দুর্নীতির অভিযোগে কেনাকাটা আটকে দিয়েছিলেন নাহিদ, তোড়জোড় ফয়েজ আহমদের
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) একটি প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম প্রকল্পের কেনাকাটার প্রক্রিয়া আটকে দেন। দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের ব্যবস্থাও করেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান শেষ হওয়ার আগেই এখন সেই প্রকল্পে যন্ত্রপাতি কেনার তোড়জোড় করছেন প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তাঁর বিরুদ্ধে দুদককে প্রভাবিত করার অভিযোগও উঠেছে।
বিটিসিএলের ওই প্রকল্পে দুদক গত ৯ জানুয়ারি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য দুদকের পরিচালক এস এম এম আকতার হামিদ ভূঁইয়াকে প্রধান করে গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটি কাজ করছে। অনুসন্ধান চলার মধ্যেই যাতে কেনাকাটা করা যায়, সে জন্য দুদকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেছেন ফয়েজ আহমদ। তাঁকে চিঠিও দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এই প্রকল্পে কেনাকাটা করতে বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
বিটিসিএলের প্রকল্পটির নাম ‘৫-জি উপযোগীকরণে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’, যা ফাইভ-জি রেডিনেস প্রকল্প নামে পরিচিতি। বিটিসিএল সারা দেশে অপটিক্যাল ফাইবার (বিশেষ তার) ও যন্ত্রপাতি বসিয়ে তা ইন্টারনেট সেবাদাতাদের কাছে ভাড়া দেয়। নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে তারা সেই সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিল।
বিটিসিএল ও দুদক সূত্র জানায়, প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে যন্ত্রপাতি কেনার ব্যয় ৪৬৩ কোটি টাকা। সেই সময় দরপত্রে অংশ নেওয়া তিনটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রস্তাব মাত্র চার দিনে মূল্যায়ন করে চীনা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে টেকনোলজিসকে ৩২৬ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়। তখন অভিযোগ উঠেছিল যে দরদাতাদের কেউই দরপত্রের শর্ত পূরণ করতে পারেনি। তারপরও কারিগরি কমিটি সবাইকে যোগ্য ঘোষণা করে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সমীক্ষা অনুসারে অনুমোদিত ডিপিপি (প্রকল্প প্রস্তাব) ভঙ্গ করে প্রয়োজনের চেয়ে পাঁচ গুণ সক্ষমতার যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নিয়ে অর্থ অপচয় চেষ্টার অভিযোগও ওঠে। এ ছাড়া মূল্যায়নের গোপন তথ্য ফাঁস করে তৎকালীন মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও তৎকালীন সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের ঘটনাও ঘটে। বিটিসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান এসব কারণে প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী নতুন করে দরপত্রের সিদ্ধান্ত দেন। গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে প্রভাব বিস্তারের দায়ে দুই চীনা প্রতিষ্ঠানের দরপত্রও বাতিল করেন।
অনুসন্ধান চলার মধ্যেই যাতে কেনাকাটা করা যায়, সে জন্য দুদকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেছেন ফয়েজ আহমদ। তাঁকে চিঠিও দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এই প্রকল্পে কেনাকাটা করতে বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।মোস্তাফা জব্বার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) পর্যালোচনা সভায় দরপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত মেনে নেন। এ নিয়েই মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে তখনকার টেলিযোগাযোগসচিবের বিরোধ তৈরি হয়। সচিব বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে পর্ষদের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামানের ওপর চাপ দেন। ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ তাঁকে অপসারণ করে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দেন। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করে চীনা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েকে কাজ দেন।
নথিপত্রে দেখা যায়, তৎকালীন যুগ্ম সচিব তৈয়বুর রহমান ই-মেইল করে প্রকল্প পরিচালক থেকে দরপত্রের সর্বশেষ পরিস্থিতির একটি চিঠি আনান। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে সেই চিঠি পরিচালনা পর্ষদে উত্থাপনের নির্দেশ আসে। পর্ষদের মাধ্যমে আসাদুজ্জামানের ওপর চাপ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে আবু হেনা মোরশেদ জামান ও তৈয়বুর মিলে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্মার্ট বাংলাদেশের অদম্য অভিযাত্রা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নামে একটি বই লিখে তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎসর্গ করেন।
২০২৪ সালের জুনে আবু হেনা মোরশেদ জামানকে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হিসেবে পদায়ন করা হয়। বর্তমান সরকার তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে। তৈয়বুর বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং পাশাপাশি ইডিজিই (এনহ্যান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি) প্রকল্পের পরিচালক ও জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যন্ত্রপাতি ফাইভ-জির উপযোগী কি না এবং ১২ বছর সেবা দেবে কি না, তা বিশেষজ্ঞ দল দিয়ে যাচাই করা হবে। আবার হুয়াওয়ের দেওয়া প্রস্তাব মেনে নিয়ে চুক্তির জিসিসি ক্লজ ৩৮ দশমিক ৪ (কারখানা পরিদর্শন ছাড়া সরবরাহ-সংক্রান্ত) অনুযায়ী পণ্য জাহাজীকরণ করবে বলে জানান।ফয়েজের তৎপরতাজুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন নাহিদ ইসলাম। নতুন রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে তিনি গত ২৫ ফেব্রুয়ারি উপদেষ্টার দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। পরে ৫ মার্চ ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী করা হয়। দায়িত্ব নিয়ে তিনি ফাইভ-জি প্রকল্পের জন্য আওয়ামী লীগ আমলে কেনা সরঞ্জামাদি আমদানির উদ্যোগ নেন। দরপত্রের নিয়মানুযায়ী, কোনো কোম্পানি থেকে যন্ত্রপাতি আমদানির আগে কারখানায় গিয়ে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। চুক্তি অনুযায়ী চারজন প্রকৌশলীকে চীনে হুয়াওয়ের কারখানায় পাঠানোর কথা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব দায়িত্ব নেওয়ার ২০ দিনের মাথায় হুয়াওয়ে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে কারখানা পরিদর্শনের জন্য চিঠি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিটিসিএল একটি বেসরকারি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দুদকের অনুসন্ধানাধীন প্রকল্পের বাকি কাজ এগিয়ে দিতে আইনগত মতামত নেয় (২৭ মার্চ, ২০২৫)। যদিও এ ধরনের আইনগত মতামত দেওয়ার জন্য বিটিসিএলের নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল রয়েছে।
বিটিসিএলের একটি সূত্র জানায়, বেসরকারি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে অতীতে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানানো হয়নি। ফলে তাদের মতামত যন্ত্রপাতি কেনাকাটার পক্ষে আসে। কিন্তু পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যখন প্রকল্পের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি জানতে পারে, তখন তারা আইনগত মতামত সংশোধন করে। নতুন করে (৮ এপ্রিল, ২০২৫) তারা বলে যে, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তাধীন প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেকশন ৬৪, পিপিএ ২০০৬ এবং পিপিআর (২০০৮) ১২৭ রুল প্রযোজ্য হবে।
সরকারি ক্রয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) সাবেক মহাপরিচালক ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পিপিএ ও পিপিআরের এসব ধারায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগের কথা বলা হয়েছে। আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তাদের মতামতে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিটিসিএলকে সতর্ক করেছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা সাধারণত কেনাকাটার দিকে এগোন না।
দুদককে ফয়েজের চিঠিফয়েজ আহমদ অবশ্য থেমে থাকেননি। তিনি ১৩ এপ্রিল দুদকে গিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁকে একটি চিঠিও দেন। দুদক সূত্র বলছে, ফয়েজ আহমদ প্রকল্পের কেনাকাটা এগিয়ে নিতে দুদকের ইতিবাচক মতামতের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। যদিও দুদক জানিয়ে দেয় (১৮ জুন, ২০২৫), প্রাথমিক অনুসন্ধানে ক্রয় আইনের লঙ্ঘন পাওয়া গেছে। তাই কেনাকাটার কার্যক্রম এগিয়ে নিলে আইনের ব্যত্যয় হবে এবং অর্থ ব্যয় আইনসিদ্ধ হবে না বলে অনুমেয় হয়েছে ।
দুদকের মতামত পাওয়ার চার দিনের (২২ জুন) মাথায় ফয়েজ আহমদ আবার সংস্থাটির চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন। এতে তিনি নানা যুক্তি তুলে ধরে বলেন, বিটিসিএলের প্রকল্পটির কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত মনোযোগ ও আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।
বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য জানতে ১৬ জুলাই ফয়েজ আহমদ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হয়। পরে ফয়েজ আহমদকে ফোন ও খুদেবার্তা পাঠানো হয়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ফোনে বিষয়টি জানানো হয়। গত রোববার আইসিটি বিভাগে গেলে অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে জানানো হয়, ফয়েজ আহমদ অফিসে উপস্থিত নেই। তখন আইসিটি বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) মুহম্মদ জসীম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি লিখিত বক্তব্য পাঠাবেন বলে জানান। যদিও গতকাল শনিবার পর্যন্ত বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জসীম উদ্দিন গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে ৭ জুলাই ফয়েজ আহমদ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সেটাই তাঁর বক্তব্য।
ওই দিন ফয়েজ আহমদ বলেছিলেন, বিটিসিএলের সক্ষমতা সম্প্রসারণ করা দরকার। না হলে প্রতিষ্ঠানটি বাজারে টিকে থাকতে পারবে না। তিনি আরও বলেছিলেন, তিনি দুদক চেয়ারম্যানের আন্তরিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন। এর বাইরে কোনো নির্দেশ দেননি।
ফয়েজ আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে আরও নানা কথা বলেন। অবশ্য প্রথম আলোর সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। সেগুলোর উত্তর পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, দুদক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মধ্যে চিঠি-চালাচালি চলার মধ্যে (১৬ এপ্রিল, ২০২৫) বিটিসিএল হুয়াওয়ের কারখানা পরিদর্শনের জন্য আবার ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে চিঠি লেখে। সেই চিঠিতে নিয়মবহির্ভূতভাবে চারজনের জায়গায় পাঁচজনকে কারখানা পরিদর্শনে পাঠানোর জন্য জিও জারির অনুরোধ করা হয়। নতুন দলে বিটিসিএলের প্রকৌশলী রাখা হয় দুজন, আর টেলিযোগাযোগ বিভাগের তিনজন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টেলিযোগাযোগ বিভাগের কর্মকর্তাদের খুশি রাখতে তাঁদের চীন সফরে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। যদিও তাঁদের চীন যাওয়া হয়নি। কারণ, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জিও (সরকারি আদেশ) জারির বিষয়টি আটকে দেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে চায়নিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন মেম্বারস ইন বাংলাদেশ নামের অপরিচিত একটি সমিতির খরচে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব তাঁর একান্ত সচিবসহ ৬ মে থেকে ৪ দিন চীন সফর করেন। জিওতে বলা হয়, তিনি আইসিটি অবকাঠামো নিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে যাবেন।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ মে হুয়াওয়ে বিটিসিএলকে দেওয়া একটি চিঠিতে জানায়, কারখানা পরিদর্শনের অনুমতি সরকারের সর্বোচ্চ মহল দেয়নি বলে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে জেনেছে। তাই তারা নিজেরাই যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে সনদ জমা দেবে। আবার ১৯ মে জানায়, যেহেতু কারখানা পরিদর্শন হচ্ছে না, তাই এ বাবদ বরাদ্দ অর্থ সমন্বয় করা হবে। হুয়াওয়ে পণ্য জাহাজীকরণের অনুমতির অনুরোধও জানায়।
নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, হুয়াওয়ে ১৫ মে তারিখের যে স্মারকের চিঠির কথা উল্লেখ করেছে, তা বিটিসিএল ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মধ্যে আদান-প্রদান করা। এ চিঠি কীভাবে হুয়াওয়ে পেল, তা জানতে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ কার্যালয় থেকে প্রথম আলোকে লিখিত বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। তারা দাবি করেছে, তারা গত ১৫ মে প্রকল্প দপ্তর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে (ফরোয়ার্ডিং) একটি চিঠি পায়। সেই চিঠির মাধ্যমেই তারা জানতে পারে যে কারখানা পরিদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
বিটিসিএলের দাপ্তরিক চিঠি কীভাবে হুয়াওয়ের কাছে গেল, তা জানতে বিটিসিএলের কাছে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হয় ২১ জুলাই। গতকাল পর্যন্ত তার জবাব পাওয়া যায়নি।
এদিকে বিটিসিএল যন্ত্রপাতি জাহাজিকরণের অনুমতি চেয়ে হুয়াওয়ের চিঠির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মতামত চায়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ গত ২৫ মে বিটিসিএলকে দেওয়া এক চিঠিতে ফয়েজ আহমদের নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যন্ত্রপাতি ফাইভ-জির উপযোগী কি না এবং ১২ বছর সেবা দেবে কি না, তা বিশেষজ্ঞ দল দিয়ে যাচাই করা হবে। আবার হুয়াওয়ের দেওয়া প্রস্তাব মেনে নিয়ে চুক্তির জিসিসি ক্লজ ৩৮ দশমিক ৪ (কারখানা পরিদর্শন ছাড়া সরবরাহ-সংক্রান্ত) অনুযায়ী পণ্য জাহাজীকরণ করবে বলে জানান। নিয়ম হলো, কারখানায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা অসম্ভব হলেই কেবল বিটিসিএল ক্রেতা হিসেবে কারখানায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে সরঞ্জাম জাহাজীকরণের অনুমতিপত্র দেবে। কিন্তু তারা তা দেয়নি; বরং ফয়েজ আহমদের নির্দেশনা সমন্বিত ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের চিঠিটি সরাসরি হুয়াওয়েকে পাঠিয়ে দেন প্রকল্প পরিচালক (২৬ মে)।
এ সুযোগে হুয়াওয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে সরঞ্জাম পাঠিয়ে দেয়। বিষয়টি চিঠি পাঠিয়ে বিটিসিএলকে জানায় তারা (১৬ জুন। হুয়াওয়ের চিঠি অনুযায়ী, যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর সম্ভাব্য দিন ছিল ২২ জুন। অবশ্য সরঞ্জাম চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে কি না, নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, তাদের কাছে আমদানির কোনো নথি জমা পড়েনি। ফলে টাকা ছাড় করার কোনো প্রশ্ন এখনো আসেনি। দুদক এর আগে তাদের কাছ থেকে নথিপত্র সংগ্রহ করেছে। এমন অবস্থায় আমদানির নথিপত্র জমা পড়লে টাকা ছাড় করবে কি না, তা নিয়ে দোটানায় রয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
যে প্রকল্পের কেনাকাটা দুদক অনুসন্ধান করছে, সেই কেনাকাটার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া দুর্নীতি সহায়ক। সরকার বলছে, সরঞ্জাম না কিনলে বড় লোকসান হবে। সে ক্ষেত্রে কি কোনো কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস (ব্যয়ের বিপরীতে সুফল পর্যালোচনা) হয়েছে?ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান‘দুর্নীতি সহায়ক’বিটিসিএল এখন যদি যন্ত্রপাতি গ্রহণ না করে, তাহলে আইনি জটিলতার মুখে পড়তে হতে পারে। অন্যদিকে গ্রহণ করলে তাতে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় ও দুর্নীতির আশঙ্কা রয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, যে প্রকল্পের কেনাকাটা দুদক অনুসন্ধান করছে, সেই কেনাকাটার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া দুর্নীতি সহায়ক। সরকার বলছে, সরঞ্জাম না কিনলে বড় লোকসান হবে। সে ক্ষেত্রে কি কোনো কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস (ব্যয়ের বিপরীতে সুফল পর্যালোচনা) হয়েছে? তিনি বলেন, উচিত ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি দিয়ে প্রকল্পটি পর্যালোচনা করা। সেটা না করে কেনাকাটার দিকে এগিয়ে যাওয়ায় সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে, এ ক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।