জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জুলাই সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেছেন, ‘সে খসড়ায় জাতীয় সনদের পটভূমি, গঠনপ্রক্রিয়া, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন এবং জাতীয় সনদ তৈরি প্রক্রিয়ার বিষয়ে যে বর্ণনা আমরা সেটা রেখেছি।’

আজ সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২০তম দিনের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন আলী রীয়াজ। সনদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে এবং যেসব বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেগুলো আমরা অন্তর্ভুক্ত করিনি। কারণ হচ্ছে এগুলো এখন পর্যন্ত আলোচনা হচ্ছে। যদিও প্রথম পর্যায়ে অনেকগুলো বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, কিন্তু সে বিষয়গুলোর সঙ্গে এখন যে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, সেগুলো জড়িত থাকার ফলে এই মুহূর্তে আমরা একমত হওয়া বিষয়গুলোকেও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠাচ্ছি না। আমরা মনে করছি, সমন্বিতভাবে দিলে কাজের জন্য সুবিধাজনক হবে।’

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা তাদেরকে অনুরোধ করেছি ৩০ জুলাই বুধবার দুপুর ১২টার মধ্যে তাদের যদি কোনো সুপারিশ থাকে, পরামর্শ থাকে, পরিবর্তনের কথা তারা বলতে চায় সেগুলো আমাদেরকে জানানোর জন্য। আমরা আশা করছি, পরামর্শগুলোকে সমন্বিত করে সনদের টেক্সটা ওই দিনই তৈরি করতে পারব। ইতিমধ্যে আলোচনায় যেহেতু অগ্রগতি হচ্ছে, যেসব বিষয়ে মতৈক্য হবে, সেগুলো তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।’ তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এই সনদের ব্যাপারে অঙ্গীকারের বিষয়গুলোকে উল্লেখ করেছি। যদি রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকারের সঙ্গে আর কিছু যোগ করতে চায়, পরামর্শ দেয়, সেটি নিয়ে কাজ করা হবে।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে চলমান রাজনৈতিক সংলাপে সোমবারের বৈঠকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপ্রক্রিয়া এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।

আজকের আলোচনা দুটি নির্ধারিত বিষয়ের ওপর ছিল বলে জানান আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, একটি হলো সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও ন্যায়পাল নিয়োগ; অন্যটি সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব—যদিও দ্বিতীয় বিষয়ে আলোচনা শুরু করা সম্ভব হয়নি।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, সরকারি কর্ম কমিশনের নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল সংবিধানের ১৩৭ অনুচ্ছেদ সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে বিএনপি ও কয়েকটি দল নিয়োগবিধান আইনের মাধ্যমে নির্ধারণের পক্ষে অবস্থান জানিয়েছে। তিনি বলেন, ‘নিয়োগপ্রক্রিয়া কীভাবে নির্ধারিত হবে, সে বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও পিএসসিকে স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে।’

দুদককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের প্রস্তাবকে বেশির ভাগ দল সমর্থন করলেও বিএনপি ও কয়েকটি দল ভিন্নমত দেয়। তবে সংশোধনীসহ আলোচনা এগোচ্ছে বলে জানান অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

জুলাই সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক আলী বলেন, ‘সেখানে কেবল ইতিমধ্যে যেসব বিষয়ে একমত হওয়া গেছে, সেগুলো রাখা হয়েছে। এখনো আলোচনাধীন বিষয়গুলো পরবর্তী সময়ে সমন্বিতভাবে সংযোজন করা হবে।’

বৈঠকের একপর্যায়ে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে হঠাৎ ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠে, ফলে কিছু সময়ের জন্য আলোচনা স্থগিত রাখতে হয়। এ ঘটনাকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘জাতীয় নেতৃবৃন্দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একাডেমির দায়িত্ব ছিল। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে।’

এ বিষয়ে ফরেন সার্ভিস একাডেমির রেক্টরের সঙ্গে বৈঠক করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি। রেক্টর ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন এবং প্রতিবেদন শিগগিরই দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন।

সন্ধ্যার দিকে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগসংক্রান্ত একটি নতুন প্রস্তাব মৌখিকভাবে উপস্থাপন করা হয়। তারা ‘র‌্যাংক চয়েস’ (বাছাই কমিটির সুপারিশকৃতদের ক্রম অনুসারে) পদ্ধতি মেনে নিতে আগ্রহ দেখালেও সেটি গোপন ব্যালটের পরিবর্তে ওপেন ব্যালটে করার প্রস্তাব দেন।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সব রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে একমত। তবে নিয়োগ কমিটির সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়া নিয়ে ভিন্নমত রয়ে গেছে।’ তিনি আরও জানান, বিএনপি এখনো এই প্রস্তাব পুরোপুরি মেনে নেয়নি। তবে কমিশন আশাবাদী যে আগামীকাল সকালের মধ্যেই এ বিষয়ে একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

আজকের বৈঠকে সময়স্বল্পতার কারণে সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আলোচনা করা যায়নি। তবে আগামী দুই দিনের মধ্যে এ বিষয়েও আলোচনা হবে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

আজকের আলোচনা শেষে প্রতিদিনকার মতো সাংবাদিকদের ব্রিফ না করে বেরিয়ে যায় বিএনপি। এর আগে সকালে আলোচনা শুরুর কিছুক্ষণ পর বৈঠক থেকে ওয়াকআউট করে দলটি। অবশ্য কিছুক্ষণ পর আবার সংলাপে অংশ নেয় তারা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রস ত ব ই সনদ র এক ড ম প রক র রক র য় ব এনপ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ঐকমত্য কমিশনের কাজ সফলভাবে শেষ হওয়ায় প্রধান উপদেষ্টার অভিনন্দন

সাফল্যের সঙ্গে সব সক্রিয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লাগাতার বৈঠকের মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি ও বাস্তবায়নের রূপরেখা নির্ধারণ করায় জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সদস্যদের অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

বাসস লিখেছে, বাংলাদেশে একটি স্থায়ী জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে ঐকমত্য কমিশনের যাত্রা শুরু হয় চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি, যার মেয়াদ শেষ হয় ৩১ অক্টোবর।

আরো পড়ুন:

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ, নির্বাচনি প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা

সমবায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল দেশ গড়া সম্ভব 

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ আমাদের ঐতিহাসিক অর্জন। এই সনদ আমাদের জাতির এক মূল্যবান দলিল, যা আমাদের আগামী জাতীয় নির্বাচনের পথকে কেবল সুগমই করবে না, জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে এবং আমাদের গণতন্ত্রকে সুসংহত করবে।”

প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, “জনগণ প্রত্যাশায় আছে জাতীয় জীবনে এমন কিছু পরিবর্তন দেখার জন্য, যা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাবে; এমন কিছু পরিবর্তন যা এদেশে আর কখনো কোনো স্বৈরাচারের আগমন ঘটতে দেবে না, এমন কিছু পরিবর্তন যা আমাদের জাতীয় জীবনে সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটাবে, সবার নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করবে।”

“সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে, আমরা নিজেরাই এই সংস্কার প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে কাজ করেছি, একমত হয়েছি। বাইরের কেউ আমাদের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়নি,” বলেন প্রধান উপদেষ্টা।

‘অতীতে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে যে সমস্ত রাজনৈতিক সংলাপ হয়েছে, তাতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আমরা বিদেশিদের আসতে দেখেছি’ জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “বন্ধু রাষ্ট্রসহ জাতিসংঘের প্রতিনিধিবৃন্দ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে আনার চেষ্টা করেছেন। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে যে, আমাদের নিজেদের সংকট নিজেদেরই সমাধান করতে হবে।”

“এই কারণেই সকল রাজনৈতিক দল এক কাতারে এসেছে, রাজনৈতিক বিতর্কে অংশ নিয়েছে এবং আমাদেরকে সমাধানের পথ দেখিয়েছে। বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আমন্ত্রণ জানানোর পরিবর্তে আমরা নিজেরাই বিশ্ববাসীর দরবারে আমাদের জাতীয় ঐক্যকে তুলে ধরেছি,” বলেন তিনি। 

প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলকে এবং তাদের নেতৃবৃন্দকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “রাজনৈতিক দলের নেতারা যারা এই সনদ তৈরিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তাদের সকলকে আমি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।”

এই জুলাই সনদ সারা বিশ্বের জন্যই একটি অনন্য দৃষ্টান্ত বলে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “পৃথিবীর আর কোথাও এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটা পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ঘটনা হয়ে থাকবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশও সংকটকালীন সময়ে দেশগঠনের পদক্ষেপ হিসেবে ‘ঐকমত্য কমিশন’ গঠনের কথা বিবেচনা করবে।”

প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক ও ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া এবং বিশেষ সহকারী মনির হায়দারকে ধন্যবাদ জানান। এর পাশাপাশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ যারা মাসের পর মাস এই দীর্ঘ আলোচনার সঙ্গে থেকেছেন, ঐকমত্য কমিশনের সকল কার্যকলাপ মানুষের কাছে সহজ ভাষায় পৌঁছে দিয়েছেন, তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান প্রধান উপদেষ্টা।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে, যে অভূতপূর্ব ঐক্য আমাদের মাঝে রয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারে এই জাতীয় ঐক্য আমাদের ধরে রাখতেই হবে। কারণ ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী এ জাতিকে বিভক্ত করতে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছে। গত ১৫ মাস আমরা তাদের নানা ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করেছি। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করতে হলে, এই দেশকে বাঁচাতে হলে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নাই।”

‘দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ আছে’ বলে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কোনো একক ব্যক্তি, একক সংগঠন, একক সংস্থা অথবা একক সরকার দিয়ে সম্ভব হবে না; এজন্য সকল রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মধ্যে একতা থাকতে হবে, যত প্রতিকূলতাই আসুক না কেন ঐক্য ধরে রাখতে হবে।”

ঢাকা/রাসেল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো কেন
  • সনদ বাস্তবায়নে দ্রুত সিদ্ধান্ত, আরপিওতে পরিবর্তন আসছে
  • ঐকমত্য কমিশনের কাজ সফলভাবে শেষ হওয়ায় প্রধান উপদেষ্টার অভিনন্দন
  • তড়িঘড়ি না করে সংবিধান সংস্কারে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান
  • কিছু রাজনৈতিক দল ঐকমত্য কমিশনে গিয়ে ফাঁদে পড়েছে: জাপা মহাসচিব
  • ঐকমত্য কমিশন হাজির করেছে অনৈক্যের দলিল: বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন
  • জুলাই সনদ নিয়ে জট খুলুন, সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে
  • সমস্যা সমাধান করে নির্বাচনের পথে এগোন: অন্তর্বর্তী সরকারকে মির্জা ফখরুল
  • অধ্যাপক আলী রীয়াজের নতুন বই প্রকাশিত
  • সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক, কতটা যৌক্তিক