জুলাই সনদ নিয়ে নতুন সংকট, ‘অতি জরুরি’ বৈঠক সন্ধ্যায়
Published: 15th, October 2025 GMT
জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে এই অনিশ্চয়তায় তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে।
এমতাবস্থায় আজ বুধবার সন্ধ্যা ছয়টায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ‘অতি জরুরি’ বৈঠক ডেকেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর আগে কমিশনের সদস্যরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে।
ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। আগামী শুক্রবার এই সনদ সই হওয়ার কথা। গতকাল মঙ্গলবার রাতে সনদের চূড়ান্ত অনুলিপি দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি। এ বিষয়ে কমিশন আলাদা সুপারিশ দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সনদ বাস্তবায়নে গণভোট করার বিষয়ে একমত হলেও ভোটের দিন ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা আছে। কোনো কোনো দল সনদে সই করার আগে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে নিশ্চয়তা চায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল মঙ্গলবার রাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সেখানে দলটির পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থান তুলে ধরা হয়। ‘সংবিধান আদেশ’ জারির মাধ্যমে সংস্কার প্রক্রিয়া আগানো না হলে এনসিপি সনদে সই করবে না বলে ওই বৈঠকে জানানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এনসিপি বলছে, তারা মনে করে এর আগে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের সময় তারা ছাড় দিয়েছে। এবার আর ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা সংস্কার বিশেষ করে সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে নতুন করে পুরো আলোচনা শুরু করার পক্ষে।
এদিকে চূড়ান্ত করা জুলাই সনদে বাস্তবায়নের পন্থা উল্লেখ না থাকায় এই সনদে জামায়াতে ইসলামী সই করবে কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে। তবে এ বিষয়ে দলটি এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়নি। আজ রাতে এ নিয়ে দলটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে বলে দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে।
এই বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নীতি–নির্ধারনী পর্যায়ের এক নেতা আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সনদের চূড়ান্ত কপিটা পেয়েছি আজ সকালে। গড়মিল থাকলে আমরা জানাব। যতটুকুতে আমরা রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে, সেগুলো যদি সনদে উল্লেখ থাকে অবশ্যই আমরা সই করব। তবে যেটা শুনছি, এই সনদ নিয়ে নানামুখী অপতৎপরতা আছে।’
এ ছাড়া বামপন্থী একাধিক দলও সনদে সই না করার আশঙ্কা আছে। অন্যদিকে বিএনপি সনদের অঙ্গীকার অংশে একটি ধারা যুক্ত করার প্রস্তাব করেছিল। কমিশন সেটা করেনি।
ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। এর খসড়া চূড়ান্ত হলেও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। এ কারণে আটকে আছে জুলাই সনদ।
গত ৩১ জুলাই সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষ হয়। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরে ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলো ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে। ৯ অক্টোবর এই আলোচনা শেষ হয়। আলোচনায় গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য হয়। কিন্তু গণভোটের ভিত্তি, সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে মতভিন্নতা আছে।
৯ অক্টোবর দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় কমিশন জানিয়েছিল, বিশেষজ্ঞ ও দলগুলোর মতামত সমন্বয় করে কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারকে সুপারিশ করবে। এরপর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির সঙ্গে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে মতপার্থক্য কমাতে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে কমিশন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গণভোটের ভিত্তি কী হবে, গণভোট কি সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে হবে নাকি আগে, গণভোটে কী কী প্রশ্ন থাকবে-এসব বিষয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা এখনো কাটেনি।
ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, আজ সন্ধ্যার বৈঠকে দলগুলো সনদে সই করবে কি না এবং প্রয়োজনে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে আবার আলোচনা হবে। এ আলোচনা বিটিভি নিউজে সরাসরি সম্প্রচার করার কথা আছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, আজ সন্ধ্যায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জরুরি বৈঠক হবে। এর আগে কমিশন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র প রস ত ব র জন ত ক সই করব সন ধ য এনস প ই সনদ গণভ ট ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
দুই প্রশ্নের গণভোটের বিপদ
৩২টি দল মিলে টানা কয়েক মাস সংবিধান সংস্কার নিয়ে ঐকমত্যে আসার চেষ্টা করার পর যেভাবে বৈঠকটির পরিসমাপ্তি টানা হলো, তাতে পুরো সংস্কারপ্রক্রিয়া টালমাটাল হয়ে পড়েছে।
সনদে ৮৪টি প্রস্তাব থাকছে। এর মধ্যে ৩৯টি প্রস্তাব মানে প্রায় অর্ধেক প্রস্তাবে কোনো না কোনো দলের দ্বিমত আছে। ২৫টি প্রস্তাবে আংশিক আপত্তি বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আছে। কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে ৩৯ প্রস্তাবে সবাই সম্মত, সেগুলো একটি তালিকা করে নাগরিকদের সম্মতি বা অসম্মতি জানার জন্য গণভোটে একটি প্রশ্ন থাকবে। সেসব প্রস্তাব নিয়ে টানা দুই মাস আলাপ করে দেশের সব দল ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি, সেগুলো নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন হবে।
নাগরিকদের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলতে হলে তাঁদের তো বুঝতে হবে, কী তাঁরা মত দিচ্ছেন। যেসব বিষয়ে তাঁদের পছন্দের রাজনৈতিক দলগুলো একমত পোষণ করেছে, সেসব বিষয়ে সম্মতি দেওয়াটা সহজ। কারণ, তাঁরা ভেবে নিতে পারেন যে যেসব বিষয়ে সব নেতা একমত হয়ে বসে আছেন, সেখানে তাঁর ‘হ্যাঁ’ বলাতে কোনো ঝুঁকি নেই। প্রতিটি প্রস্তাব নিয়ে তাঁর গবেষণা করার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু যেসব বিষয়ে কোনো না কোনো দল আপত্তি তুলেছে, সেই ব্যালটের কী হবে? কোনো প্রস্তাবে যদি কোনো দলের আপত্তি থাকে, তাহলে একজন নাগরিকের দায়িত্ব হবে সেই প্রস্তাব খতিয়ে দেখা বা তাঁর দল যেদিকে রায় দিয়েছে, সেদিকে থাকা। সে ক্ষেত্রে তাঁর দল যেগুলোতে সায় দিয়েছে, শুধু সেগুলোতে তিনি সম্মতি দিতে চাইবেন। কিন্তু ব্যালটে তিনি যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন, তাহলে যেসব প্রস্তাবে তিনি নিজে বা তাঁর দল সম্মতি দেয়নি, সেগুলোতেও তাঁর সম্মতি দেওয়া হয়ে যাচ্ছে।
আর যদি ‘না’ বলেন, তাহলে যেসব প্রস্তাবে তাঁর নিজের বা দলের সমর্থন আছে, সেগুলো বাতিল হয়ে যাবে। দেখা যাচ্ছে, গণভোটের এই দ্বিতীয় প্রস্তাব কোনোভাবেই কোনো অর্থবহ জনমত বিচার করতে পারবে না। অতএব গণভোটের ব্যালটে এই দ্বিতীয় প্রশ্ন রাখাটা অর্থহীন, অন্যায্য ও অবিবেচনাপ্রসূত।
সংবিধান ‘পিপলস উইল’ বা জনগণে সার্বভৌম ইচ্ছার প্রকাশ। অতএব সেটির ছায়াতলে সবাই এক হবে, সেটিই কাম্য। সেই সংবিধানের জন্যই জাতি যদি বিভাজিত হয়, তাহলে সেটি হবে চরম স্খলন।সংবিধান দেশের আইনের ভিত্তি। এ জন্য সেটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হওয়া বাধ্যতামূলক। দেশের একটি ছোট অংশও যদি মনে করে যে তাদের জন্য এই সংবিধান অন্যায্য, তাহলে ঐক্যের বদলে সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যায্য না হলেও যদি জনমত সংবিধানের পক্ষে না থাকে, তবে যত ভালো বিশেষজ্ঞ দিয়েই সংবিধান তৈরি হোক না কেন, সেই সংবিধান দেশের কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে পারে না।
কমিশনের বৈঠকে এই প্রস্তাব নিয়ে কোনো আলাপ না করে কমিশন শেষে এসে এককভাবে গণভোটে দুটি প্রশ্ন নিয়ে নাগরিকদের কাছে রায় চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তারা শুধু বলল, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে এই কাজ করা হলো। বিশেষজ্ঞদের অজুহাত দিয়ে এ রকম অস্বচ্ছ গণভোট চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা খুবই অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত।
সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো যদি ধরে নিই, দেশের মানুষ পার্টি লাইনে বা দলীয়ভাবে বিভক্ত, তাহলে বিএনপি যেখানে আপত্তি দিয়েছে, সেটি হ্যাঁ ভোটে পাস হলে দেশের একটি বড় অংশ এই সংবিধান সংস্কারের বিপক্ষে চলে যাবে।
সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে একই সমস্যায় আমরা পড়ব। দেশের এক অংশের মানুষের কাছে চারটি মূলনীতি তাঁদের দেশভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। সেটি নিয়ে তাঁরা যে আপস করবেন না, সেটি কমিশনেই তাঁরা ওয়াকআউট করে জানিয়েছেন। এসব বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়ে পাস করিয়ে নিলে দেশের মানুষ বিভাজিত হবেন। তখন দেশকে মূল্য দিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা দিয়ে।
সংবিধান ‘পিপলস উইল’ বা জনগণে সার্বভৌম ইচ্ছার প্রকাশ। অতএব সেটির ছায়াতলে সবাই এক হবে, সেটিই কাম্য। সেই সংবিধানের জন্যই জাতি যদি বিভাজিত হয়, তাহলে সেটি হবে চরম স্খলন।
ভিন্নমত ও নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে যত কষ্টই হোক, ঐকমত্যে পৌঁছানো ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। আমাদের বুঝতে হবে যে সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের জন্য ঐকমত্যে পৌঁছানোর তুলনায় বিলম্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নয়। ইতিহাস আমাদের শেখায় টেকসই সংবিধান করতে দু–তিন বছর ধরে আলাপ করাটাই শ্রেয়। নেপাল রাজতন্ত্র বিলোপের সংবিধান করতে নেয় ৯ বছর। আর ইন্দোনেশিয়া তাদের স্বৈরাচার আমলের সংবিধান সংস্কার করতে নিয়েছিল তিন বছর। আমাদের আর এক বছর এই আলাপ করার জন্য তৈরি থাকতে হবে।
আমাদের দেশকে স্থিতিশীল রাখতে ও জাতীয় ঐক্য তৈরি করতে সামনের গণভোট জুলাই সনদকে জন–আকাঙ্ক্ষা হিসেবে বৈধতা দেবে এবং পরবর্তী সংসদকে সেই সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার করার ক্ষমতা দেবে। যেসব প্রস্তাবে সব দলের ঐকমত্য আছে, সেসব প্রস্তাব দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাস করবে; যেসব বিষয়ে আপত্তি আছে, সেসব বিষয়ে আগামী সংসদকে প্রয়োজনীয় আলাপ করে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। সেই চেষ্টা ঐকমত্যের কাছাকাছি পৌঁছালে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য দুই–তৃতীয়াংশের সম্মতিতে পাস করবেন।
আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে ঐকমত্য কমিশনকে মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র খুব নাজুক পরিস্থিতিতে আছে। অতএব সমস্যার সমাধানের দিকে না থেকে সমস্যার কারণ হয়ে উঠলে দেশ মহা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। ইতিহাস এ প্রক্রিয়াকে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবেই চিহ্নিত করবে। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি ডেকে না এনে, তাড়াহুড়া না করে দুই ধাপে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করাই এখন কমিশনের কর্তব্য।
সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কর্মী
মতামত লেখকের নিজস্ব