ভর্তি পরীক্ষার সময় মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যা করবেন
Published: 16th, November 2025 GMT
কী কী সমস্যা দেখা যায়
যেকোনো পরীক্ষাই আমাদের চাপে ফেলে। চাপে পড়ে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ—এ সময়ে খুব স্বাভাবিক। কোথাও যদি সুযোগ না পাই, তাহলে কী হবে, মা বাবা কী বলবে, ভবিষ্যতে কী হবে! এসব ভাবনা মাথায় আসতেই পারে।
পড়াশোনায় অমনোযোগ আসতে পারে। একটানা পড়া কঠিন মনে হতে পারে।
বন্ধুরা ভালো করছে, ভালো কোচিংয়ে পড়ছে, মডেল টেস্টে ভালো নম্বর পাচ্ছে—এমন তুলনা মনে আসতেই পারে। এতে চাপ আরও বাড়ে। অভিভাবকেরাও অনেক সময় অন্যের সঙ্গে তুলনা করে মনের চাপ বাড়িয়ে দেন।
অনেক শিক্ষার্থী এ সময় ঘুমের সমস্যায় পড়েন। রাতে ঘুম হয় না। শরীর ক্লান্ত লাগে। অনেকে আবার দীর্ঘ সময় ধরে ল্যাপটপ বা মুঠোফোন ব্যবহার করেন, এটিও ঘুমের সমস্যার কারণ।
মেজাজ খিটখিটে হতে পারে। সামান্য কারণেই রাগ হয়। খুব দ্রুত হতাশ হয়ে পড়তে পারেন।
মানসিক চাপের প্রভাব শরীরেও পড়ে। যেমন মাথাব্যথা, পেটে সমস্যা, ক্ষুধা কমে যাওয়া ইত্যাদি।
আরও পড়ুনপড়ালেখা থেকে দূরে ছিলেন ৫ বছর, তিনিই প্রথম হয়েছিলেন ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায়২০ অক্টোবর ২০২৪কোন সমস্যার লক্ষণ কীনিজের বা বন্ধুর মধ্যে কিছু লক্ষণ দেখলে সতর্ক হতে হবে। মন অতিরিক্ত উদ্বেগে আক্রান্ত হলে বুক ধড়ফড়, ঘন ঘন হাত-পা কাঁপা, সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় সব সময় মন খারাপ থাকে। কোনো কিছুতেই আগ্রহ আসে না, কান্না আসে। আবার অনেকের জন্য অনিদ্রাও নিত্যকার বিষয়। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না বা মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। দীর্ঘ সময় ক্লাস বা পড়াশোনার কারণে শারীরিক ক্লান্তি আসে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়ার পরও থেকে যায়। পড়ায় মনোযোগ দেওয়া যায় না। অনেকেই এ সময় বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে চান না। একা থাকতে চান।
ভালো থাকার উপায়ফোকাস ও মাইন্ডফুলনেস ধরে রাখতে নিচের চর্চাগুলো করতে পারেন—
সময় ভাগ করে পড়ুন। পড়ার জন্য নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করে নিন। কখন কী পড়বেন, সম্ভব হলে আগেই ঠিক করে নিন।
ছোট ছোট লক্ষ্য ঠিক করুন। এক দিনে সব শেষ করার চিন্তা করবেন না। ছোট ছোট লক্ষ্যই পূরণ করার চেষ্টা করুন।
নিয়মিত বিশ্রাম নিন। টানা না পড়াই ভালো। সম্ভব হলে এক ঘণ্টা পরপর ১০ মিনিটের বিরতি নিন। ‘পোমোডোরো টেকনিক’ নামে একটি পদ্ধতিও অনুসরণ করতে পারেন। এই পদ্ধতি বলে—একটি টাইমার ব্যবহার করে টানা ২৫ মিনিট মনোযোগ দিয়ে পড়ুন, তারপর ৫ মিনিট বিরতি নিন, তবে ৫ মিনিট বিরতি মানে কিন্তু ৫ মিনিট রিলস দেখা নয়।
যখনই চাপ বোধ হবে, চোখ বন্ধ করে কয়েকবার গভীর শ্বাস নিন। শ্বাসসংক্রান্ত ব্যায়াম ইউটিউব থেকে শিখে নিতে পারেন। এটি মন শান্ত করবে।
পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে। প্রতিদিন ৬-৭ ঘণ্টা ঘুম খুব জরুরি। ঘুম মস্তিষ্ককে সতেজ করে।
স্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে নজর দিন। ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন। ফল, সবজি বেশি বেশি খান। পর্যাপ্ত পানি পান করুন। হাতের কাছে পানির বোতল রাখুন।
হাঁটুন, ব্যায়াম করুন প্রতিদিন। অল্প করে হলেও। এতে শরীর ও মন ভালো থাকবে। আবার বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটাহাঁটি করলে কে কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা নিয়ে আলাপ করতে পারেন।
ইতিবাচক চিন্তা করুন। বারবার নিজেকে বলুন, আমি পারব। আত্মবিশ্বাস রাখুন।
আরও পড়ুনভর্তি পরীক্ষায় প্রথম সাইফা: এমন কোনো দিন ছিল না, যেদিন পড়ালেখা করিনি ১১ মার্চ ২০২৫এ সময় যা করা উচিত নয়বন্ধু বা অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। সবার পথ আলাদা, প্রস্তুতিও আলাদা।
শেষ মুহূর্তে নতুন কিছু পড়ার প্রয়োজন নেই। পরীক্ষার ঠিক আগে নতুন কিছু মুখস্থ করতে যাবেন না। যা আগে পড়েছেন, তা-ই ঝালিয়ে নিন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় কাটাবেন না। এটি মনোযোগ নষ্ট করে।
অতিরিক্ত ক্যাফেইন এড়িয়ে চলুন। খুব বেশি চা বা কফি পান করবেন না। এতে ঘুম কম হয়, দুশ্চিন্তা বাড়ে।
অতিরিক্ত রাত জাগা বাদ দিতে হবে। ভালো হয় ভোরে হাঁটার অভ্যাস করতে পারলে।
নেতিবাচক চিন্তা পরিহার করুন। আমার কিছুই হবে না, এমন ভাবনা মনে আনবেন না।
পরীক্ষার সময়জোরদার প্রস্তুতির পরও অনেকে ভর্তি পরীক্ষায় নিজের সেরাটা দিতে পারেন না কেবল মনোসংযোগের অভাবে। মানসিক চাপ সামলে নিতে পারলে আমাদের চিন্তাভাবনা স্পষ্ট থাকে। কঠিন প্রশ্নেও মাথা ঠান্ডা রেখে উত্তর দেওয়া যায়। মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করে। প্রশ্ন দেখে উত্তর মনে করতে সময় কম লাগে।
মনে রাখবেন, পরীক্ষার হলে নার্ভাস হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি চাইলে এই উদ্বেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। গভীর শ্বাস নিন। ইতিবাচক চিন্তা করুন। চাপে থাকলে অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়, সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। মন শান্ত থাকলে সময় ভাগ করে নেওয়া সহজ হয়। কোন প্রশ্নে কতটুকু সময় দেবেন, সিদ্ধান্ত নিন।
কোনো প্রশ্ন কঠিন লাগলে বা উত্তর ভুলে গেলে অনেকে হতাশ হয়ে যান। সুস্থ মন দ্রুত সেই হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। পরবর্তী প্রশ্নে ফোকাস করা সহজ হয়।
আরও পড়ুনজীবনের একটা বড় শখ ছিল ভর্তি পরীক্ষা দেব: তাসনিয়া ফারিণ০৯ নভেম্বর ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ক ষ র মন য গ সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
রওশন জাহান: বোন, শিক্ষক ও সহযোদ্ধা
রওশন জাহান বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে গবেষকদের অন্যতম অগ্রদূত। ৪ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। রওশন জাহান আমার বোন। আমাদের ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। আমার সঙ্গে বয়সের ব্যবধান চার বছরের। রওশন যেন শিক্ষক হয়েই জন্মেছিলেন। আমি যখন ছোট, যেকোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে ছুটে যেতাম তাঁর কাছেই।
কিছু বাংলা ধ্বনি উচ্চারণে আমার ও ছোট ভাই কবিরের সমস্যা ছিল। রওশনের বয়স তখন আট বা নয় বছর। তবু আমাদের শেখাতে পেরেছিলেন জিব কীভাবে নাড়িয়ে সঠিক উচ্চারণ করা যায়।
রওশন ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। চার বছর বয়সেই পড়াশোনা নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষ করে সাহিত্যে। রওশন কথাবার্তায় পারঙ্গম ছিলেন, সহজেই বন্ধু বানাতে পারতেন। যেসব স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, সবখানেই শিক্ষকরা তাঁর প্রতিভার গুণমুগ্ধ ছিলেন।
আমি ছিলাম তাঁর চার বছরের ছোট। তিনি চাইলেই কেবল সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারতেন, তবু আমাকে অনেক সময় দিয়েছেন। একসঙ্গে খেলেছেন, গল্প শুনিয়েছেন, বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ শিখিয়েছেন। এমনকি শিখিয়েছেন সাহিত্যও।
আমরা একটি অভিন্ন শৈশবের অংশ ছিলাম। একসঙ্গে থেকেছি স্কুল ও কলেজজীবনজুড়ে। এরপর এল ১৯৬১ সাল। ফুলব্রাইট শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চশিক্ষার জন্য রওশন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমালেন।
শুধু পড়াশোনায়ই নয়, রওশন অন্যান্য ক্ষেত্রেও অসাধারণ ছিলেন। স্কুলে তিনি নাটকে অভিনয় করেছেন, কুমিল্লায় ওস্তাদ আয়াত আলী খানের কাছে শিখেছিলেন সংগীত। সিনেমা আর খেলাধুলাতেও তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। মনে পড়ে, একবার কলকাতার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ঢাকায় এসেছিল ফুটবল খেলতে। রওশন আর আমি মাঠে খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। পুরো দর্শকভর্তি স্টেডিয়ামে শুধু আমরা দুজনই ছিলাম মেয়ে। সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে রওশন কখনোই দ্বিধা করতেন না।
রওশন জীবনের সহজ আনন্দগুলো থেকেই সুখ পেতেন। রওশন জাহান ছিলেন আমার প্রথম শিক্ষক। তিনি আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন নিজস্ব সীমানার বাইরের এক বিশাল পৃথিবীর দিকে। আমার সৌভাগ্য যে এমন একজন অসাধারণ মানুষ আমার জীবনে এসেছিলেন এবং এত বছর আমার সঙ্গী হয়ে ছিলেন।ইংরেজি সাহিত্যে এমএ শেষ করে রওশন স্বল্প সময়ের জন্য ইডেন মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। পরে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কিন শিক্ষার্থীদের রওশন বাংলা শেখাতেন। তাঁদের অনেকে আজও তাঁকে স্নেহভরে মনে রেখেছেন। ৯২ বছর বয়সেও অধ্যাপক র্যালফ নিকোলাস কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলেছিলেন, রওশনই তাঁকে বাংলা শিখিয়েছিলেন। তাঁর শেখানো বাংলা পাঠের রেকর্ডিং বহু বছর ধরে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহৃত হয়েছে।
শিকাগোতেই রওশনের সঙ্গে পরিচয় হয় মোজাফ্ফর আহমদের। মোজাফ্ফর তখন অর্থনীতিতে পিএইচডি করছিলেন। ১৯৬৬ সালে রওশন ঢাকায় ফিরে আসার পর তাঁরা একত্রে আবদ্ধ হন যৌথ জীবনে। আমি তাঁদের বিয়েতে থাকতে পারিনি। কারণ, তখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছিলাম।
বিয়ের পর রওশন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ফিরে যাননি। আমি সব সময় মনে করেছি, তাঁর এই সিদ্ধান্ত জাতির জন্য এক বিরাট ক্ষতি হয়েছে। কয়েক প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা এক উত্তম শিক্ষকের কাছ থেকে শেখার সুযোগ হারিয়েছে। কারণ, ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্য এবং ভাষাবিজ্ঞানের অসাধারণ সব গবেষক তৈরি করতে পারতেন রওশন। মানুষকে কিছু শেখানোর এক বিস্ময়কর দক্ষতা ছিল তাঁর।
১৯৭৩ সালে আমি নারীদের নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ নিলে তাঁকে আমাদের সাপ্তাহিক পাঠচক্রে যোগ দিতে অনুরোধ করি। রওশন সঙ্গে সঙ্গে রাজি হন। সে বছরই উইমেন ইন বাংলাদেশ শিরোনামে ইংরেজিতে আমার প্রথম প্রবন্ধটি লিখি। রওশন সেটি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, যাতে তা আরও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছায়।
পরে আহমদ ছফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে এক বড় আলোচনার আয়োজন করেন। সেখানে আমি প্রবন্ধটি বাংলায় উপস্থাপন করি। রাজিয়া খান আমিন ও সুরাইয়া খানম ছিলেন আলোচক।
১৯৭৫ সালে আমরা পাঠচক্রের গ্রুপটিকে একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) হিসেবে নিবন্ধন করি। নাম দিই উইমেন ফর উইমেন। একই নামে একটি বইও প্রকাশ করেছিলাম। সেখানে রওশন ‘বাংলা সাহিত্যে নারী’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। রওশন পরে সংগঠনটির সভাপতি হন। গবেষণা ও লেখালেখির মাধ্যমে দুই দশক ধরে এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটিকে সক্রিয় রাখেন।
১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে তিনি নানা বিষয়ে গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন, একই সঙ্গে বহু বই প্রকাশ করেন। সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেও তাঁর গবেষণার পরিসর ছিল বিস্তৃত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, পরিবেশ, আন্দোলন ও রাজনীতি, শ্রমিকের কর্মপরিস্থিতি, নারীর প্রতি সহিংসতা—সব বিষয়েই তিনি কাজ করেছেন।
তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত প্রকাশনা বেগম রোকেয়ার সুলতানাস ড্রিম-এর সম্পাদিত ইংরেজি সংস্করণ। বইটি নিউইয়র্কের ফেমিনিস্ট প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার অধ্যয়ন কোর্সে দীর্ঘদিন পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আজও বইটির চাহিদা ব্যাপক।
রওশন রোকেয়ার অবরোধবাসিনীর অংশবিশেষ এবং আহমদ ছফার ওঙ্কার ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন।
গবেষণা ও লেখালেখির পাশাপাশি রওশন নানা নারীবিষয়ক ও নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, সিএএমপিই, এডুকেশন ওয়াচ এবং বাংলা-জার্মান সম্প্রীতির মতো সংগঠনগুলোতে তিনি বহু বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের বহু প্রতিবেদনের তিনি লেখক বা সম্পাদক। রওশন কখনোই প্রচারের আলোয় আসতে চাননি। তিনি ছিলেন নেপথ্যের নীরব কর্মী, কিন্তু
অত্যন্ত কার্যকর।
রওশন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বহু সম্মেলনেও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। আমরা দুজন মিলে ১৯৮৫ সালে নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের নারী সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলাম। পরে ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে চতুর্থ জাতিসংঘ নারী সম্মেলনে আমরা তিন বোন—রওশন, নিলুফার ও আমি একসঙ্গে যোগ দিই। রওশন ও নিলুফার শুধু আমার বোনই ছিলেন না, ছিলেন আমার সহযোদ্ধাও। একই লক্ষ্য ও স্বপ্নের জন্য আমরা একসঙ্গে লড়েছি। রওশনের কন্যা সোহেলা নাজনীনও এখন যোগ দিয়েছে একই মহৎ সংগ্রামে।
রওশন আর আমার নিবিড় সম্পর্ক অনেকের কাছেই বিস্ময়কর লাগতে পারে। কারণ, আমাদের ব্যক্তিত্ব ছিল একেবারেই ভিন্ন। রওশন ছিলেন সত্যিকারের সদয় ও বিনয়ী মানুষ। কখনো কাউকে কষ্ট দিতেন না, নিজেকে কখনো সামনে আনতেন না—প্রায় সন্তের মতো একজন মানুষ। আর আমি ছিলাম একেবারে উল্টো। তবু আমাদের মধ্যে কখনো ঝগড়া হয়নি, মূলত রওশন এত প্রীতিপূর্ণ ও ক্ষমাশীল ছিলেন বলেই।
তাঁর চলে যাওয়া আমার জীবনে এমন এক শূন্যতা রেখে গেছে, যা কখনো পূরণ হবে না। বাকি জীবনের প্রতিমুহূর্তেই আমি তাঁকে গভীরভাবে অনুভব করব। তবে একই সঙ্গে আনন্দে স্মরণ করব আমাদের একসঙ্গে কাটানো সুখের সময়গুলো। যে বাগানে হাঁটতে হাঁটতে তিনি প্রতিটি গাছ ও ফুল চিনিয়ে দিতেন; আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দেখাতেন আর সেগুলোর নাম বলতেন; বই বা কবিতা পড়ার সময় পুরোটা মুখস্থ বলতেন; কিংবা কোনো গান শুনে গলা মিলিয়ে গাইতেন—সেই সময়গুলো মনে পড়বে।
রওশন জীবনের সহজ আনন্দগুলো থেকেই সুখ পেতেন। রওশন জাহান ছিলেন আমার প্রথম শিক্ষক। তিনি আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন নিজস্ব সীমানার বাইরের এক বিশাল পৃথিবীর দিকে। আমার সৌভাগ্য যে এমন একজন অসাধারণ মানুষ আমার জীবনে এসেছিলেন এবং এত বছর আমার সঙ্গী হয়ে ছিলেন।
● অধ্যাপক ড. রওনক জাহান ডিস্টিংগুইশড ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)