প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আইন থাকলেও বাস্তবায়ন নেই
Published: 20th, January 2025 GMT
দেশে বেশির ভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারা সবচেয়ে বেশি প্রান্তিক অবস্থায় থাকেন। তাদের বেশির ভাগই ন্যূনতম স্যানিটেশন সুবিধা পান না। দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আইন, নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা থাকলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন নেই। ফলে তাদের অধিকার সুরক্ষায় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে আইনের সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন। গত ১৩ জানুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকালের সভাকক্ষে ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও ওয়াশ: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধান কেন গুরুত্বপূর্ণ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। সমকাল ও ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে।
আবু সাঈদ খান
আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও দেশ চাই। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্বপ্ন ছিল এটি। চব্বিশের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্ন আবারও ফিরে এসেছে। সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশ গড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা কীভাবে সমাজের সব ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন– এ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষায়িত সেবা দরকার হয়। সেই বিশেষ সেবা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তি, বেসরকারি এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমাদের এটি নিশ্চিত করতে হবে। কেবল একটি এনজিও নয়, বরং সব এনজিওকে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তাও প্রয়োজন। এনজিওগুলো সবসময় কাজ করতে পারে না। কেননা, প্রকল্পগুলোর সঙ্গে অর্থায়নেরও একটি ব্যাপার আছে। এই জায়গায় সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে।
সারাদেশে অনেক সংগঠন আছে, যেগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। তাদের মধ্য যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে। তাদের একই ছাতার নিচে আনতে হবে। সব ধরনের নীতিমালা কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারণ করে, কাজ বাস্তবায়ন করে স্থানীয় সরকার। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে সঠিক বোঝাপড়া থাকতে হবে। এ ছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়– তা নিয়ে ভাবতে হবে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছাটা গুরুত্বপূর্ণ। দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও, মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণের বিষয়ে তেমন কেউ ভাবে না। এ দেশের ভবন, স্থাপনা ও রাজপথে তাদেরও অধিকার আছে। অথচ এ বিষয়ে আমরা সচেতন নই। এই সচেতনতাবোধ তৈরি করতে হবে।
চন্দন জেড গমেজ
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। শুধু দুর্যোগেই নয়, তারা সারাজীবনই ভুক্তভোগী। তাদের কষ্ট হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। তাদের প্রতি অনেকেই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। আমরা প্রতিবন্ধী সদস্যের প্রতি পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে কাজ করছি। এর জন্য উপযোগী বিভিন্ন কাঠামো প্রতিবন্ধীবান্ধব করে আমরা প্রকল্প ডিজাইন করি। এর সঙ্গে পরিবারগুলোকেও আমরা যুক্ত করছি। একই সঙ্গে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমরা নোয়াখালীতে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পরিবারকে দেখতে যাই। এটি শুনে ওই বাড়ির পাশে অনেক লোক জড়ো হয়। তাদের সঙ্গে কথা বলে কমপক্ষে ১০টি পরিবার পাই, যেখানে একজন করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছেন। এটি শুনে হতভম্ব হয়েছি, একটি গ্রামে যদি ২৫-৩০ জন করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি থাকেন, তাহলে সারাদেশে তার সংখ্যা কত হতে পারে! এসব মানুষের জন্য যদি সরকারের কোনো পরিকল্পনা না থাকে, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। তাদের জন্য সরকারকে কাজ করতে হবে। কেননা সরকার একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল সহায়তা করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় ইস্যু। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। এর মধ্যে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হলেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। তাদের সুরক্ষার বিষয়ে আমাদের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই পরিবর্তনের শুরু হবে।
ড.
বিশ্বে ১৬০ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। প্রতি ছয়জনে একজন মানুষ এর শিকার। এ সংখ্যা নেহাত কম নয়। ওয়াশে প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্রে এসব মানুষের বিশেষ সুবিধার প্রয়োজন। তারা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। যেসব শিশু প্রতিবন্ধিতার শিকার, তারা স্বাভাবিক শিশুর চেয়ে বেশি রোগাক্রান্ত হয়। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য যে ধরনের যত্ন প্রয়োজন, সেগুলোও তারা পান না। স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ৫০ শতাংশ বেশি রোগাক্রান্ত হন। ফলে তারা স্বাস্থ্যহানি ও দারিদ্র্যের শিকার হন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত অবস্থায় থাকেন। এ ছাড়া আমরা কেউই প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রণীত আইন ও নীতিমালা নিয়ে তেমন ঘাঁটাঘাঁটি করি না। এ প্রকল্পের অধীনে দু’বছর ধরে বাংলাদেশে আমি একটি গবেষণা করেছি। প্রকল্পের গবেষণা থেকে পাওয়া দুর্যোগ প্রস্তুতির সময় ওয়াশ নিয়ে কোনো ধরনের প্রস্তুতি কারোরই থাকে না। দুর্যোগের সময় পরিবারগুলো স্যানিটেশন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর তেমন গুরুত্ব দেয় না। এ সময়টাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তাদের চাহিদামতো স্যানিটেশন সেবা পান না। সাইক্লোন ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও স্যানিটেশন-সংক্রান্ত কোনো ধরনের সামগ্রীও তেমন সরবরাহ করা হয় না। টিউবওয়েল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। সরকারি টিউবওয়েলগুলো জলবায়ু সহনশীল হলেও, প্রতিবন্ধীদের জন্য সহজগম্য নয়। এসব টিউবওয়েল সাধারণত উঁচু স্থানে থাকে। সেখানে উঠতে কোনো ধরনের র্যাম্প কিংবা হাতল থাকে না। ফলে বর্ষাকালে তাদের জন্য একা একা টিউবওয়েল ব্যবহার করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তারা ক্ষতিগ্রস্ত টয়লেট ব্যবহার করতে বাধ্য হন। তারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন। সাধারণত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা দরিদ্র হয়ে থাকেন। দুর্যোগের সময় তারা আরও খারাপ অবস্থায় পতিত হন। তারা আরও বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়েন। মানবিক সমাজ বিনির্মাণে তথ্যপ্রাপ্তি ও সেবায় সবার প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা, দুর্যোগের সময় এবং দুর্যোগের পর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঠিক যত্ন নিশ্চিত করা, দুর্যোগকালে তাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা, ওয়াশ সেবা সবার জন্য সহজলভ্য করা, জলবায়ু সহনশীল ওয়াশ সেবায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা বাড়াতে কাজ করতে হবে।
সাকিব হক
দেশে অনেক ধরনের পলিসি রয়েছে। এসবের সঠিক বাস্তবায়নও জরুরি। এসব পলিসি প্রয়োজনে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। এর মধ্যে ফাঁকফোকর থাকলে তা দূরীকরণে কাজ করতে হবে। জলবায়ু সহনশীলতা ও স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো ধরনের নীতিমালা এ দেশে নেই। এ নিয়েও কাজ করতে হবে। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় নিজেদের মতো করে কাজ করে। সবাই নিজেদের ব্যানার ও লোগো প্রদর্শনে ব্যস্ত। দুর্যোগের সময় সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে একত্রে কাজ করতে হবে। দিন দিন দুর্যোগগুলো চরিত্র বদলাচ্ছে। সম্প্রতি আমরা সাইক্লোন রেমালকে মোকাবিলা করেছি। এই সাইক্লোন আগে সংঘটিত সাইক্লোনগুলোর চেয়ে আলাদা। এই সাইক্লোন আঘাত হানার পর আড়াই দিন পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। আমরা এর সঙ্গে পরিচিত নই। তাই দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কিংবা খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সব ধরনের মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে অভিজ্ঞতার আলোকে বাস্তবধর্মী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কেননা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের চরিত্র এবং প্রভাব প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এজন্য আমাদের এ বিষয়ে আরও সক্রিয় হতে হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এ ছাড়া এ বিষয়ে গবেষণার সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।
শফিকুল ইসলাম
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ডেটা নিয়ে সারা পৃথিবীতেই একটি সমস্যা আছে। যে সংখ্যা আমরা পাই, সেটি সঠিক কিনা বলা মুশকিল। বাংলাদেশে বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রতিবন্ধিতার শিকার। সেটি স্বীকার করা হয় না। সরকার করে না রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। কারণ, সরকার শতভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ভাতার আওতায় আনতে চায়। এ কারণে জরিপে সঠিক তথ্য তুলে ধরা হয় না। তাদের সংখ্যা বহুগুণ বেশি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক আইনের পাশাপাশি দেশে আইন আছে। সুতরাং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আইনগত দিক থেকে যতটা সুরক্ষিত, ততটাই তারা অরক্ষিত। কেননা, এসব আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। দেশের ২০১৩ সালের আইন, ২০১৮ সালের জাতীয় পরিকল্পনা, কৌশলগত পরিকল্পনা রয়েছে। এসডিজির মূল পাঁচটা লক্ষ্যের প্রতিবন্ধিতাকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে তাদের ওয়াশের বিষয়টিও রয়েছে। এ অনুযায়ী যে বরাদ্দ প্রয়োজন, তা নেই।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কথা উঠলেই সবার মনে আসে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। ওয়াশ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের। জনস্বাস্থ্য শুধু প্রকৌশলের বিষয় নয়, এটি অবশ্যই একটি সামাজিক বিষয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল স্থানীয় সরকারের বিষয়। অথচ প্রতিবন্ধিতা নিয়ে স্থানীয় সরকারের কোনো ধারণা নেই। অন্তর্ভুক্তিমূলক ওয়াশের মধ্যে রয়েছে– টয়লেট বসানো, ড্রেনেজ করা, টিউবওয়েল বসানো। পরবর্তী সময় এসবে প্রবেশগম্যতার বিষয়টা কি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দেখবে? এটি কি হয়? এই দুই মন্ত্রণালয়সহ আরও যেসব মন্ত্রণালয় রয়েছে, তাদের মধ্যে সমন্বয় নেই। এটি একটি গুরুতর সমস্যা। যেহেতু সবাই নিজের মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, সেহেতু একটি ভালো কাজ করার সুনির্দিষ্ট উপায় কেউ বলতে পারে না। তাদের মধ্যে সমন্বয় অবশ্যই দরকার। সারাদেশে অনেক প্রতিবন্ধী সংগঠন রয়েছে। আমাদের উচিত তাদের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানো। তাদের মাধ্যমে আমাদের তথ্য মানুষের মধ্যে সহজে পৌঁছানো সম্ভব।
গৌতম মণ্ডল
আমরা অনেকেই মনে করি, আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো দিক থেকে প্রতিবন্ধকতা থাকে। প্রতিবন্ধকতা নানা ধরনের হতে পারে। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ধরনের শিকার। আমরা কেউ এটি জানি, কেউ জানি না; কেউ বলি, কেউ বলি না। পাশাপাশি জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা জলবায়ু পরিবর্তনে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলার সময় এসেছে। এটি অতি জরুরি।
ড. মো. নূহু আমিন
এক শতাংশের কম সরকারি হাসপাতালে প্রতিবন্ধীবান্ধব টয়লেট দেখা যায়। সরকারের টাকা মূলত খরচ হয় টাইলস পরিবর্তন কিংবা দামি পণ্য কিনতে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মৌলিক যে চাহিদা রয়েছে, তার জন্য আমরা বিনিয়োগ করি না। আমাদের মূল সমস্যা হলো আমাদের হাতে তেমন ডেটা নেই। এর কারণে আমাদের সমস্যা বেশি হয়। আবার তথ্য থাকলেও অনেক এনজিও ডেটানির্ভর কাজ করে না। টাকা আছে কিন্তু তা তথ্যের ওপর নির্ভর করে অর্থায়ন করা হয় না। এর ফলে টাকাগুলো গতানুগতিক জায়গাতেই খরচ হচ্ছে। প্রান্তিক এলাকাতে এখনও রিং স্লাব কেন থাকতে হবে? প্রয়োজনই নেই। এটি তো টিকবে না। এটি বন্যা হলে নষ্ট হয়ে যাবে, মাটি ঢুকে যাবে। আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দরকার। এটি করা না গেলে এ ধরনের বিনিয়োগ ১০০ বছর ধরে চলবে, কোনো উন্নতি হবে না।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গবেষণা করে মনে করে, তারাই সবচেয়ে ভালো গবেষণা করেছে। তারা মনে করে, তারাই কাজ করতে পারবে। এটি সঠিক নয়। আমরা যদি প্রতিবন্ধীবান্ধব একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই, তাহলে সেখানে পুরকৌশলীর প্রয়োজন আছে। এ ছাড়া সমাজবিজ্ঞানী, চিকিৎসক কিংবা জলবায়ু বিশেষজ্ঞদেরও প্রয়োজন হবে। যখনই কাজ করা হয়, তখন একটি বা দুটি সংগঠন একসঙ্গে কাজ করে। এটি যথেষ্ট নয়। আমাদের ভালো একটি দল তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে স্যানিটেশনে ইন্ডাস্ট্রিগুলোকেও এদিকে বিনিয়োগ করতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো, ওয়াশ নিয়ে আমাদের নতুন কোনো আবিষ্কার নেই। ছোটবেলা থেকে আমরা সেই রিং স্লাব নিয়েই আছি। টিউবওয়েলে চাপ দিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা আমরা শুনেছি। এটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অসম্ভব। তাদের জন্য পানির চলমান ধারা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক সদিচ্ছাও দরকার।
আবদুস সাত্তার
দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে যেসব প্রকল্প পরিচালিত হয়, তার বেশির ভাগই ফান্ডনির্ভর। টাকা পেলে কাজ হয়, নইলে কোনো কাজ নেই। দেশের শতভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। যদিও বিশ্বের কাছে এই সংখ্যা ৮০ শতাংশ বলা হয়। দেশের ১৭০ মিলিয়ন মানুষ স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সুবিধা পান না। হাসপাতালের বিছানাও সহজে পাওয়া যায় না। এমনকি হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মচারীরাও সচেতন নন। তারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয়তা বোঝেন না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চাহিদা পূরণ করা গেলে ৫০ শতাংশ জনসংখ্যার প্রয়োজনীতা সরাসরি পূরণ করা সম্ভব।
আনিকা রহমান লিপি
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে। নইলে কেউ দাম দেবে না। স্বাবলম্বী হতে তাদের আয়মূলক কোনো কাজে যুক্ত হতে হবে। এর জন্য ঘর থেকে বের হতে হবে। ঘরে বসে করা কাজটার রসদ জোগাড় করতে হলেও একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে বাইরে বের হতে হবে। বাইরে বের হলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ওয়াশ সুবিধা কোথায় পাবেন? শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীর বেশির ভাগই ঘর থেকে বের হতে চান না। কারণ, কোথাও ওয়াশ সুবিধা তারা পাবেন না। অর্থাৎ চলাচলই যখন সীমিত হয়ে যাচ্ছে, তাহলে সমাজের সবার সঙ্গে সমান তালে তারা এগিয়ে যাবেন? আমাদের নগরায়ণ বাড়ছে। এ বিষয়টি আমাদের ভাবতে হবে। গ্রামে এ চিত্র আরও ভয়াবহ।
দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিয়ে অনেক প্রকল্পের কাজ চলে। এ ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা এবং নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের যে পরিমাণ অর্থায়ন হয়, তার কতটুকু প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ব্যয় হয়, তার জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার। এটি করা গেলে উন্নয়ন ও এনজিও সংস্থাগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয় নিয়ে কাজ করা শুরু করবে।
রাবেয়া বেবী
আমি কিছুদিন আগে সাতক্ষীরা গিয়েছিলাম। সাতক্ষীরা জলবায়ু বিপর্যয় অধ্যুষিত এলাকা। সেখানে পানির কারণে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ে মানুষ। সেখানে অনেক নারীকে দেখেছি, তাদের জরায়ু নেই। জরায়ুতে কোনো ধরনের ইনফেকশন হলে তারা তা কেটে ফেলেন। এটি গবেষণাতেও উঠে এসেছে। প্রতিবন্ধী নারীরাও জরায়ু কাটার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। তারা কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান না। আমি এমনও দেখেছি, পরিবারের পক্ষ থেকে অনেক প্রতিবন্ধী নারীকে জরায়ু কেটে ফেলতে বলা হয়েছে।
ঢাকার ভবনগুলোয় শুধু র্যাম্প আর অল্প কিছু সুবিধা থাকে। এতটুকু দিয়ে কী হয়? প্রতিবন্ধী নারীরা মা হলে কিংবা ধর্ষণের শিকার হলে হাসপাতাল ও পুলিশের কাছে গিয়ে স্বাভাবিক ব্যবহারটুকুও পান না। আমাদের আইনগুলোয় যেখানে স্বাভাবিক নারীরই অধিকার নেই, সেখানে একজন প্রতিবন্ধী নারী কীভাবে অধিকার পাবেন? একজন প্রতিবন্ধী নারী যে কাজ করে ক্ষমতায়িত হবেন, সে কাজের জায়গায় যেতেও তিনি নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হন। এক মেট্রোরেলের কথাই শুধু আমরা বলি। মেট্রো পর্যন্ত কীভাবে যাবেন? তাঁর প্রজনন স্বাস্থ্য, পানি, স্যানিটেশনের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমাদের ওপর যতটা পড়ে, তার অন্তত তিনগুণ বেশি প্রভাব পড়ে প্রতিবন্ধী নারীর ওপর। এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।
পরিতোষ চন্দ্র সরকার
দেশের সমতল ভূমি থেকে পাহাড়, উপকূল এবং নদী-হাওরাঞ্চলগুলোর মধ্যে অনেক ধরনের ভিন্নতা রয়েছে। সে বিবেচনা করে আমাদের ওয়াশের স্থাপনাগুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ সবাই ব্যবহার করতে পারে, এমন প্রযুক্তির অভাব আমাদের সব সময় রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের তথ্য আমরা প্রান্তিক পর্যায়ে দিতে পারি না। আমাদের দুর্যোগগুলোর চরিত্রে এখন ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন যেমন বন্যা হয়, তা আগের বন্যার মাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায়। আগের বন্যা মোকাবিলার পরিকল্পনা দিয়ে এই বন্যা মোকাবিলা করা সম্ভব হয় না। একইভাবে জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধসের মতো দুর্যোগের ব্যাপকতা বাড়ছে। সবদিকে বিবেচনা করে দেখা যায়, বিভিন্ন দুর্যোগে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বেশি ক্ষতির শিকার হন।
শহর এলাকায় কিছু কিছু জায়গায় প্রতিবন্ধীবান্ধব সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য কিছুটা সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়। এসব সুযোগ-সুবিধা সব জায়গায় নিশ্চিত করা হয়, তা বলা সম্ভব নয়। পরিবারগুলোয় এসব সুযোগ-সুবিধা একেবারেই নেই। পারিবারিক পর্যায়ে সরকার কিংবা অন্য কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো ধরনের পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া প্রতিবন্ধিতার ধরনও ভিন্ন। একই কাঠামোর মধ্যে সব ধরনের প্রতিবন্ধিতার চাহিদা পূরণের বিষয়টি নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। সার্বিকভাবে এ বিষয়টা সামনে আনা জরুরি।
সালমা মাহবুব
ওয়াশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মানুষ এখনও বঞ্চিত। আমরা অনেকটা প্রকল্পভিত্তিক কাজ করি। দাতারা ওয়াশের ক্ষেত্রে খুব একটা অর্থায়ন করেন না। ওয়াশ একটি অধিকার। এ অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটা ঘাটতি রয়েছে– এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। নীতিমালা প্রণয়নকারীরা যদি আমাদের করা গবেষণাগুলোর সুপারিশের ওপর মনোযোগ না দেন, তাহলে যত গবেষণাই করা হোক না কেন তা কাজে আসবে না। এর ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরিবর্তন হবে না। বিভিন্ন নীতিমালায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো কিছুটা হলেও বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তবে বাস্তবায়নের জায়গায় আমরা যেতে পারিনি।
গ্রামীণ অঞ্চলে টয়লেট সুবিধার কথা তো ভাবাই যায় না। শহরের বিভিন্ন ভবনেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সহজে প্রবেশগম্য টয়লেট দেখা যায় না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি আমরা এখনও ওই অর্থে সহানুভূতিশীল হতে পারিনি। আমরা সব সময় শুধু শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের কথা বলি। আইন অনুযায়ী, ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার কথা বলা আছে। সুতরাং সবার প্রয়োজনের কথাই আমাদের ভাবতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছেন না। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যেসব কমিটি করা হয়, তাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব নেই। তাদের অন্তর্ভুক্ত না করলে তাদের কথা শোনা সম্ভব হয় না।
বর্তমানে যে প্রতিবন্ধিতা জরিপ হয়, তার মাধ্যমে কোন জেলায় কতজন প্রতিবন্ধী আছে তা সহজেই জানা সম্ভব। এ ছাড়া ওইসব এলাকায় কাজ করা ওপিডিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। তাদের মাধ্যমে কী ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছে, তাদের জন্য জন্য কী সেবা দরকার– তা সহজে জানা যায়। অন্যদিকে, আমাদের সাইক্লোন সেন্টারগুলো সে অর্থে প্রবেশগম্য নয়। শুধু র্যাম্প থাকে। টয়লেটের কথা ভাবা হয় না। প্রতিবন্ধী মানুষকে দুর্যোগে প্রকৃত সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের এখনও অনেক ঘাটতি আছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের চাহিদাভিত্তিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলোর প্রকল্প চালু করতে হবে।
সভাপতি
আবু সাঈদ খান
উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল
আলোচক
চন্দন জেড গমেজ
সিনিয়র ডিরেক্টর (অপারেশন্স)
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ
সাকিব হক
ম্যানেজিং ডিরেক্টর
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিসিএডি)
শফিকুল ইসলাম
এশিয়া রিজিওনাল ডিরেক্টর
এডিডি ইন্টারন্যাশনাল
ড. নূহু আমিন
অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট
এনভায়রনমেন্ট হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ রিসার্চ গ্রুপ
আইসিডিডিআর,বি
আবদুস সাত্তার দুলাল
নির্বাহী পরিচালক
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি
আনিকা রহমান লিপি
সহকারী পরিচালক
সেন্টার ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট
রাবেয়া বেবী
সাংবাদিক, দৈনিক ইত্তেফাক
পরিতোষ চন্দ্র সরকার
ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেটর (ওয়াশ)
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ
সালমা মাহবুব
সাধারণ সম্পাদক, বি-স্ক্যান
গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন
ড. জেন উইলবার
সহকারী অধ্যাপক
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন
সঞ্চালনা
গৌতম মণ্ডল
অনলাইন ইনচার্জ, সমকাল
অনুলিখন
মাজহারুল ইসলাম রবিন
স্টাফ রিপোর্টার, সমকাল
সমন্বয়
হাসান জাকির
হেড অব ইভেন্টস, সমকাল
দেবাশীষ রঞ্জন সরকার
কমিউনিকেশন ম্যানেজার
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ
ইভেন্ট সহযোগিতা
আর্টিস্টিক কমিউনিকেশন্স
সুপারিশ
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করতে হবে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে প্রণীত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইন, নীতিমালা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে।
নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে সঠিক বোঝাপড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
পুরোনো প্রযুক্তির বদলে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে মনোযোগ দিতে হবে। গবেষণার পাশাপাশি সেসব গবেষণা মূল্যায়নে রিভিউ কমিটি করতে হবে।
সারাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করা সংগঠনগুলোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সরকারি বিভিন্ন কমিটিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স থ ন য় সরক র র দ র য গ র সময় ন শ চ ত করত ন শ চ ত কর প রকল প র ত র জন য ব যবহ র ধরন র স এ ব ষয়ট ক জ করত র ব ষয়ট পর য য় পর ব র ক জ কর কল য ণ মন য গ সমস য র ওপর জলব য় সবচ য় দরক র স গঠন এনজ ও সমক ল
এছাড়াও পড়ুন:
নীতি সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ, কী প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে
অবশেষে সুদের হার কমিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের পর এই প্রথম সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে দুর্বলতার লক্ষণ, আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব, কর্মঘণ্টা কমে যাওয়া ও নতুন চাকরি সৃষ্টির গতি কমে যাওয়ায় ফেড এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে ৪ থেকে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়ার পর ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেন, অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে সুদহার আরও কমতে পারে। তিনি বলেন, শ্রমবাজারের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা এখন তাঁর ও সহকর্মী নীতিনির্ধারকদের প্রধান উদ্বেগ। খবর রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই ব্যাপক হারে সুদ কমানোর দাবি তুলছিলেন। তাঁর বক্তব্য, এতে অর্থনীতি চাঙা হবে। তবে ফেডের এ সিদ্ধান্ত তাঁর প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ফেডের পর্ষদে নতুন গভর্নর স্টিফেন মিরান ছিলেন একমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী। তিনি ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট হারে সুদহার কমানোর পক্ষে ছিলেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও বড় কাটছাঁটের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সুদের হার নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্ন সব সময়ই তোলা হয়। ট্রাম্প সম্প্রতি ফেডের এক গভর্নর লিসা কুককে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও কুক আদালতের লড়াইয়ে আপাতত নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন এবং বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান মিরানকে ফেডের পর্ষদে বসান।
শ্রমবাজারে দুর্বলতাপাওয়েল বলেন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে, তরুণেরা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছেন। সামগ্রিকভাবে চাকরি সৃষ্টির গতি খুবই কম। শ্রমবাজারকে আর দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।
পাওয়েল আরও সতর্ক করেন, নতুন চাকরির সংখ্যা এখন বেকারত্বের হার স্থিতিশীল রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে সামান্য ছাঁটাইও বেকারত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে।
মূল্যস্ফীতি বনাম কর্মসংস্থানমূল্যস্ফীতি এখনো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতির হার ৩ শতাংশে উঠবে, যেখানে ফেডের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ শতাংশ। কিন্তু ফেড মনে করছে, কর্মসংস্থানের ঝুঁকি এখন বেশি গুরুত্ব পাওয়ার মতো বিষয়।
ফেডের নতুন পূর্বাভাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়িয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ করা হতে পারে বলা হয়েছে। বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশেই স্থির থাকবে বলে তারা অনুমান করছে।
রাজনৈতিক টানাপোড়েনএ সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক নাটকও কম ছিল না। ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা থাকলেও ফেডের পর্ষদের অন্য দুই ট্রাম্প-মনোনীত গভর্নর মিশেল বোম্যান ও ক্রিস্টোফার ওয়ালার শেষ পর্যন্ত মূল সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়েছেন। ওয়ালার বরাবরই শ্রমবাজারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে আসছেন।
পাওয়েল অবশ্য পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির মূল বিষয় হলো তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত। আজকের বৈঠকে সুদহার ব্যাপক হারে কমানোর বিষয়ে বিপুল সমর্থন ছিল না।’
বাজারের প্রতিক্রিয়াসুদহার কমানোর ঘোষণার পর ওয়াল স্ট্রিটে প্রথমে শেয়ারের দাম বাড়লেও পরে ওঠানামা করে। শেষমেশ মিশ্র পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন শেষ হয়। ডলার কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে ঠিক, কিন্তু ট্রেজারি বন্ডের সুদ প্রায় অপরিবর্তিত। বাজার এখন প্রায় নিশ্চিত, অক্টোবরের বৈঠকেও সুদ কমানো হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ফেডের সাম্প্রতিক নীতি পরিবর্তনের মানে হলো তারা এখন ধীরে ধীরে ‘নিরপক্ষে’ অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সাময়িকভাবে কিছুটা বাড়লেও ২০২৬ সালের মধ্যে স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নীতিসুদ কীকেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহারে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দেয়, সেটাই নীতি সুদহার। ইংরেজিতে একে বলে রেপো রেট। রেপোর বাংলা হচ্ছে পুনঃক্রয় চুক্তি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এটি পরিচিত। অর্থনীতিতে নগদ তারল্যের জোগান দিতে বা অন্যভাবে বলতে গেলে ব্যাংকগুলোর জরুরি প্রয়োজনে অর্থ সরবরাহ করতে মুদ্রানীতির এ হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ হাতিয়ার ব্যবহার করে।
কোভিডের পর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তখন ফেডারেল রিজার্ভ বাজারে মুদ্রার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে দফায় দফায় নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। ফলে নীতি সুদহার গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২৫ থেকে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহারের প্রভাববিশ্ব অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিসুদের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। ফেডের নীতিসুদের হার বাড়লে ট্রেজারি বন্ডের দাম কমে এবং সুদহার কমলে ট্রেজারি বন্ডের দাম বাড়ে। এর কারণ হলো বাজারে নতুন ও অধিক সুদের বন্ড আসার পর পুরোনো বন্ডের কুপন (সুদ) কম মনে হয়, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম কমে যায়। আবার যখন সুদের হার কমে, তখন নতুন বন্ডের কুপন কম হওয়ায় পুরোনো বন্ডের উচ্চ কুপনযুক্ত সুদ বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম বেড়ে যায়।
নীতিসুদ কমলেও একই প্রক্রিয়া ঘটে, তবে বিপরীতভাবে। সুদের হার কমলে নতুন বন্ডের কুপনও কমে যায়। এতে আগের উচ্চ সুদের কুপনযুক্ত বন্ডগুলো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিনিয়োগকারীরা এই পুরোনো বন্ডগুলো কিনতে আগ্রহী হন, ফলে সেগুলোর দাম বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা তখন তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ বাজারেও বিনিয়োগ আগ্রহী হন। এতে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়ে এবং ডলারের চাপ কিছুটা কমে।
সে কারণে বাজার নীতি সুদহারের দিকে তাকিয়ে থাকে, সুদ কমলে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়।