মিয়ানমার থেকে নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি মার্কিন অনুদান বন্ধ হতে যাচ্ছে। ইউক্রেন ও গাজায় যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গত বছর এ অনুদানের পরিমাণ কমালেও পুরোপুরি বন্ধ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। গত সোমবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে বিভিন্ন দেশে নতুন অনুদান ৯০ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। এর আওতায় রয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইউএসএআইডির সহায়তাও। যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান বন্ধ হওয়ায় এর ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। টেকনাফে শরণার্থী শিবিরে থাকা লাখ লাখ রোহিঙ্গার খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
রোহিঙ্গাদের অনুদান দাতা দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সবার শীর্ষে। দেশটি মোট অনুদানের প্রায় অর্ধেকই দিয়ে থাকে। গত বছর অপেক্ষাকৃত কম অর্থ দিলেও তা ছিল অন্যদের চেয়ে বেশি। দাতাদের মধ্যে আরও আছে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের জন্য ২০ কোটি মার্কিন ডলার ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। এ সহায়তার ১২ কোটি ৯০ লাখ ডলার যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি এবং ৭ কোটি ডলার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর দেয়।
অনুদান বন্ধ ঘোষণা করে নতুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশে থাকা মার্কিন কূটনীতিকের কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন। গোপন এসব বার্তা সংবাদমাধ্যম সিএনএনের হাতে পৌঁছেছে। স্থানীয় সময় শুক্রবার বার্তায় মার্কো রুবিও বিশ্বব্যাপী বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অনুদান বন্ধের নির্দেশনা দেন। তবে এ নির্দেশনার আওতায় থাকছে না মিসর ও ইসরায়েল। বিশ্বব্যাপী আবার অনুদান সরবরাহ শুরু হবে কিনা– তা পর্যালোচনার ভিত্তিতে তিন মাস পর জানানো হবে।
নিজ দেশে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা তহবিল কমছিল। ২০২৩ সালে তাদের জন্য ৮৭ কোটি মার্কিন ডলার অনুমোদন হয়, যা তাদের প্রয়োজনীয় তহবিলের ৫০ শতাংশ। তহবিল খাটো হওয়ার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জনপ্রতি বরাদ্দ কমে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বা ডব্লিউএফপি রোহিঙ্গাদের জনপ্রতি বরাদ্দ কমিয়ে ৯ টাকা করে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান কমলে এ বরাদ্দ আরও কমতে পারে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষাসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহও ব্যাহত হতে পারে। মিয়ানমার থেকে আসা এসব শরণার্থীর কারণে টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারাও নানা ভোগান্তিতে পড়েছেন। অনুদানে তাদের জন্যও বরাদ্দ থাকে। এতে তাদের জীবনও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাস। এর মধ্যে ২০১৭ সালে রাখাইনে গণহত্যা, ধর্ষণ-নিপীড়ন, অগ্নিসংযোগ এড়াতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের অধিকাংশই কক্সবাজার জেলার টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে থাকেন। ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র ২৫০ কোটি ডলারের বেশি দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে দিয়েছে প্রায় ২১০ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য ৬৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর বার্তায় বলা হয়, পর্যালোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো নতুন তহবিল অনুমোদিত হবে না বা বিদ্যমান কোনো চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাবে না। চলমান প্রকল্পের কাজও বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
অনুদান বন্ধের ঘোষণায় ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা অব্যাহত থাকা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা। ইউক্রেন ও তাইওয়ান যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান পেয়ে থাকলেও এ তিন মাস তা পৌঁছাবে কিনা– তা বার্তায় উল্লেখ নেই। অনুদান বন্ধ হলে বড় ধাক্কা খাবে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে থাকা দেশটি। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মার্কিন কংগ্রেসে বিদেশি অনুদানে প্রায়ই বাগড়া দিতেন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা। যে পরিমাণ অনুদান বিদেশে দেওয়া হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটে তা একেবারেই সামান্য।
অনুদান বন্ধের সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, এভাবে বন্ধ করে দেওয়াটা বেশ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণ। এটা ‘বাজে’। আরেক কর্মকর্তা বলেছেন, কিছু এলাকায় অনুদানে কাটছাঁট হতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে বন্ধ করে দেওয়াটা তারা একেবারেই প্রত্যাশা করেননি। কারণ, বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তার প্রয়োজন অত্যন্ত প্রকট। এ অবস্থায় সবচেয়ে বড় অনুদান দাতা যুক্তরাষ্ট্রের এভাবে সহায়তা বন্ধ করে দেওয়াটা ক্ষতিকর।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা জশ পল বলেন, এ নোটিশ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে বিদেশি সাহায্য কর্মসূচির ওপর অনেক বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ার কথাটি একবার ভাবুন। এটি অনেক বড় একটি বিষয়। মধ্যপ্রাচ্যে ইউএসএইড মিশনের সাবেক পরিচালক ডেভ হার্ডেন বলেন, এ পদক্ষেপ ‘অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ’, যা বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে মানবিক ও উন্নয়ন সহায়তা কর্মসূচিগুলোকে স্থগিত করে দিতে পারে। বিদেশি সহায়তা বন্ধের এ সিদ্ধান্তের প্রভাব পানীয় জল, স্যানিটেশন এবং আশ্রয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পে পড়তে পারে।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম র ক ন পরর ষ ট র র হ ঙ গ দ র জন দ র জন য তহব ল
এছাড়াও পড়ুন:
আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক ২৩ জুন, এরপর মিলতে পারে দুই কিস্তি অর্থ
২৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচির দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি উত্থাপনের কথা রয়েছে। বৈঠকে অনুমোদন হলে চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় একসঙ্গে দুই কিস্তির অর্থ পাবে বাংলাদেশ। আইএমএফ গতকাল শুক্রবার তার কার্যসূচিতে নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকের এ তারিখ নির্ধারণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের এ বৈঠকে চলমান ঋণ কর্মসূচির তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনার (রিভিউ) প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এ প্রতিবেদন পর্ষদ অনুমোদন করলে বাংলাদেশ একসঙ্গে পেয়ে যাবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ। দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে হতে পারে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ঋণ অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে এ ঋণ কর্মসূচি। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া—মূলত এ তিন কারণে ওই সময় আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিলসহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। আরএসএফ আইএমএফের একটি নতুন তহবিল, যেখান থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকেই প্রথম ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে এখন পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।
আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ গত বছরের ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা থাকলেও তা আর পাওয়া যায়নি। আইএমএফের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত। প্রায় প্রতিবছর ওয়াশিংটনসহ প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে বড় ধরনের তুষারপাত হয়। গত বছরও তাই হয়েছে। অতিমাত্রার বরফের কারণে অচল হয়ে যায় জনজীবন। মার্কিন প্রশাসন সতর্কবার্তা জারি করে। তুষারপাতের কারণে আইএমএফসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল অনেক দিন।
পরে আইএমএফের পক্ষ থেকে প্রথমে এ বছরের ফেব্রুয়ারি ও পরে মার্চে পর্ষদ বৈঠকের কথা বলা হয়। গত এপ্রিলে আইএমএফের একটি দল পর্যালোচনা করতে ঢাকায় আসে দুই সপ্তাহের জন্য। এর মধ্যে শর্ত পরিপালন নিয়ে দর–কষাকষিতে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় আটকে যায়। এরপর ওয়াশিংটনে গত ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তখন দর-কষাকষি হচ্ছিল মূলত মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা নিয়ে। আইএমএফ তা চাইলেও করতে চাইছিল না সরকার।
সবশেষে গত মাসে এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কয়েকটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১২ মে দুই পক্ষ চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছায় ও বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ। ১৪ মে আইএমএফ ওয়াশিংটন থেকে এক বিবৃতিতে জানায়, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে জুনে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত পর্ষদ বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মাথায় আইএমএফ অর্থ ছাড় করে দেয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।