পালিয়ে বেড়াচ্ছেন চেয়ারম্যান, দুর্ভোগে সেবাগ্রহীতা
Published: 8th, February 2025 GMT
নুর মোহাম্মাদ গাইন (৫২) ইউনিয়ন পরিষদে এসেছিলেন মেয়ে মাছুরা খাতুনের জন্মনিবন্ধন নিতে। চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর নিতে না পারায় নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে তাঁকে। এভাবে গত তিন দিন ধরে ইউনিয়ন পরিষদে এসে ফিরে যাচ্ছেন তিনি। একই অবস্থা রোকেয়া খাতুন (৫৫) নামে এক নারীর। জমি নিবন্ধনের জন্য ওয়ারিশ সনদের প্রয়োজন হওয়ায় রোকেয়া খাতুন (৫৫) চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের জন্য প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ইউনিয়ন পরিষদে যাতায়াত করছেন। কিন্তু স্বাক্ষর নিতে পারছেন না।
এই চিত্র খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের বাসিন্দাদের। ইউপি চেয়ারম্যান পলাতক থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শত শত সেবাগ্রহীতাকে। প্রায় ২৯ হাজার জনঅধ্যুষিত এ ইউনিয়নটি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে।
ইউপি সচিব সঞ্জয় মণ্ডল জানিয়েছেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ইউপি চেয়ারম্যান আছের আলী মোড়ল পালিয়ে রয়েছেন। ইতোমধ্যে একটি হত্যা মামলাসহ তাঁর নামে একাধিক মামলা হয়েছে। এ অবস্থায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি বদলি হয়ে যাওয়ায় পদাধিকার বলে দায়িত্ব পান ইউএনও। কিন্তু তিনি উপজেলার প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকায় নিয়মিত ইউনিয়ন পরিষদে সময় দিতে পারছেন না। ফলে সব কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
ইউপি সচিব বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক ইউনিয়ন পরিষদে না আসায় তাঁর স্বাক্ষরের জন্য উপজেলা সদরে যেতে হয় সেবাগ্রহীতাদের। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় নদীপথে যেতে হয় তাদের। অনেক সময় সেখানে গিয়েও ইউএনওকে না পেয়ে ফিরে আসতে হয় মানুষকে। এতে একদিকে সেবাগ্রহীতারা হয়রানি হচ্ছেন, আরেক দিকে ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়নমূলক কাজেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
ইউনিয়নের ছোট আংটিহারা গ্রামের ফজলু ঢালী বলেন, ওয়ারিশ সনদে স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য তিনি দুই সপ্তাহ ধরে ইউনিয়ন পরিষদে ঘুরছেন। পরে ইউপি সচিবের কথা মতো উপজেলায় গিয়েও কাজ হয়নি। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন একটি সভায় অংশ নিতে ইউএনও জেলা শহরে গেছেন। কষ্ট করে উপজেলায় গিয়েও তাঁকে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান দাবি করেন তিনি।
ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য কোহিনুর আলমের ভাষ্য, ইউপি চেয়ারম্যান না থাকায় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মানুষ। জন্মনিবন্ধন, ওয়ারিশ সনদ, প্রত্যয়নপত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবা দিতে না পারায় মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গ্রাম আদালতের কার্যক্রম না চলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খারাপের দিকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ইউপি সদস্যদের মধ্যে কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া ছাড়া বিকল্প দেখছেন না তিনি।
ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য গোলাম কিবরিয়া বলেন, নিয়ম অনুযায়ী চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে প্যানেল চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু তিনি বিশেষ ক্ষমতা আইনের একটি মামলায় কারাগারে আছেন। এ পরিস্থিতিতে প্যানেল চেয়ারম্যান-২ অথবা ইউপি সদস্যদের মধ্যে থেকে গ্রহণযোগ্য কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হলে জনভোগান্তি কমবে।
উপজেলা ও জেলায় বিভিন্ন সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকায় নিয়মিত ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না জানিয়ে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস বলেন, তার পরও তিনি ইউনিয়নের সেবাগ্রহীতাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিকল্প হিসেবে এ মুহূর্তে উপজেলা প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া যায় কিনা, সে বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়া ইউপি সদস্যদের দাবি অনুযায়ী, তাদের মধ্যে থেকে কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি
বরেন্দ্র অঞ্চলে বছরে বৃষ্টি হয় প্রায় ১,২০০ থেকে ১,৫০০ মিলিমিটার পর্যন্ত। বৃষ্টি কম হওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানিও ক্রমাগত নিচে নামছে। ফলে দিনকে দিন অঞ্চলটি খরাপ্রবণ হয়ে উঠছে। তবে, গত শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) রাতের স্মরণকালের ভারী বর্ষণে বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মাটির বাড়ি ধসে পড়ার পাশাপাশি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে এবং মাঠের ধান শুয়ে পড়েছে।
রবিবার (২ নভেম্বর) সকালে রাজশাহীর কাঁকনহাট পৌরসভার দরগাপাড়া গ্রামে কৃষক জহিরুল ইসলাম নিজের জমির পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, “মাঠের ৮০ ভাগ ধান শুয়ে পড়েছে। এই ধান তুইলতে লোকও পাওয়া যাবে না। সবাইকে একসঙ্গে ধান তুইলতে হবে। আমরা এবারের খুব ক্ষতির শিকার।”
আরো পড়ুন:
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভারী বর্ষণে ৪০০ পুকুর ভেসে গেছে
পদ্মা-মেঘনায় ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে পাঙ্গাস
সরেজমিনে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কৃষকের কথার সত্যতা পাওয়া গেছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের ফসলি মাঠ উঁচুনিচু সিঁড়ির মতো। দুই পাশ উঁচু হলেও মাঝের অংশ তুলনামূলক নিচু থাকে, যা স্থানীয়রা ‘কান্দর’ বলেন। এবার এই কান্দরগুলো তলিয়ে গিয়ে বিলের মতো হয়েছে। এসব জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। কখনো কখনো বিলের ধান পানিতে ডুবলেও কান্দর কখনো ডুবে না। শুক্রবার রাতের বৃষ্টিতে সবই তলিয়েছে।
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম বলেন, “গ্রামের দিকে খুব বৃষ্টি হয়েছে। তবে, শহরে আমরা মাত্র ১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছি।”
এদিকে, বিলের পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় মানুষ দলবেঁধে মাছ ধরতে নেমেছেন। শনিবার (১ নভেম্বর) থেকেই মাছ ধরার মহোৎসব চলছে। পবা উপজেলার শুলিতলা ভিমারডাইং এলাকায় জোয়াখালি নদীতে অর্ধশতাধিক মানুষ মাছ ধরছিলেন।
ক্ষেত থেকে শুয়ে পড়া ধান কাটছেন এক কৃষক
আলোকছত্র গ্রামের কৃষক মো. মনিরুজ্জামান (৬৫) বলেন, “জাল ফেললেই বড় বড় মাছ পাওয়া যাচ্ছে। আমি আমার জীবনে এবার দ্বিতীয়বার উত্তরা পেলি দেখছি। সাধারণত নদীর স্রোত উত্তর দিকে যায়, কিন্তু এবার উত্তরেই এত বেশি বৃষ্টি হয়েছে যে পানি দক্ষিণে যাচ্ছে।”
বিলের মধ্যে খনন করা পুকুরগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মাছচাষিরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। গোদাগাড়ীর কালোসাঁকো বিলে চারটি পুকুরে মাছচাষ করতেন মারিফুল ইসলাম। তিনি জানান, প্রায় ৪ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। অন্তত ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
রিশিকুল ইউনিয়নের খড়িয়াকান্দি এলাকায় দুটি স্থানে পাকা রাস্তা প্লাবিত হয়ে একপাশ থেকে অন্যপাশে পানি যাচ্ছে। স্থানীয়রা সেখানে জাল দিয়ে মাছ ধরছেন। রাস্তার দুই পাশে শত শত বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে। খড়িয়াকান্দি খালের পাশে ১০–১২টি বাড়ির মাটির দেয়াল ভেঙে পড়েছে।
মান্ডইল নলপুকুর গ্রামের বিশ্বনাথ সরেন জানান, তার বাড়ির দুটি ঘর ধসে পড়েছে।
জালে বড় মাছ উঠায় খুশি স্থানীয় এক বাসিন্দা
রিশিকুল এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, “আমাদের এলাকায় এমন বন্যা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। তারপর এত বৃষ্টি ও বন্যা হয়নি। এবার প্রথম।”
এলাকাবাসী জানান, পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় রান্নাবান্না সম্ভব হচ্ছে না। স্বেচ্ছাসেবীরা খিচুড়ি রান্না করে বাড়ি বাড়ি বিতরণ করছেন। গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট, আলোকছত্র হয়ে তানোরের সরনজাই ও কালীগঞ্জ এলাকায় মাঠের পর মাঠের ধান শুয়ে পড়েছে।
কালীগঞ্জের কৃষক সাবিয়ার রহমান বলেন, “আমার ১২ বিঘা জমির ধান শেষ। আধাপাকা ধান ঘরে তুলতেও লোক পাওয়া যাবে না।”
এবার মাঠ তলিয়ে যাওয়ায় আলু ও শীতকালীন সবজি চাষে বিলম্ব হবে। পার্শ্ববর্তী মোহনপুর ও বাগমারায় ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি ঢুকে যাওয়ায় পানবরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুই পাশের জমি প্লাবিত করে বৃষ্টির পানি সড়কে উঠেছে
শনিবার বাগমারার বাসুপাড়ায় নুর মোহম্মাদ নামের এক পানচাষির মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয়দের ধারণা, বরজে পানি ঢুকে যাওয়ায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গিয়ে থাকতে পারেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন দাবি করেছেন, “ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি।” তিনি বলেন, “৫০০ হেক্টর ধানের ক্ষতির প্রতিবেদন আমরা দিচ্ছি। ধান শুয়ে পড়লেই কিন্তু ক্ষতি হবে না। মাঠে যাচ্ছি, দেখছি।”
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “কিছু উপজেলা থেকে পুকুর ভেসে যাওয়ার খবর পেয়েছি। মাছ বেরিয়ে গেছে। এটি অপরিকল্পিত পুকুর খননের কারণে হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানার জন্য উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি।”
ঢাকা/কেয়া/মাসুদ