আন্দোলনে হেলিকপ্টারের ব্যবহার নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে
Published: 13th, February 2025 GMT
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেলিকপ্টারের ব্যবহার নিয়ে তথ্য ও মতামত দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আন্দোলনকারীদের ভয় দেখাতে এবং সম্ভবত বেআইনি বল প্রয়োগের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছিল।
ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখাতে বিশেষ করে র্যাবের কালো রঙের হেলিকপ্টার ব্যবহার করা করেছিল।
প্রতিবেদনে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে আরও বলা হয়, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখাতে বিশেষভাবে আরও বেশি হেলিকপ্টার মোতায়েন করতে বলেছিলেন। ঠিক সেভাবে র্যাব হেলিকপ্টারের ব্যবহার করেছিল।
ওএইচসিএইচআরকে দেওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী, মিরপুরে (১৮ জুলাই), মহাখালীতে (১৮ জুলাই), ধানমন্ডিতে (১৮ ও ১৯ জুলাই), বাড্ডায় (১৯ জুলাই), মোহাম্মদপুরে (১৯ জুলাই), রামপুরায় (১৯ জুলাই), শাহবাগে (১৯ জুলাই), বসুন্ধরায় (১৯ জুলাই, ২ ও ৩ আগস্ট), গাজীপুরে (২০ জুলাই) এবং যাত্রাবাড়ীতে (২০ ও ২১ জুলাই) র্যাব ও পুলিশের হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর বারবার কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া হয়। সেই সঙ্গে রামপুরায় ১৮ জুলাই সাউন্ড গ্রেনেডও ছোড়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও বলেছেন, ১৯ ও ২০ জুলাই হেলিকপ্টার থেকে রাইফেল ও শটগান দিয়ে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে প্রাণঘাতী গুলি ছুড়তে দেখা গেছে।
তথ্য অনুসন্ধানী দলের কাছে দেওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী, যেসব এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে বাড্ডা, বসুন্ধরা, গাজীপুর, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মহাখালী, মোহাম্মদপুর এবং রামপুরা এলাকায় গুলি ছুড়তে দেখা গেছে।
আর ৫ আগস্ট যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় এক ব্যক্তির শরীরে বর্মভেদকারী গুলির টুকরা আঘাত করেছিল বলেও তথ্য পেয়েছে ওএইচসিএইচআর। তারা এটি যাচাই করে দেখেছে।
ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হেলিকপ্টার থেকে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ভিড় লক্ষ্য করে নির্বিচার গুলি ছোড়া স্বাভাবিকভাবেই মানবাধিকারের মানদণ্ডের লঙ্ঘন।
পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র্যাবের মহাপরিচালক—দুজনই হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার কথা স্বীকার করেছেন বলে ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। তবে এই দুই কর্মকর্তার কেউ-ই র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছুড়েছিলেন কি না, তা নিশ্চিত করতে পারেননি।
ওএইচসিএইচআরকে দেওয়া র্যাবের প্রতিবেদনে বলেছে, তারা হেলিকপ্টার থেকে ৭৩৮টি কাঁদানে গ্যাসের শেল, ১৯০টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং ৫৫৭টি স্টান গ্রেনেড ছুড়েছেন। কিন্তু জোর গলায় দাবি করেছে, তারা ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত হেলিকপ্টার থেকে একবারও রাইফেল অথবা শটগান দিয়ে গুলি ছোড়েনি।
ওএইচসিএইচআরের তথ্য অনুসন্ধানী দল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ের বেশ কয়েকটি ভিডিও হাতে পেয়েছে। তারা সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে। তারা দেখেছে, র্যাব ও পুলিশের হেলিকপ্টারে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ছেন। দূর থেকে দেখলে ওই লঞ্চারগুলো রাইফেল অথবা শটগানের মতো দেখতে লাগে। যদিও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ার পর সেগুলোর পেছনে লেজের মতো সাদা ধোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়।
ওএইচসিএইচআর এমন কোনো ভিডিও হাতে পায়নি যেখানে হেলিকপ্টার থেকে পরিষ্কারভাবে রাইফেল অথবা শটগান দিয়ে গুলি ছোড়ার বিষয়টি বোঝা যায়।
তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মনে রাখা দরকার, প্রত্যক্ষদর্শীরা যে সময়ে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়েছে বলে দাবি করছেন, সে সময় (তৎকালীন) সরকার মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে রেখেছিল।
ফলে সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ওয়েবসাইটে ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না।
যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর বলেছে, তারা তাই হেলিকপ্টার থেকে রাইফেল বা শটগান দিয়ে গুলি ছোড়ার বিষয়টি যেমন নিশ্চিত করতে পারছে না, তেমনি বাতিল করতেও পারছে না।
তথ্য অনুসন্ধানী দল আরও বলেছে, এমন হতে পারে, ওপর থেকে থেকে আঘাতে যাঁরা হতাহত হয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ ওপর থেকে ছোড়া কোনো রাইফেলের আঘাত পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। অথবা ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়েছিল, যা পরে ভূমিতে পড়ার সময় কারও গায়ে আঘাত করতে পারে।
এ বিষয়ে আরও তদন্ত প্রয়োজন, যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতা জরুরি। এমনকি নিরাপত্তা সদস্যদের যাঁরা ওই সময় হেলিকপ্টারে দায়িত্বে ছিলেন তাঁদেরও সহযোগিতা দরকার।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ওএইচস এইচআর র ব যবহ র ১৯ জ ল ই কর ছ ল আরও ব
এছাড়াও পড়ুন:
ফেস্টুন অপসারণ করায় ইউএনওকে শাসালেন বিএনপি নেতা
ফেস্টুন অপসারণ করায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফয়সাল আহমেদকে শাসিয়েছেন এক বিএনপি নেতা। তিনি ইউএনওকে আগের স্থানেই ফেস্টুন লাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, “তা না হলে যেটা করা দরকার, সেটাই করব।”
এই বিএনপি নেতার নাম কে এম জুয়েল। তিনি রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক। গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুলে তার বাড়ি।
গত মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের সড়ক বিভাজকে থাকা বিভিন্ন দলের ফেস্টুন অপসারণ করেন ইউএনও ফয়সাল আহমেদ। বিষয়টি জানতে পেরে ইউএনওকে ফোন করে ধমকান জুয়েল।
কে এম জুয়েলের ফোনকল রেকর্ড পাওয়া গেছে। এতে শোনা গেছে, কে এম জুয়েল বলেছেন- “আজকে একটা ঘটনা ঘটেছে, আমি শুনেছি। আমি ইঞ্জিনিয়ার কে এম জুয়েল বলছি, সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেট। আপনার গোদাগাড়ী থানার প্রোপারে যে পোস্টার সরিয়েছেন, এই বিষয়ে কিছুক্ষণ আগে আমাকে ইনফর্ম করা হয়েছে। সেখানে আমার পোস্টার ছিল। জামায়াত-বিএনপির পোস্টার ছিল। আপনি যে হটাইছেন, এর কারণ কী? কোনো পরিপত্র আছে, না ইচ্ছে করেই?”
ইউএনও তখন বলেন, “জনগণ অভিযোগ দিয়েছে।” জুয়েল বলেন, “জনগণ তো অনেক অভিযোগ দিয়েছে। সমগ্র গোদাগাড়ী থানাতে ভর্তি হয়ে আছে পোস্টার। তোলেন, সব তোলেন।”
এ সময় ইউএনও কিছু বলতে চাইলে তাকে থামিয়ে দিয়ে জুয়েল বলেন, “শোনেন, আমি যেটা বলছি লিগ্যাল রাইট নিয়ে বলছি, সেটার সঠিক অ্যানসার করবেন। আপনি কেন ওই জায়গার পোস্টার তুলেছেন, আর অন্য জায়গার তুলছেন না কেন? আমি ঢাকাতে আছি, আমি আসতেছি।”
ইউএনও বলেন, “আচ্ছা ঠিক আছে।” জুয়েল বলেন, “না, আপনি যেখান থেকে পোস্টার তুলেছেন, সেখানে আপনি সাবমিট করবেন পোস্টার।” কথা না বাড়িয়ে ইউএনও বলেন, “ঠিক আছে।”
এ সময় আরো ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপি নেতা জুয়েল বলেন, “কালকে যেন আমরা ওখানে দেখতে পাই, পোস্টার যেখানে ছিল। ঠিক আছে মানে কী? অবশ্যই করবেন। না হলে যেটা করা দরকার সেটাই করব। আপনার এগেইনেস্টে যেরকম স্টেপ নেওয়া দরকার, সেটাই আমি করব। বিশেষ করে আমরা করব। আমার নেতার ছবি তুলেছেন আপনি ওখান থেকে। জাস্ট রিমেম্বার ইট।”
জুয়েল বলতে থাকেন, “নরসিংদী বাড়ি দেখান আপনি, না? কোন দল থেকে আসছেন আপনি? কোন দল থেকে এসেছেন? কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেছেন আপনি? কালকে পোস্টার ভদ্রলোকের মতো লাগাবেন। ফাইজলামি! এহ, বিশাল ব্যাপার। উনি টিএনও হয়ে গোদাগাড়ীতে আসছেন।”
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ইউএনও ফয়সাল আহমেদ বলেন, “ডাইংপাড়া মোড়ে ব্যানার-ফেস্টুন এরকম পর্যায়ে ছিল যে, যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছিল। পাশাপাশি পৌরসভার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছিল বলে অভিযোগ ছিল। স্থানীয় জনগণ এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পৌরসভা থেকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে সরানোর জন্য। দুই-তিনবার মৌখিকভাবে ও লিখিত আকারে জানানো হয়েছিল। না সরানোর কারণে ব্যানার-ফেস্টুন সরিয়ে পৌরসভায় রাখা হয়েছে।”
তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সভাতেও আলোচনা হয়েছিল। সেখান থেকে সকল রাজনৈতিক দলের পোস্টারই পৌরসভার পক্ষ থেকে সরানো হয়েছে। তবে, বিএনপি নেতা কে এম জুয়েলের ফোনে শাসানোর বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা কে এম জুয়েল বলেন, “ইউএনওর কাছে জনগণ অভিযোগ করেছে, আর আমরা কি মানুষ না? আমরা জানোয়ার? আমার ছবি তুলে ফেলুক আপত্তি নাই। আমার নেতার ছবিতে হাত দিয়েছে কেন? তার কাছে কি নির্বাচন কমিশন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পোস্টার তুলে ফেলতে? তিন মাসের মধ্যে কি নির্বাচন? উনি জাস্টিস করতেন, আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু গরু-ছাগলের মতো আচরণ করবেন, তা তো হয় না।”
বিষয়টি নিয়ে কোথাও আলোচনা হয়নি, ইউএনও কোনো চিঠিও দেননি, দাবি করে এই বিএনপি নেতা বলেন, “গতকাল আমার এক লোককে ডেকে ইউএনও বলেছেন, যেখানে পোস্টার ছিল, দয়া করে আপনারা লাগিয়ে নেন। কিন্তু, আমরা তো লাগাব না। ইউএনওকেই লাগাতে হবে।”
উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একজন সদস্য জানান, প্রায় দুই মাস আগে উপজেলা সদরের এসব ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উত্থাপন করেন এক ব্যক্তি। এক মাসেও সেগুলো অপসারণ না হওয়ায় পরবর্তী মাসের সভাতেও বিষয়টি আলোচনায় ওঠে। ওই সভায় ট্রাফিক পুলিশ আপত্তি করেছিল যে, ফেস্টুনের কারণে রাস্তার একপাশ থেকে অন্যপাশ দেখা যায় না। এতে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ দুটি সভার মধ্যে প্রথম সভায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল ছিলেন না। দুই সভার মাঝে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি পুনর্গঠন করা হলে তিনি পরবর্তী সভায় উপস্থিত ছিলেন।
তবে, কোনো আলোচনা হয়নি দাবি করে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল বলেন, “আমি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য। পোস্টার নিয়ে কোনো আলোচনা সভায় হয়নি। ইউএনও আমাদের না জানিয়ে এভাবে ফেস্টুন অপসারণ করে ঠিক করেননি। সেখানে আমাদের নেতার ছবি ছিল।”
ঢাকা/কেয়া/রফিক