দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি আবার সামনে এসেছে। ছয় মাস ধরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিষয়টি নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক চলছে। এখন নতুন করে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। অবশ্য তাঁদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের কথাও বলছেন।

নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল না হলে জনগণের সামনে গভীর সংকট দেখছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তাঁর মতে, কাজটি করতে না পারলে বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।

গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক ভিত্তি: জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। সভায় নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলে দেশের মানুষ যদি সচেষ্ট না হয়, তাহলে জনগণের সামনে গভীর সংকট অপেক্ষা করছে। এটি না করা হলে বাংলাদেশকে একটি গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।’

আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির এই আহ্বায়ক বলেন, ‘খুনের দায়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দ্রুতগতিতে তাদের নিবন্ধন বাতিল করুন।.

..আওয়ামী লীগের ব্যানারের বিষয়ে আগামী নির্বাচনের আগে যদি সমাধান না করা যায়, তাহলে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে ফেরার আর কোনো পথ থাকবে না।’

কোনো দয়া না দেখিয়ে আওয়ামী লীগকে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে বর্জন করতে ওই সভা থেকে আহ্বান জানান নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।

জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়কের দেওয়া এমন বক্তব্যের দুই ঘণ্টা পর গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ মোহাম্মদ হাসানের জানাজা শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ দেখতে চান তাঁরা।

দ্রুতগতিতে তাদের (আওয়ামী লীগ) নিবন্ধন বাতিল করুন।নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটিসরকারের পদক্ষেপ দাবি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের (এখন নিষিদ্ধ সংগঠন) ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ভাষণ দেন। এই ভাষণকে কেন্দ্র করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরসহ বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরের মধ্যে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ৩২ নম্বরের বাড়ি। তখন থেকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আবার সরব হতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এর মধ্যে ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় কিছু নেতা-কর্মীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা ও গণহত্যার বিচারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়।

এমন প্রেক্ষাপটে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ৭ ফেব্রুয়ারি বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বর্তমান সরকার শিগগিরই পদক্ষেপ নেবে।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়া ও খুনিদের বিচারের আগপর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব নাআবদুল হান্নান মাসউদ, মুখ্য সংগঠক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

অন্যদিকে গাজীপুরের ওই হামলায় আহত এক তরুণ ১২ ফেব্রুয়ারি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি আওয়ামী লীগকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে।

১২ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিহত ওই তরুণের (আবুল কাশেম) জানাজার আগে বক্তব্য দেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সদস্যসচিব আরিফ সোহেল। তাঁরা তিনজনই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি জানান। সেই রাতে জানাজার পর কফিন মিছিলেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে নানা স্লোগান দেওয়া হয়।

জানাজার আগে হাসনাত আবদুল্লাহ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ‘#ব্যানআওয়ামীলীগ’ লেখা একটি পোস্ট দেন। এই পোস্টের আগে ওই দিন তিনি আরেকটি পোস্ট দেন। এর শেষ লাইনটি ছিল ‘ইন্টেরিম, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করো, করতে হবে।’

জানাজার আগে হাসনাত আবদুল্লাহ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ‘#ব্যানআওয়ামীলীগ’ লেখা একটি পোস্ট দেন। এই পোস্টের আগে ওই দিন তিনি আরেকটি পোস্ট দেন। এর শেষ লাইনটি ছিল ‘ইন্টেরিম, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করো, করতে হবে।’ আ.লীগকে কর্মসূচি করতে দেওয়া হবে না

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও দলটির নিবন্ধন বাতিল চেয়ে গত ১৯ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করেন ‘সারডা সোসাইটি’ নামের একটি সংগঠন। ২৭ আগস্ট সেই রিটের শুনানি হয়। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিহিংসার রাজনীতি করতে চাইবে—কেউ এটি প্রত্যাশা করলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, এই সরকার মনে করে, মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক দল অন্যতম প্ল্যাটফর্ম।

পরে হাইকোর্ট আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও দলটির নিবন্ধন বাতিল চেয়ে করা রিটটি সরাসরি খারিজ করে দেন।

জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়কের দেওয়া এমন বক্তব্যের দুই ঘণ্টা পর গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ মোহাম্মদ হাসানের জানাজা শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ দেখতে চান তাঁরা।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবির বিষয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ২৮ আগস্ট সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, তারা (আওয়ামী লীগ) বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্বরতম এক ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল। এই কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যক্তিগত দায় থাকতে পারে। নেতাদের সামষ্টিক দায় থাকতে পারে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সমীচীন হবে না।

তবে জুলাই গণহত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে দেওয়া হবে না বলে গত ২৯ জানুয়ারি এক ব্রিফিংয়ে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি সেদিন বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে হলে অবশ্যই গণহত্যার বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এবং তাদের প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। তাদের রাজনীতি করতে হলে ‘ক্লিন ইমেজ’ নিয়ে আসতে হবে।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবির বিষয়ে বিএনপি শুরু থেকেই বলে আসছে, এই সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ।

‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯’ অনুযায়ী সরকার বিভিন্ন সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে পারে। এই আইন অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন জারি করে। গত বছরের ১ আগস্ট এই আইনে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। পরে অন্তর্বর্তী সরকার ওই প্রজ্ঞাপন বাতিল করেছে।

সর্বশেষ ওই আইনেই গত বছরের ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়া ও খুনিদের বিচারের আগপর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন স র দ দ ন প টওয় র ন ষ দ ধ কর র ম খ য স গঠক র জন ত ক র র জন সরক র আওয় ম গতক ল আগস ট

এছাড়াও পড়ুন:

আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ

আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।

মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।

মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :

তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে

অর্থাৎ :

কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়

[অনুবাদ: লেখক]

অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:

হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে

অর্থাৎ :

এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫

মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :

সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি

অর্থাৎ :

হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।

উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।

অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।
ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ