অপারেশন ডেভিল হান্ট কোন দিকে যাচ্ছে
Published: 17th, February 2025 GMT
শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল। এ সরকারের মেয়াদ ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এ সময়ে যেসব ক্ষেত্রে সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করা।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে সেনাবাহিনীও মাঠে রয়েছে।
সরকারের এসব পদক্ষেপের ফলে গত কয়েক মাসে ব্যাপক না হলেও, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছু উন্নতি দৃশ্যমান হচ্ছিল। কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে পরিস্থিতি আবারও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। এ রকম প্রেক্ষাপটে সরকার ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরুর ঘোষণা দেয়।
অপারেশন ডেভিল হান্ট ঘোষণার পর থেকেই তা নিয়ে জনমনে একধরনের আগ্রহ ও প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। অপারেশন ডেভিল হান্টের লক্ষ্যবস্তু কারা, এ বিশেষ অভিযান সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু, এর ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, এ ধরনের অনেক প্রশ্ন নিয়ে জনপরিসরে আলাপ-আলোচনা হয়েছে।
অপারেশন ডেভিল হান্ট নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এ বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়েছিল, যারা বিভিন্নভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করেছে, তারাই অপারেশন ডেভিল হান্টের লক্ষ্যবস্তু হবে। এর পাশাপাশি বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি দখল, আধিপত্য ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল এবং দুর্নীতি-লুটপাটসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদেরও লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করা হবে বলে কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন।
অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরুর দুই-তিন দিনের মধ্যেই এর কার্যকারিতা নিয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তাদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের আশপাশেই পতিত ফ্যাসিস্টদের দোসর ‘ডেভিল’ অবস্থান করছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। সরকারকে সতর্ক করে তিনি বলেন, দেশে ডেভিল হান্ট অপারেশন চলছে। ‘শয়তান’ শিকার করতে গিয়ে যেন ভালো লোক ধরা না পড়ে। (সরকারের আশপাশেই ‘ডেভিল’ অবস্থান করছে: মির্জা আব্বাস, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)
কোনো কোনো দল আবার বিশেষ অভিযানের সফলতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল। সারা দেশে চলমান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’কে সরকারের ‘ডিলেইড ডেভিল হান্ট ইনিশিয়েটিভ’ বলেছেন আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তাঁর মতে, এই অপারেশনের ফলে খুব বেশি ফল আসবে না। (ডেভিল হান্ট অপারেশনে খুব বেশি ফল আসবে না: এবি পার্টি, প্রথম আলো অনলাইন ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)
বিশেষ অভিযান শুরুর ৯ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর আমরা আসলে কী দেখতে পাচ্ছি?
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দেওয়া তথ্য অনুসারে, অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু হওয়ার পর ৯ দিনে (রবিবার বিকেল পর্যন্ত) সারা দেশে মোট ৪ হাজার ৭৯০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। (প্রথম আলো অনলাইন, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)
লক্ষণীয় হলো, গ্রেপ্তার হওয়া প্রায় পাঁচ হাজার ‘ডেভিল’-এর মধ্যে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের মন্ত্রী, এমপি বা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা নেই বললেই চলে; বরং তাঁদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মী; কোথাও কোথাও দলটির সাবেক সদস্য এবং সাধারণ সমর্থকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ রকম প্রান্তিক পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সত্যিকারের উন্নতি সম্ভব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ডেভিল হান্ট নামের বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তারের তালিকায় বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিরাও রয়েছেন, এমন খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এ রকম একজন হলেন মোমিনউদ্দিন ভান্ডারি। তিনি গাজীপুরে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সত্তরোর্ধ্ব ওই নেতাকে অভিযানের শুরুতেই আটক করা হয়। স্বজনদের দাবি, তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত এবং দীর্ঘদিন রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। অভিযানে আটক করে আদালতে হাজির করা হলে তাঁকে দুই দিনের রিমান্ড দেওয়া হয়। তাঁর পরিবার বলছে, আইনি লড়াই চালানোর ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে। কারণ, হামলার ভয়ে আইনজীবীরা তাঁর পক্ষে দাঁড়াতে শঙ্কিত। (‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ কীভাবে চলছে, গ্রেপ্তার হচ্ছেন কারা, বিবিসি বাংলা, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)
বিশেষ অভিযান শুরুর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি দাবি করেছিলেন যে মানবাধিকার রক্ষা করেই অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই তেমনটা ঘটছে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই জুলাই-আগস্টে সংঘটিত বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ঢালাও মামলা দেওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা স্বীকার করেছিলেন। এবার বিশেষ অভিযানকে কেন্দ্র করেও ঢালাও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে।
জুলাই-আগস্টে গণ–অভ্যুত্থানের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সহিংসতা নিয়ে সম্প্রতি জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের নৃশংস কর্মকাণ্ড নিয়ে যেমন অনেক তথ্য-উপাত্ত রয়েছে, এর পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে, এমন কথাও বলা হয়েছে। ঢালাও মামলার পর, চলমান বিশেষ অভিযানে ঢালাও গ্রেপ্তারের ঘটনাগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের তালিকায় যুক্ত হবে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এর ফলে মানবাধিকার রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
নিকট অতীতে বাংলাদেশে পরিচালিত দুটি বিশেষ অভিযান নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০২ সালে শুরু হওয়া ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’। আরেকটি হলো, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৮ সালে পরিচালিত মাদকবিরোধী অভিযান। এ দুটি অভিযানে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি, বেশ কিছু মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হয়েছিলেন।
যে উদ্দেশ্যের কথা বলে আলোচিত দুটি অভিযান পরিচালিত হয়েছিল, তা অর্জিত হয়নি বলেই পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে; বরং দুটি অভিযানেই ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। অপারেশন ডেভিল হান্টের পরিণতিও সেদিকে যাচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর স থ ত র স বর ষ ট র পর চ ল ত উপদ ষ ট সরক র র কর ছ ল হয় ছ ল ত হয় ছ র ঘটন আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
খুলনায় ‘সেরা সাঁতারুর খোঁজে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতা শুরু
তৃণমূল থেকে প্রতিভা তুলে আনার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খুলনায় শিশুদের নিয়ে শুরু হয়েছে ‘সেরা সাঁতারুর খোঁজে বাংলাদেশ- ২০২৫’ প্রতিযোগিতা।
সোমবার (১৬ জুন) সকাল থেকে দিনব্যাপী নগরীর সোনাডাঙ্গাস্থ বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের রেজাউল সুইমিং একাডেমিতে এ প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
নৌবাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশন প্রতিযোগিতার আয়োজনে করে। বয়স ভিত্তিক এ প্রতিযোগিতায় খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা থেকে শিশু-কিশোররা অংশ নিচ্ছে।
আরো পড়ুন:
ফুলকুমার নদে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু
টাঙ্গাইলে পুকুরে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু
সরেজমিনে ভেন্যুতে গিয়ে দেখা যায়, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকা থেকে সন্তানদের নিয়ে সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য অভিভাবকরা এসেছেন। প্রতিযোগিতা শুরুর আগে নৌবাহিনী সদস্যরা প্রতিযোগীদের বুক ও হাতের মাপসহ রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম সম্পন্ন করছেন।
অভিভাবকরাও সন্তানদের প্রতিযোগিতায় সেরা হওয়ার প্রত্যাশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। ক্ষুদে সাঁতারুরাও তাদের সেরাটা প্রদর্শনের জন্য অপেক্ষা করছেন। সব মিলিয়ে খুলনার এ আয়োজন শিশু সাঁতারুদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
খুলনা ভেন্যু প্রতিনিধি ও সুইমিং ফেডারেশনের সাবেক সদস্য জি এম রেজাউল ইসলাম বলেন, “তৃণমূল থেকে প্রতিভা তুলে এনে তাদের লম্বা ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে সেরা সাঁতারু খুঁজে বের করার যে পরিকল্পনা বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশন নিয়েছিল, তারই অংশ হিসেবে খুলনায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘সেরা সাঁতারুর খোঁজে বাংলাদেশ-২০২৫’ প্রতিযোগিতা। এখানে অংশ নিয়েছে খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার শিশু-কিশোররা।”
তিনি আরো বলেন, “বয়সভিত্তিক ‘ক’ গ্রুপে ৯-১১ বছর বয়সী এবং ১২-১৫ বছর বয়সী সাঁতারুরা অংশ নিয়েছে ‘খ’ গ্রুপে।”
“তিন ধাপে বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। চূড়ান্ত পর্যায়ের বাছাইকৃত সাঁতারুদের দুই বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আশা করি, এই ট্যালেন্ট হান্টের মাধ্যমে খুলনাসহ সারা দেশে সাঁতারুদের যে ক্রাইসিস চলছে, তা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারব”, যোগ করেন তিনি।
এর আগে ‘সেরা সাঁতারুর খোঁজে বাংলাদেশ ২০২৫’ প্রতিযোগিতার বিষয় নিয়ে রবিবার (১৫ জুন) সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিযোগিতার বিস্তারিত তুলে ধরেন খুলনা ভেন্যু প্রতিনিধি, সুইমিং ফেডারেশনের সাবেবক সদস্য ও রেজাউল সুইমিং একাডেমির পরিচালক জি এম রেজাউল ইসলাম।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন- সেরা সাঁতারুর খোঁজে বাংলাদেশের খুলনা ভেন্যুর নির্বাচন কমিটি ও সুইমিং ফেডারেশনের সদস্য মাহাবুবুর রহমান, মো. সোলাইমান, এম এইচ ঢালী, নাজিমুদ্দিন জুলিয়াস, জ্যোতিন্দ্রনাথ বিশ্বাস, মো. আলাউদ্দিন, শাহাজাহান রনি, মাহফুজুর রহমান শিলা ও জুয়েল আহম্মেদ প্রমুখ।
ঢাকা/নূরুজ্জামান/মাসুদ