তিস্তায় সব হারিয়ে তাঁরা যোগ দিয়েছেন নদী রক্ষা আন্দোলনে
Published: 18th, February 2025 GMT
‘হামরা গুলা সগায় তিস্তা নদীর ভাঙনের শিকার হয়া এলা ভূমিহীন। পরের বাড়িত থাকং। সেই তিস্তা নদীর ভাঙনের হাত থাকি বাঁচার জন্তে আন্দোলন হচ্ছে। তাই হামরা রোববার থাকি এটে আসি থাকছোং। হামরা চাই আর যেন তিস্তা নদী না ভাঙে। আর যেন হামার গুলার মতোন কেউ ভূমিহীন না হয়।’
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নের শুকান দিঘী এলাকার শহিজল হোসেন (৭৮)। একসময় তাঁর বাড়ি ছিল কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার জোরগাছে। বাড়িঘর ও সাত বিঘা জমি তিস্তায় হারিয়ে এখন লালমনিরহাটে থাকেন।
তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে কর্মসূচির কথা শুনে শহিজলসহ ভাঙনের শিকার মানুষেরা কর্মসূচিতে ছুটে আসেন। তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের উদ্যোগে তিস্তাপারের পাঁচটি জেলার ১১টি স্থানে অবস্থান কর্মসূচি, গণপদযাত্রাসহ নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
তিস্তাপারের ইউনিয়ন লালমনিরহাট সদরের গোকুন্ডার ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সোলেমান আলী (৭২) ও ময়না বেগম (৬২) দম্পতি গোকুন্ডার তিস্তা সড়কসেতু ও রেলসেতুর মধ্যবর্তী স্থানে কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসেন। কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন আজ মঙ্গলবার দুপুরে তাঁদের সঙ্গে কথা হয়।
সোলেমান আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিস্তা হামার পাছ ছাড়ে না। তিস্তার হাত থাকি হামার গুলার রক্ষা নাই। আগোত হামার বাড়ি ছিল চিলমারীর জোরগাছোত। জোরগাছোত একবার তিস্তাত গেল বাড়িঘর। সব হারেয়া চলি আসনু লালমনিরহাটের কুরশামারীত। ২০ বছর আগোত কুরশামারীর বাড়িটাও ভাঙি গেল। এলা কুরশামীর মানষের বাড়িত ঘর তুলি থাকছোং।’
গোকুন্ডার আফজাল নগরের আক্তারুজ্জামান ১৬ বছর আগে তিস্তার ভাঙনে ৭০ শতক জমি হারিয়েছেন। সোলেমান আলীর মতো শহিজল, আক্তারুজ্জামানেরা তিস্তায় বাড়িঘর হারিয়ে ভূমিহীন। তাঁদের সবার গল্প প্রায় অভিন্ন। সব হারিয়ে তাঁরা তিস্তা বাঁচানোর আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব (দুলু) বলেন, ‘তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। অথচ প্রতিবেশী ভারত একতরফাভাবে নদীর পানি দিচ্ছে না। আমরা তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও অবিলম্বে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছি। বৃহত্তর রংপুর বিভাগের লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার তিস্তাপারের মানুষেরা নিজেদের বাঁচাতে এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন।’
গতকাল সোমবার বিকেলে লালমনিরহাট সদরের গোকুন্ডা ইউনিয়নের তিস্তা সেতু ও তিস্তা রেলসেতুর মধ্যবর্তী স্থানে কর্মসূচির মূল মঞ্চে বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ ছাড়া অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান (দুদু), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সংগীতশিল্পী বেবি নাজনীন প্রমুখ।
আজ সকালে তিস্তা সড়ক সেতুর উত্তর মাথা থেকে রংপুরের কাউনিয়া জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত গণপদযাত্রা কর্মসূচিতে যোগ দেন কয়েক হাজার মানুষ। তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক আসাদুল হাবিবের নেতৃত্বে এ পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় অধিকাংশের হাতে ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানসংবলিত পতাকা ও টি-শার্ট পরা দেখা যায়।
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গণপদযাত্রা শেষে তিস্তার পানিতে নেমে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন ও সংগীত পরিবেশন করা হবে। বিকেল পাঁচটায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তিস্তাপারের ১১টি স্থানে অবস্থান কর্মসূচিতে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেবেন। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, হাফিজ উদ্দিন আহমদসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিত থাকার কথা আছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব এনপ র
এছাড়াও পড়ুন:
চট্টগ্রামে বছর শেষে বাড়ছে ডেঙ্গু, কমেছে চিকুনগুনিয়া
চট্টগ্রামে বছরের শেষে এসে আবারও বাড়ছে ডেঙ্গুর সংক্রমণ। চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম দুই দিনেই ৮৭ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। গতকাল রোববার বেলা একটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৪১ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। গত বছরও এই সময়ে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েছিল। এদিকে বছরের শেষ দিকে এসে চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ কমেছে। গতকাল ২৪ ঘণ্টায় চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল শূন্য।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া—দুটিই মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ। দুটিই এডিস মশার কামড়ে হয়। এডিসের বংশ বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে বৃষ্টি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, নভেম্বরের শুরুতে লঘুচাপের কারণে বৃষ্টি হতে পারে। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
চট্টগ্রামে বছরের শুরু থেকে গতকাল বেলা একটা পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৯২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে গত অক্টোবর মাসে। পুরো জেলায় ওই মাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৯৯০ জন। এর আগের মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ৯৩৫। চলতি নভেম্বর মাসে এ সংখ্যা নির্ভর করছে বৃষ্টির ওপর। কারণ, শীত শুরু হলে এডিসের বংশবৃদ্ধির আশঙ্কা কম। তবে বৃষ্টি হলে সেটি বাড়তে পারে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে সর্বশেষ মৃত্যু গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এদিন বেলা সাড়ে তিনটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জয় তারা (১৬) নামের এক কিশোরীর মৃত্যু হয়। এ নিয়ে চলতি বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নিহতের সংখ্যা ২০।এদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত কমেছে। গতকাল পর্যন্ত জেলায় চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৬৯। তবে চিকুনগুনিয়ায় মাসভিত্তিক তথ্য দেয়নি সিভিল সার্জন কার্যালয়। যদিও প্রতিদিনের আক্রান্তের হিসাব দেয় তারা। প্রাথমিক হিসাবে, গত সেপ্টেম্বর মাসে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭০৪। গত অক্টোবর মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১২১ জন। এ মাসে কেবল একজন।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে সর্বশেষ মৃত্যু গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এদিন বেলা সাড়ে তিনটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জয় তারা (১৬) নামের এক কিশোরীর মৃত্যু হয়। এ নিয়ে চলতি বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নিহতের সংখ্যা ২০।
এদিকে গত বছরের তুলনায় এ বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অবস্থা গুরুতর। তাঁদের উপসর্গগুলোও কিছুটা ভিন্ন বলে জানা গেছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ৪১ জন রোগী জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩ জন ভর্তি হয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসে (বিআইটিআইডি) এবং ১২ জন ভর্তি হয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
আমাদের হাসপাতালে ১৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। ডায়রিয়া ও বমি হলো ডেঙ্গু ওয়ার্নিং সাইন (সতর্ক সংকেত)। এগুলো দেখলে বোঝা যায় রোগীর অবস্থা গুরুতর হচ্ছে।এ এস এম লুৎফুল কবির, মেডিসিন বিভাগের প্রধান, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালচিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট দেখা গেছে। তবে এ বছর যাঁরা আসছেন, তাঁদের মধ্যে শক সিনড্রোম বেশি। পাশাপাশি ডায়রিয়ার উপসর্গও আছে। শক সিনড্রোম হলে রোগীর রক্তচাপ বোঝা যায় না। এই দুটি উপসর্গ গুরুতর। কারণ, সময়মতো ফ্লুইড (তরল খাবার) না পেলে রোগীর অবস্থা আরও গুরুতর হতে পারে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান এ এস এম লুৎফুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ১৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। ডায়রিয়া ও বমি হলো ডেঙ্গু ওয়ার্নিং সাইন (সতর্ক সংকেত)। এগুলো দেখলে বোঝা যায় রোগীর অবস্থা গুরুতর হচ্ছে।’
চলতি বছর এপ্রিল থেকে মোটামুটি বৃষ্টি হচ্ছে। জুনে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হলেও পরের মাসগুলোয় স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়। আর থেমে থেমে বৃষ্টির সঙ্গে গরম কিন্তু কমেনি। এই বৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রা চলতি বছর ডেঙ্গুর বিস্তারে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদেরা। তবে সংক্রমণ কমাতে সিভিল সার্জন কার্যালয় ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
নগরের ২৫টি এলাকাকে ডেঙ্গু ও ২৫টি এলাকাকে চিকুনগুনিয়ার জন্য হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। এর মধ্যে বন্দর, ইপিজেড, হালিশহর, কোতোয়ালি, বায়েজিদ, পাহাড়তলী, কাট্টলী, খুলশী, ডবলমুরিং, লালখান বাজার, আগ্রাবাদ, চান্দগাঁও, দেওয়ানহাট, আন্দরকিল্লা, মুরাদপুর, সদরঘাট—এসব এলাকায় ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এসব এলাকায় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।
সিটি করপোরেশনের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সরফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বিশেষ দল করা হয়েছে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার জন্য। নিয়ম করে এলাকা ভাগ করে রুটিন অনুযায়ী ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।’
চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত বৃষ্টি হওয়ার ২৮ দিন পর্যন্ত মশার প্রকোপ থাকে বলে ধারণা করা হয়। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এ মাসে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। এতে ডেঙ্গু বাড়তে পারে।