আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কাছে প্রত্যাশা
Published: 19th, February 2025 GMT
অনেক দিন ধরেই মনে হচ্ছিল যে আমরা আমাদের আশপাশের দেশগুলোর ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তেমন কিছু জানি না। আমরা ভারতের বাংলা সাহিত্যের কথা কিছুটা জানলেও তাদের অন্যান্য ভাষার সাহিত্য নিয়ে তেমন কোনো জ্ঞান আমাদের নেই। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের শিল্প–সাহিত্যের কোনো খবর আমরা এত কাছে থেকেও পাই না। ওদের দেশের খবরের পোর্টালগুলো পড়লে কিছুটা জানা যায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘এসব দেশের গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক পড়ে বাংলাদেশিদের কী লাভ? আপনি তো আপনার দেশের সাহিত্য নিয়েই তেমন কিছু জানেন না।’
প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক—প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। আমাদের নিজ দেশের সাহিত্যই তো অনেক উপেক্ষিত। আমরা পড়ি না, তাই আমাদের সাহিত্য প্রসারে তেমন খরচ করা হয় না। এরপরও বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমাদের সমাজে এবং সংবাদমাধ্যমে কিছু আলাপ-আলোচনা ও পড়াশোনা হয়, কিন্তু আমাদের দেশেই যে আরও ১৫-১৬টি ভাষা আছে, তা নিয়ে কোনো কথাই হয় না। এমন অবস্থায় আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশের সাহিত্য নিয়ে জেনে কী করব?
আসলে এই জানার অনেক অর্থ আছে, প্রাসঙ্গিকতা আছে। এই জানার অর্থ হচ্ছে নিজেদের জ্ঞান বাড়ানো, পড়ার এবং কল্পনা করার অভিজ্ঞতা বাড়ানো। আমার উল্টো প্রশ্ন হচ্ছে, ‘জানব না কেন? না জানলে নতুন ভাবনা আমাদের মনে আসবে কী করে? জানলে তো কোনো ক্ষতি নেই।’
বিদেশি সাহিত্য বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে দুটি প্রতিষ্ঠানের কথা মনে আসে—বাংলা একাডেমি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। বাংলা একাডেমির এক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানলাম যে তাঁরা অনুবাদের কাজ করেন দুইভাবে। বাংলা সাহিত্যকে অন্য ভাষায় অনুবাদ এবং ভিন্ন ভাষার সাহিত্যকে বাংলায় অনুবাদ। কিন্তু যতটুকু তাঁরা করতে চান, তা বাজেট–স্বল্পতার কারণে পারেন না।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কাছে আমাদের প্রত্যাশা আরও অনেক বেশি। এটি মূলত একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। বিশ্বের সব মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণাই এর মূল লক্ষ্য। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কাজের পরিধি ব্যাপক। ভাষা প্রমিতকরণ, বিপন্ন বা বিলুপ্ত ভাষার গবেষণা ও সংরক্ষণ এবং শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা—এই তিন পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানটির কাজ করার কথা।
যাত্রার শুরু থেকে মসৃণভাবে এগোয়নি প্রতিষ্ঠানটির কাজ। গুগলে সার্চ দিলে মন খারাপ করা খবরাখবর ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। খবরে বলা হচ্ছে, এখন গবেষণা, বই প্রকাশ, জাদুঘর তৈরিসহ আরও কিছু কাজ করার চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে মান অর্জন ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের সম্পর্ক গড়ে ওঠা প্রত্যাশিত ছিল, প্রতিষ্ঠানটি তা পূরণ করতে পারেনি।
খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম যে এই ইনস্টিটিউটের জন্য বরাদ্দ করা বাজেট খুবই কম—এতই কম যে এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু করা সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট ঘেঁটে এর কাজ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে বোঝা যায় যে তারা গবেষণার কাজে অর্থায়ন করে। কিন্তু কী কী গবেষণা করে, এই গবেষণার উদ্দেশ্য কী এবং তা জনমানুষের কী কাজে লাগে, তা জানা যায় না।
একটি কাজ এই প্রতিষ্ঠান বেশ সহজেই করতে পারে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি দেশের কালচারাল সেন্টার আছে এবং তারা তাদের শিল্প-সাহিত্য ও সিনেমা বাংলাদেশিদের জানাতে বেশ তৎপর। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এদের সঙ্গে পার্টনারশিপ করতে পারে। তাদের মাধ্যমে তাদের দেশে গল্প, উপন্যাস, নাটক ও কবিতা প্রকাশ করিয়ে আমাদের মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তার ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্ব নিতে পারে। একসময় রাশিয়ান বই বাংলা ভাষায় আমাদের এখানে অনেক পাওয়া যেত; সেই মডেলেই প্রকাশনার কাজ হতে পারে।
যেসব কর্মকর্তার নাম এবং ছবি মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে দেখলাম, মনে হলো তাঁরা সবাই–ই বিসিএস কর্মকর্তা। বিসিএস কর্মকর্তারা এখানে কাজ করলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, তবে যেসব বিসিএস কর্মকর্তার সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা আছে এবং মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে, যাঁরা সাহিত্যযুদ্ধটি করতে পারবেন, আমরা আশা করব, শুধু তাঁদেরই যেন এই ইনস্টিটিউটে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি তেমন কোনো কঠিন কাজ বলে মনে করি না।
বিদেশি সাহিত্যকে আমাদের কাছে তুলে ধরতে এবার বেসরকারি খাতকে কাজে যুক্ত করুন। আমাদের দেশে অন্তত ৫০টি কোম্পানি খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা সুন্দর করে সিএসআর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। মন্ত্রণালয় বাজেট না দিলেও এসব কোম্পানির সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে ফান্ড সংগ্রহ করা যেতে পারে। অনেকেই আগ্রহ দেখাবে। আমাদের দেশেই বিদেশি ভাষায় পারদর্শী অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের মাধ্যমে সেগুলো অনুবাদ করিয়ে পাঠকদের মধ্যে বিক্রি করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিষ্ঠিত প্রকাশকদেরও যুক্ত করা যেতে পারে।
একটা কথা বলে রাখতেই হয় যে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্যও দু-একজন জনবল নিয়োগ না দিলে এ কাজ এগোবে না।
যেই গবেষণা এবং সেমিনার-সিম্পোজিয়াম জনমানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছে না, সেগুলো চালিয়ে যাওয়া কতটুকু যুক্তিপূর্ণ, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। আমরা বিভিন্ন দেশের শিল্প-সাহিত্যকে জানতে চাই। সে কারণেই মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কাছে প্রত্যাশা আমাদের কাছে বাংলা একাডেমির কাছে প্রত্যাশার চেয়ে কম নয়; বরং আরও বেশি।
প্রতিষ্ঠানটি দেখতে সুন্দর, কিন্তু তেমন কোনো কাজ করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতি আমরা দেখতে চাই না। যে ভাষাগুলো বাংলার কাছাকাছি—যেমন হিন্দি, উর্দু বা নেপালি—সেসব ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করার মধ্য দিয়েই মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের নতুন যাত্রা শুরু হোক।
● ইকরাম কবীর গল্পকার
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত মন ক ছ ক জ কর আম দ র অন ব দ
এছাড়াও পড়ুন:
ভাঙা বেড়িবাঁধ, আমন নিয়ে দুশ্চিন্তায় মাতারবাড়ীর চাষিরা
চলতি মৌসুমে আমন চাষ করার জন্য এক ব্যক্তির এক একর জমি ১৮ হাজার টাকায় ইজারা নেন কক্সবাজারের মহেশখালীর সাগর উপকূলীয় মাতারবাড়ী ইউনিয়নের নয়াপাড়ার কৃষক জাকের হোছাইন। এই মাসের শেষের দিকে আমন চাষ শুরু করার কথা তাঁর। তবে সাগরে বিলীন হওয়া বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে বর্ষায় ফসলি জমিতে পানি ঢুকে পড়ার শঙ্কায় আমনের চাষাবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কেবল জাকের হোছাইন নন, তাঁর মতো একইভাবে আমনের চাষাবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন মাতারবাড়ী ইউনিয়নের অন্তত ২০০ চাষি।
কুহেলিয়া নদীর পশ্চিমে আর বঙ্গোপসাগরের পূর্বে জেগে ওঠা প্রায় ১২ বর্গকিলোমিটার চর নিয়ে মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়ন। এর পশ্চিম পাশে রয়েছে আট কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, যার মধ্যে প্রায় এক কিলোমিটার ভাঙা অবস্থায় পড়ে রয়েছে এক দশক ধরে। ওই অংশ দিয়ে আশপাশের লোকালয় ও ফসলি জমিতে পানি ঢুকে পড়া ঠেকাতে সর্বশেষ চার বছর আগে বসানো হয়েছিল জিও টিউব। তবে গত ২৯ ও ৩০ মে নিম্নচাপের প্রভাবে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে জিও টিউব বিলীন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বেড়িবাঁধের ওই ভাঙা অংশ দিয়ে লোকালয় ও ফসলি জমিতে পানি ঢুকে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি তিন দফায় লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে ভেঙে গেছে অন্তত ১০টি কাঁচা বসতঘর। স্থানীয় মানুষের চোখে ঘুম নেই। চাষিরাও আমন ধানের চাষাবাদ আদৌ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন।সরওয়ার কামাল, সদস্য, মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদবেড়িবাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি ইউনিয়নের ষাইটপাড়া এলাকায়। গত শনিবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা বেড়িবাঁধের পাশে বসানো জিও টিউব সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। সাগরের পানি ঢেউয়ের সঙ্গে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ উপচে পাশের ফসলি জমিতে ঢুকে পড়ছে। সেখানে স্থানীয় মাঝের ডেইল এলাকার বাসিন্দা আবদুল কাদেরের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, বেড়িবাঁধের জিও টিউব বিলীন হওয়ার দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা খুবই উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। আমনচাষিরা চাষাবাদ করতে পারবেন কি না তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মানুষ তাঁদের ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন। জরুরি ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কার করা উচিত।
মাতারবাড়ী ইউনিয়নে দায়িত্বরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নুরুল হোছাইন মোহাম্মদ তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, ভাঙা বেড়িবাঁধের কারণে ষাইটপাড়াসহ আশপাশের চারটি গ্রামে জলাবদ্ধতার শঙ্কা রয়েছে। এ কারণে এসব এলাকার অন্তত ৮০ একর জমিতে আমন চাষাবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য সরওয়ার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্প্রতি তিন দফায় লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে ভেঙে গেছে অন্তত ১০টি কাঁচা বসতঘর। স্থানীয় মানুষের চোখে ঘুম নেই। চাষিরাও আমন ধানের চাষাবাদ আদৌ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন।’ ইউপি সদস্য সরওয়ার কামাল আরও বলেন, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম এলেই এলাকার মানুষের উদ্বেগ বাড়ে। অথচ ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড।
মহেশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হেদায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে। জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি নিম্নচাপের প্রভাবে মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় অন্তত ১ হাজার ৬০০ মিটারের বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আপাতত বর্ষা মৌসুমে জোয়ারের পানি টেকানোর জন্য ভাঙা বেড়িবাঁধের ওপর জিও টিউব বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিগগিরই কাজ শুরু হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কক্সবাজারের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জামাল মুর্শিদ প্রথম আলোকে বলেন, মাতারবাড়ী ও ধলঘাট ইউনিয়নে স্থায়ী বাঁধের জন্য প্রায় ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় চারপাশে ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার সুপার ডাইকের আদলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ ও ৭টি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া খনন করা হবে সাড়ে ১৯ কিলোমিটার কুহেলিয়া নদী। গত এপ্রিলে প্রকল্প প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।