রাত তিনটায় কেন সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
Published: 24th, February 2025 GMT
রোববার দিবাগত রাত তিনটায় নিজের বাসায় সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সেখানে তিনি বললেন, আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
প্রশ্ন উঠেছে, গভীর রাতে কেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সংবাদ সম্মেলন ডাকতে হলো? সকালে ডাকলে কী সমস্যা হতো? কেউ কেউ বলছেন, গভীর রাতের সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তো গতানুগতিক কথাই বলেছেন। এটাকে কেন জরুরি সংবাদ সম্মেলন বলা হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এই সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁর পদত্যাগের দাবি ওঠার মধ্যে। আজ সোমবার দুপুরে ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে গণপদযাত্রা কর্মসূচি পালনের ঢাক দিয়েছে।
এর আগে সারা দেশে ছিনতাই, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে রোববার মধ্য রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। এ সময় আজ বেলা ১টার মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।
বিক্ষোভ মিছিল শেষে রাজু ভাস্কর্যে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাকিব আহমেদ বলেন, দেশে চাঁদাবাজরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তার মানে হলো, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজধানীর ছিনতাইয়ের ঘটনার একটি ভয়ংকর ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, এক ব্যক্তিকে গুলি করে ও কুপিয়ে তাঁর ব্যাগ ছিনিয়ে নিচ্ছে কয়েক ব্যক্তি।
আজ সকালে পুলিশ জানিয়েছে, ভিডিওটি সঠিক এবং তা বনশ্রীর।
রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান আকন্দ গতরাতে বলেন, ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তির নাম মো.
ওসি আতাউর রহমান আরও বলেন, মো. আনোয়ারকে লক্ষ্য করে ছিনতাইকারীরা গুলি ছোড়ে এবং ছুরিকাঘাত করে। তাঁর শরীরে গুলি ও কোপের চিহ্ন রয়েছে।
রামপুর থানা-পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ওই ব্যবসায়ী পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, ছিনতাইকারীরা তাঁর কাছ থেকে ২০০ ভরি স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একই রাতে মোহাম্মদপুরে ছিনতাইয়ের আরেকটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। যদিও সোমবার বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ওই ভিডিওর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে। অনেকেই আতঙ্কের কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরেকটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে।
হাজারীবাগ থানার ওসি মো. সাইফুল ইসলাম আজ প্রথম আলোকে বলেন, শংকরে আলী হোসেন কলেজের সামনে ১০ জনের মতো যুবক জড়ো হয়েছিলেন। সেটা দেখে স্থানীয় একটি মসজিদ থেকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, দুদিন আগে পুলিশের সঙ্গে একটি সভায় স্থানীয় মানুষকে অপরাধের আশঙ্কা দেখতে মাইকিং করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। তার অংশ হিসেবেই মাইকিং করা হয়। তবে অপরাধের কোনো ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আতঙ্কজনক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রাত তিনটার দিকে রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএসে নিজ বাসভবনে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আসেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার সব ধরনের চেষ্টা করছে। দেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া প্রচুর টাকা তারা এ কাজে ব্যবহার করছে। এটা কোনো অবস্থাতেই করতে দেবে না সরকার। যেভাবে হোক এটা প্রতিহত করা হবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে টহল কার্যক্রম আরও বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, সোমবার থেকে যেন কোথাও কোনো অপরাধ না ঘটে, তারা সে ব্যবস্থা নেবে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি এই নির্দেশনা কার্যকর না করতে পারে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিনে দিনে আরও উন্নত হবে। অবনতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তখন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা করা হয়েছিল। তবে ১৬ আগস্ট সাখাওয়াত হোসেনকে সরিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা করা হয় জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে।
নতুন সরকার যেসব ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, পরিস্থিতি উদ্বেগের, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম মনে করা হয় আইনশৃঙ্খলাকে। মানুষ এখন ছিনতাই ডাকাতির আতঙ্কের মুখে রয়েছেন। ভোরে ও রাতে অনেকে বাইরে বের হচ্ছে ভয় পাচ্ছেন। দিনের বেলা বাসে ডাকাতি ও নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনাও ঘটছে। কয়েক দিনে অনেকগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
কয়েক দিন ধরেই দেশের কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদ ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে কর্মসূচি পালন করছেন।
রাতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলন ডাকার পর কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ লিখেছেন, ‘রাত তিনটার সময় যে সাংবাদিকেরা প্রেস কনফারেন্সে যাবেন, তারা ঘড়ি, মোবাইল, মানিব্যাগ ও মাইক্রোফোন ইত্যাদি সাবধানে রাইখেন।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র পদত য গ র দ ব পর স থ ত সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
অজ্ঞাতনামা লাশ আর কারা হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় জনমনে সন্দেহ: এমএসএফ
চলতি অক্টোবর মাসে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশ এবং কারা হেফাজতে মৃত্যু সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। এ তথ্য তুলে ধরেছে মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। প্রতিষ্ঠানটির অক্টোবর মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এমএসএফ বলেছে, এসব ঘটনায় জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ দুই ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে।
এমএসএফ প্রতি মাসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে। আজ শুক্রবার অক্টোবর মাসের প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এমএসএফ মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করে।
বেড়েছে অজ্ঞাতনামা লাশএমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে মোট ৬৬টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়; বরং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে (সেপ্টেম্বর) এর সংখ্যা ছিল ৫২। এসব অজ্ঞাতনামা লাশের বেশির ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়। অল্পসংখ্যক মৃতদেহ গলাকাটা, বস্তাবন্দী ও রক্তাক্ত বা শরীরে আঘাতের চিহ্নসংবলিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
এমএসএফ বলেছে, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েই চলেছে এবং তা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১টি শিশু, ১ কিশোর, ১১ জন নারী ও ৫৩ জন পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ বছর বয়সী শিশু; ১৫ বছর বয়সী কিশোর; ২০ থেকে ৩০ বয়সী ১৫ জন পুরুষ ও ২ জন নারী; ৩১ থেকে ৪০ বয়সী ১৯ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী; ৪১ থেকে ৫০ বয়সী ১ নারী ও ৫ জন পুরুষ এবং ৫০ বছর বয়সের বেশি ১১ জন পুরুষ ও ১ নারী রয়েছেন। এর মধ্যে অজ্ঞাতনামা তিনজনের বয়স শনাক্ত করা যায়নি।
এমএসএফ বলেছে, শুধু অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং পরিচয় জানার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
কারা হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছেইএমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে কারা হেফাজতে মোট ১৩ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এ সংখ্যা ছিল মোট ৮। এ মাসে ছয়জন কয়েদি ও সাতজন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন কয়েদি ও দুজন হাজতি, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন কয়েদি ও শেরপুর জেলা কারাগারে একজন কয়েদি মারা যান। এ ছাড়া খুলনা জেলা কারাগারে, টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে, চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে, সিরাজগঞ্জ কারাগারে ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে একজন করে হাজতি বন্দী মারা যান। সব বন্দীর মৃত্যু হয় কারাগারের বাইরে হাসপাতালে।
এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কারা হেফাজতে মৃত্যু এবং অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বৃদ্ধি মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লাশ উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। কিন্তু এসব লাশ উদ্ধার করে তার পরিচয় শনাক্ত করা এবং সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করাই শুধু নয়, এসব লাশ আত্মীয়-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসব বাহিনীর কাজ। কিন্তু একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা করা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আর কোনো কাজ নেই।
সাইদুর রহমান বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং হেফাজতে মৃত্যু বৃদ্ধি জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে।
গণপিটুনিতে হত্যা চলছেই, বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতাঅক্টোবর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। এর মধ্যে ২ জন নিহত এবং ৫৪৭ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ এবং নিহত ব্যক্তিরা বিএনপির কর্মী–সমর্থক। সেপ্টেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৮টি ঘটনা ঘটেছিল।
সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার মধ্যে ১১টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিকাণ্ড এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অক্টোবর মাসে মোট গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। আগের মাসে এ ঘটনা ঘটেছিল ৪৩টি। এ মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২। আগের মাসে নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন।