প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাহিদা অনুযায়ী ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের ভূগর্ভস্থ মজুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে দুই দেশ একটি চুক্তি সইয়ের দ্বারপ্রান্তে আছে বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনীয় উপপ্রধানমন্ত্রী ওলহা স্টেফানিশিনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, চুক্তি নিয়ে এ পর্যন্ত সব আলাপ-আলোচনা গঠনমূলক হয়েছে। প্রধান প্রায় সব বিবরণ চূড়ান্ত হয়েছে।

ওলহা স্টেফানিশিনা আরও বলেন, ‘আমরা এটি (আলোচনা) দ্রুত সম্পন্ন করে চুক্তি সইয়ের কাজ এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

খনিজ চুক্তি সইয়ের জন্য মার্কিন প্রশাসনের অব্যাহত চাপের মুখে রয়েছে ইউক্রেন। আর এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

একুশ শতকের অর্থনীতির ভিত্তি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ। এসব সম্পদ নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সামরিক শক্তি ও শিল্প অবকাঠামোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত ভূমিকা পালন করছে এসব খনিজ।রবার্ট মুগাহ, কানাডাভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেকডেভের প্রধান

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তাঁর তথাকথিত ‘বিজয় পরিকল্পনায়’ প্রথমে খনিজ চুক্তির প্রস্তাবটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তাঁর এ পরিকল্পনা তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্পের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল। মূলত ইউক্রেনের প্রতি ট্রাম্পের সমর্থন আদায় বজায় রাখতে একটি বাস্তবসম্মত কারণ হিসেবে এ পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়।  

যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কিয়েভে বিবিসিকে বলেছেন, এ ধরনের একটি চুক্তি অনেক বড় পুরস্কারের সমান। কারণ, এটি ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও নিরাপদ ইউক্রেনের মার্কিন প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করবে।  

জিওলজিক্যাল ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের জন্য একটি চুক্তি করতে আগ্রহী হওয়ার কারণ, দেশটি চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে চায়। চীন বিশ্বের বিরল খনিজ ভান্ডারের ৭৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে।ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ

কিয়েভের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ‘গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের’ ৫ শতাংশই রয়েছে ইউক্রেনে। এর মধ্যে রয়েছে  প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ টন গ্রাফাইটের সুনির্দিষ্ট মজুত, যা খনিজ সরবরাহে ইউক্রেনকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের একটিতে পরিণত করেছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা সংস্থা। গ্রাফাইট বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

ইউরোপের মোট লিথিয়াম ভান্ডারের এক-তৃতীয়াংশই রয়েছে ইউক্রেনে। বর্তমানে ব্যাটারি তৈরির মূল উপাদান লিথিয়াম। এদিকে যুদ্ধ শুরুর আগে টাইটানিয়াম উৎপাদনে ইউক্রেনের বৈশ্বিক হিস্যা ছিল ৭ শতাংশ। উড়োজাহাজ থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র—সবকিছুতে ব্যবহৃত হয় এ হালকা ধাতু।

আরও কিছু খনিজের উল্লেখযোগ্য মজুত রয়েছে ইউক্রেনে। সম্মিলিতভাবে ১৭টি উপকরণের এ বিরল খনিজ অস্ত্র, বায়ুবিদ্যুতের টারবাইন, ইলেকট্রনিক ও আধুনিক বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।

যাহোক, ইউক্রেনে খনিজ সম্পদের ভূগর্ভস্থ কিছু মজুত এরই মধ্যে দখল করে নিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেনের অর্থমন্ত্রী জুলিয়া স্ভিরিডিয়াঙ্কার মতে, বর্তমানে রাশিয়ার দখলে আছে ইউক্রেনের ৩৫ হাজার কোটি ডলারের খনিজ সম্পদের ভান্ডার।

ভূরাজনৈতিক ঝুঁকিবিষয়ক কানাডাভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেকডেভ ২০২২ সালে এক মূল্যায়নে প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে রাশিয়া ইউক্রেনের ৬৩ শতাংশ কয়লাখনি এবং ম্যাঙ্গানিজ, সিজিয়াম, ট্যানটালাম ও বিরল খনিজ ভান্ডারের অর্ধেক দখল করেছে।

সেকডেভের প্রধান রবার্ট মুগাহ বলেন, এ ধরনের খনিজ সম্পদ ইউক্রেনে রাশিয়ার অব্যাহত আক্রমণের ক্ষেত্রে এক ‘কৌশলগত ও অর্থনৈতিক মাত্রা’ যোগ করেছে। খনিজ সম্পদের ভান্ডার দখল করে মস্কো ইউক্রেনের আয়ের উৎসে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দিয়েছে এবং নিজস্ব সম্পদের ভিত্তি প্রসারিত করেছে। এতে খনিজ সরবরাহের বৈশ্বিক শৃঙ্খলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র কেন খনিজ চুক্তি করতে চায়

রবার্ট মুগাহ বলেন, একুশ শতকের অর্থনীতির ভিত্তি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ। এসব সম্পদ নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সামরিক শক্তি ও শিল্প অবকাঠামোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত ভূমিকা পালন করে এসব খনিজ।

জিওলজিক্যাল ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের জন্য চুক্তি করতে আগ্রহী হওয়ার কারণ, দেশটি চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে চায়। চীন বিশ্বের বিরল খনিজ ভান্ডারের ৭৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে।

গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে কিছু বিরল খনিজের রপ্তানি নিষিদ্ধ করে চীন। দেশটি এর আগের বছর যুক্তরাষ্ট্রে খনিজ রপ্তানি সীমিত করেছিল।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর ওয়াশিংটন সফরের আগে গত সোমবার হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎজ মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউজনেশনকে বলেন, ‘অর্থনীতিকে আরও সম্প্রসারিত করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনকে এক সুতায় গাঁথার জন্যই এ চুক্তি।’

এর আগে গত সপ্তাহে ইউক্রেনের বিরল খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রকে ৫০ শতাংশ ভাগ দেওয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যে পরিমাণ সহায়তা দিয়েছিল, এ ভাগ সেটির প্রতিফলন ঘটাবে। জবাবে জেলেনস্কি বলেছেন, ‘আমি আমাদের দেশকে বিক্রি করে দিতে পারি না।’

ট্রাম্প এ মাসের শুরুতে বলেছিলেন, ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি ডলার। আর তিনি ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে সমমূল্যের প্রবেশাধিকার চান।

আরও পড়ুনখনিজ নিয়ে চুক্তির দ্বারপ্রান্তে ইউক্রেন–যুক্তরাষ্ট্র২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

তবে জেলেনস্কি বলেছেন, এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা দিয়েছে। কিয়েভ আরও জোর দিয়ে বলেছে, তারা এ পর্যন্ত যে সহায়তা পেয়েছে তা ঋণ নয়, বরং অনুদান ছিল। তাই ইউক্রেনের কোনো কিছু ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। তিনি যেকোনো চুক্তিতে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চান বলেও জানা গেছে।

সোমবার যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে মার্কিন প্রবেশাধিকারের চুক্তিকে ‘মহাপুরস্কার’ বলে অভিহিত করেছেন।

এ চুক্তিতে ‘প্রতারণার’ যেসব ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছেন বরিস। তিনি বলেন, এ চুক্তির ফলে ইউক্রেনের মানুষ যা পাবে তা হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে একটি মুক্ত, সার্বভৌম ও নিরাপদ ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি।’

কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তির প্রস্তাবকে ‘ঔপনিবেশিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কিয়েভ দেশটির খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে আগ্রহী।

আরও পড়ুনবিরল খনিজ সম্পদের উন্নয়ন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত রাশিয়া: পুতিন২১ ঘণ্টা আগে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন র প র র জন য ত কর ছ

এছাড়াও পড়ুন:

ইরান যে তিন কারণে পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে না

বিশ্বরাজনীতিতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ইস্যু। পশ্চিমা শক্তিগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল, বহু বছর ধরে অভিযোগ করে আসছে, ইরান নাকি গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বা যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আজ পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি, যা এ দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করে। অন্যদিকে ইরান শুরু থেকেই বলে আসছে যে তাদের পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত।

প্রশ্ন হলো, যদি ইরান সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চাইত, তাহলে গত দুই দশকে তা তৈরি করেনি কেন? আর যদি তা না-ই চায়, তাহলে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ চালিয়ে যাচ্ছে কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে ইরানের ধর্মীয় অবস্থান, কৌশলগত চিন্তা, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্বিচারিতা একত্রে বিশ্লেষণ করতে হবে।

আরও পড়ুনইরান এবার বড় যুদ্ধের জন্য যেভাবে প্রস্তুত হবে০৬ জুলাই ২০২৫ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ও নৈতিক অবস্থান

২০০৩ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একটি ঐতিহাসিক ফতোয়া জারি করেন। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি, মজুত কিংবা ব্যবহার ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম।’ এ সিদ্ধান্ত শুধুই ধর্মীয় নয়, বরং একটি নৈতিক অবস্থানও, যেখানে নিরীহ মানুষ হত্যাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। পারমাণবিক বোমা শুধু সামরিক লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করে না, বরং শহর, জনপদ ও লাখ লাখ নিরীহ মানুষের প্রাণ হরণ করে। ইসলামের যুদ্ধনীতিতে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

ইরান মনে করে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার শুধু মানবতার বিরুদ্ধে নয়, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিরুদ্ধে চরম অন্যায়। হিরোশিমা-নাগাসাকির দৃষ্টান্ত এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ দেয়।

কৌশলগত ও সামরিক বাস্তবতা

অনেকের ধারণা, পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেই একটি দেশ নিরাপদ থাকে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলেও ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানে অংশ নিতে বাধ্য হয়। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে। এমনকি রাশিয়া, যাদের বিশ্বের সর্বোচ্চ পারমাণবিক অস্ত্র মজুত রয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোর সঙ্গে কৌশলগতভাবে চাপে পড়েছে। ইসরায়েলও অঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়া সত্ত্বেও ইরানের ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ’-এ বড় ধরনের সামরিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে।

এ বাস্তবতা ইরানকে বুঝিয়ে দিয়েছে, পারমাণবিক অস্ত্র নয়, কার্যকর প্রতিরোধক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। তাই তারা শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, চালকবিহীন বিমান বা ড্রোন এবং কৌশলগত অস্ত্র নির্মাণে জোর দিয়েছে।

সামরিক মহড়া চলাকালে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের অজ্ঞাত স্থান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৯ জানুয়ারি ছবিটি প্রকাশ করে ইরান

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কৌশলগত নেতৃত্ব বিকাশে জোর সেনাপ্রধানের
  • ইরান যে তিন কারণে পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে না