‘অতীতে বাংলাদেশের কোনো সরকারই শেয়ারবাজারকে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে ধারণ (ওউন) করেনি। এ কারণে শেয়ারবাজার সব সরকারের আমলে কমবেশি অবহেলিত ছিল। আর আওয়ামী লীগ সরকার শেয়ারবাজারকে রাজনৈতিকভাবে শোষণ করেছে। আগামী দিনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে আমরা শেয়ারবাজারকে “ওউন” করব। এটিকে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তির অবস্থানে নিয়ে আসা হবে।’

শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্রোকারেজ হাউস মালিকদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় কথাগুলো বলেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। আজ বুধবার রাজধানীর নিকুঞ্জে ডিএসই টাওয়ার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন।

আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, দেশের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলো গত ১৫–১৬ বছরে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা রাজনীতিকরণের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন না করে উল্টো রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেনি। আবার মাত্রাত্রিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে অবিশ্বাস্য রকমের দুর্নীতির বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। তাই আগামী দিনে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এই নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা শিথিল করা হবে।

ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলামের সঞ্চালনা ও সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় সম্মানিত অতিথি ছিলেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। প্যানেল আলোচক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক ব্যাংক সুপারভাইজার সাবিদ সিদ্দিকী, ইংরেজি দৈনিক বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড–এর সম্পাদক ইনাম আহমেদ, অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফের সভাপতি দৌলত আকতার, পুঁজিবাজারবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন সিএমজেএফের সভাপতি গোলাম সামদানী।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ, ডিএসইর সাবেক পরিচালক আহমেদ রশিদ লালী প্রমুখ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন। আলোচনার শুরুতে শেয়ারবাজারের গত ১৫ বছরের পরিস্থিতি ও সমস্যা সমাধানে করণীয় বিষয়ে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা দেন ডিবিএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো.

সাইফউদ্দিন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ ওয়াচডগের। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংস্থাটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ায় তারা ওয়াচডগ হিসেবে তাদের ভূমিকা পালন করেনি। একই অবস্থা ছিল ব্যাংক খাতেও। এ জন্য অর্থনীতির এই দুই খাতে বড় ধরনের লুটপাট ও কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। সর্বক্ষেত্রে যেভাবে ওভার রেগুলেশন বা মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, সেখান থেকে অর্থনীতিকে টেনে তুলতে হলে ডিরেগুলেশন বা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা শিথিল করতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে না।

বর্তমান পুঁজিবাজারসহ সব ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক সরকারের অপেক্ষায় রয়েছে বলে মন্তব্য করেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার ছাড়া বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আস্থা পাবেন না। তাই যত তাড়াতাড়ি নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হবে, বিনিয়োগকারীদের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ ততই সুবিধাজনক হবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শেয়ারবাজার লুটপাটকারীদের বিচার নিশ্চিত করারও দাবি জানান বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এই নেতা। তিনি বলেন, যারা বাজারে কারসাজি করেছে, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অর্থ লুটপাট করেছে, তাদের বিচার করতেই হবে। তাদের বিচারের মাধ্যমেই শেয়ারবাজারে নতুন দিনের সূচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্রোকারেজ হাউস মালিকদেরও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, পুঁজিবাজারের সুশাসন এখন প্রশ্নবিদ্ধ। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির গত দুই কমিশন নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও শোনা যায়, যা দুঃখজনক। প্রশ্নবিদ্ধ নানা কোম্পানিকে তারা বাজারে এনেছে। অনেক ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সেসব কোম্পানি এখন বাজারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বাজার অংশীজনদের সঙ্গে যে দূরত্ব থাকার কথা, তা গত কমিশনের সময় হারিয়ে গেছে। বিদেশে রোড শোর নামে পিকনিক করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিষ্ঠান একে অপরের বন্ধু হয়ে গেছে।

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, অর্থনীতিতে গতি না ফিরলে শেয়ারবাজারেও গতি আসবে না। নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার না আসা পর্যন্ত বেসরকারি খাত বিনিয়োগ করবে না। আর বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়লে পুঁজিবাজারও সমৃদ্ধ হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক কর্মকর্তা সাবিদ সিদ্দিকী বলেন, পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের আস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর আস্থার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় তথ্যের সত্যতা। কোম্পানিগুলো যে তথ্য দেয় তা যদি যথাযথ না হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরে। আর তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে হলে কোম্পানির নিরীক্ষকদের আরও বেশি তদারকি ও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়া শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে অনিয়ম, দুর্নীতিসহ যেসব ‘মোরাল হেজার্ড’ আছে, সেগুলো দূর করতে হবে।

অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাংলাদেশের মতো ছোট একটা বাজারে এত বেশি তদন্ত ও তদন্ত কমিটি হয়, যা বিশ্বের আর কোনো দেশে হয় না। গত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে যে ‘অলিগার্ক’ শ্রেণিগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল, তার উদাহরণ শেয়ারবাজারও। এই বাজারে বিনিয়োগের নানা গল্প তৈরি করে শেয়ারের দাম বাড়ানো ও কমানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে কোম্পানিগুলোতে আত্মীয়স্বজনদের স্বতন্ত্র পরিচালক করে রাখায়।

বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড সম্পাদক ইনাম আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারকে রাজনীতিকরণের বাইরে রাখতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে বাজারের স্বচ্ছতা। আর বাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, গত ১৫ বছরে স্টক এক্সচেঞ্জ পরিচালনায় স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের নামে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা আলাদা করা) নামে রিমিউচুয়ালাইজড হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের পছন্দের লোকদের পরিচালক পদে বসিয়েছে। ফলে স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির বদলে আরও দুর্বল হয়েছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স বতন ত র প র জন ত ক ব ন শ চ ত কর সরক র র ব যবস থ ক আহম দ ব এসইস ন ত কর র সময় ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ বিএসইসির

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। শুভেচ্ছা বিনিময়কালে পুঁজিবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি ও বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।

রবিবার (১৫ জুন) দুপুর ১২টায় ঢাকার আগারগাঁওয়ে সিকিউরিটিজ কমিশন ভবনে এ শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

এ জন্য দেশের পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। উভয় পক্ষের এ বৈঠকে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু সুপারিশ অন্তুর্ভুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে। এ বৈঠকে বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, “বিএসইসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে আজকে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে আমরা পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরব। বিশেষ করে প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কিছু সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আমরা বিএসইসি চেয়ারম্যানের কাছে দাবি জানাবো। আলোচনার মাধ্যমেই যে কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে।”

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত পরিষদের সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম রাইজিংবিডিকে বলেন, “ঈদের আগেই এ বৈঠকের বিষয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বিএসইসি। আমরা বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা করব। আলোচনার মাধ্যমে পুঁজিবাজারের সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে।”

তবে বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমআইএ) সভাপতি এস এম ইকবাল হোসেন রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “আমরা বিএসইসির এ আমন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করেছি। একই সঙ্গে আমরা বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করছি।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম রাইজিংবিডিকে বলেন, “বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময় করা হবে। এ জন্য আজকে বিনিয়োগকারীদের সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।”

ঢাকা/এনটি/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ বিএসইসির