কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, এই বইমেলায় যদি একটি বই কিনতে হয়, তাহলে আপনি কোন বইটি কিনবেন? আমি গত কয়েক বছর ধরেই সাহিত্য সম্পাদনার সূত্রে (যেহেতু ভালো বই বাছাই করতে হয়) এবং মেলার মাঠে মুখোমুখি নামের সাক্ষাৎকার আয়োজনের সূত্রে প্রায় সব শাখার লেখকদের প্রচুর বই পরখ করি। এবার মেলায় আমারও দুটি বই আছে। আছে প্রিয় মানুষের অনেক বই, যেসবের অনেক পাণ্ডুলিপির সঙ্গেই আমার আত্মিক যোগসূত্র রয়েছে। আমি সব ছেড়ে, একটুও না ভেবে একটি বইয়ের কথা বলব। বইটির নাম ‘আধুনিক বাংলা গদ্যভাষার সন্ধানে’। 

ধ্রুপদি সাহিত্যের পাঠক যারা তাদের একটা বড় গোষ্ঠীর কাছে দীর্ঘদিন ধরে মুখে মুখে ফিরেছে ‘খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক’ ও ‘বখতিয়ার খানের সাইকেল’। কথাসাহিত্য পাঠে আগ্রহী কতজনকে যে কত পাঠক এ দুই বই পড়তে পারেন বলে পরামর্শ দিয়েছেন! এ দুই বই ছাড়াও ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ব্যাপক আলাপ-আড্ডার উপলক্ষ তৈরি করেছে ফয়জুল ইসলামের ‘জমিন’, ‘ঘুমতৃষ্ণা’, ‘আয়না’ কিংবা ‘নীলক্ষেতে কেন যাই’-এর মতো উন্মাতাল প্রেমের গল্প। আশির শেষভাগে প্রকাশিত ফয়জুল ইসলামের প্রথম বই নক্ষত্রের ঘোড়ার ৯টা গল্পের যে ভাষাভঙ্গি, যে নির্লিপ্ত বর্ণনা ও বয়ান, তা যে কোনো পাঠককেই উড়িয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। একমাত্র উপন্যাস ‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’-এ একটা বড় সময়, নির্দিষ্ট করে ৯০ দশকের ব্যান্ড সংগীত কালচারের এক প্রিমিয়াম এথনোগ্রাফিক বয়ান তৈরি করেছেন কথাসাহিত্যিক ফয়জুল ইসলাম। তারই গদ্যভাষার নিরন্তর নিরীক্ষা ও অনুসন্ধানের ফসল ‘আধুনিক গদ্যভাষার সন্ধানে’। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের প্রবন্ধসাহিত্যে ভবিষ্যতের এক অবশ্যপাঠ্য বই হয়ে উঠবে এটি, কথাসাহিত্যিকদের জন্য তো গদ্যভাষাটা জানতে হয়, তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য আর কবিদের জন্য তারও বেশি। কারণ, ভাষার অভিভাবক কবিই যদি ভাষাটির মোচড়, বাঁক ও বিন্যাস না জানেন, তবে হবে কীভাবে!

মৃত্যুর ক’দিন আগেই এ বই তাঁর হাতে পৌঁছে দিয়েছেন হাসপাতালের বিছানায় কথাপ্রকাশের প্রকাশক জসিম উদ্দিন। দেশের লেখকসমাজের তরফ থেকেই তিনি ধন্যবাদার্হ। কথাসাহিত্যে; গল্প বা উপন্যাসে কাঠামো, ভাষা আর অবয়বের এক দারুণ ব্লেন্ড করেছিলেন ফয়জুল ইসলাম, সারা আমলাজীবনের পর সাম্প্রতিক সময়ে কাঙ্ক্ষিত লেখকজীবন পেয়েছিলেন, তারই প্রমাণ অপ্রকাশিত দুটি উপন্যাস, ডায়েরি আর নতুন প্রবন্ধের বই। আমরা ফয়জুল ইসলামকে হারিয়ে কথাসাহিত্যের এমন এক রত্ন হারালাম, যা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়; অফেরতযোগ্য ও অগম্য। আমি খুব তর্ক করতাম (ফয়জুল ইসলাম) সুমনের সঙ্গে এ নিয়ে যে, তাঁর ভাষাভঙ্গির যে স্বাতন্ত্র্য তা দাঁড়িয়ে আছে ওয়ালীউল্লাহ, ইলিয়াস, শহীদুল জহিরের বানানো পাটাতনে। উনি আমার মূর্খতার দিকে মিটিমিটি তাকিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি হাসতেন, যেন ‘চ্যালেঞ্জটা দিয়া গেলাম মিঞা, এবার বুঝে পড়ো কিংবা পড়ে বোঝো যদি পারো!’

আমাদের কথাসাহিত্যের পাঠকদের বহু বহুদিন ফয়জুল ইসলামের গদ্য নিয়ে থাকতে হবে, বুঁদ। এই ফয়জুল ইসলামের জীবিতকালের সবশেষ প্রকাশনা ‘আধুনিক বাংলা গদ্যভাষার সন্ধানে’। বাংলা সাহিত্যের মনোযোগী পাঠকরা জানেন, আমাদের ভাষার এই সুলল আধুনিক অবয়বটি বহু পরিশ্রমে তৈরি করে উনিশ শতকের পাঠকের সামনে দিয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু সে অবয়বটি খুঁজে পেতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি তাঁকে। বাংলা আধুনিক গদ্যের পথপরিক্রমার শুলুক সন্ধান করেছেন ফয়জুল ইসলাম এই প্রবন্ধের বইয়ে। সূচিতে চোখ বুলালেও তা বোঝা যায়– রবিঠাকুরের ঠিক আগের বড় কথাকার বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্রের ঠিকুজি নিয়েছেন এখানে ফয়জুল ইসলাম। তার আগে রেখেছেন প্যারীচাঁদ মিত্র, রামমোহন রায়, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, উইলিয়াম কেরি এবং রামরাম বসুকে। উপক্রমণিকায় গদ্যের মাটিকাটা শ্রমিক হিসেবে নিজের গদ্যচিন্তা এবং এই বই লিখতে ব্রতী হওয়ার পেছনে অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহার সঙ্গে ফোনালাপের অবদানকে মনে করেছেন তিনি। 

সত্তরের বেশি ‘ভাষা নিয়ে আকর বই’ ঘেঁটে নিবিড় এবং নানা তলের পঠন পেরিয়ে, নিজের অগ্রজ ওয়াসি আহমেদ থেকে শুরু করে বন্ধুবৃত্তের জাকির তালুকদার, প্রশান্ত মৃধা, আহমাদ মোস্তফা কামাল, আবু হেনা মোস্তফা এনাম কিংবা আফসানা বেগম বা রুমা মোদক বা কিযী তাহনীন, এমনকি মুহিত হাসান দিগন্তর সঙ্গে আলাপ করে খটোমটো গদ্যে নয়, প্রাণোচ্ছল ও স্বতঃস্ফূর্ত গল্প বলার ঢঙে প্রাঞ্জল শিল্পিত শৈলীতে সব ধরনের পাঠক হজম করতে পারবেন এমন করে বইটি লিখেছেন ফয়জুল ইসলাম। বাংলা গদ্যচর্চার দীর্ঘ ইতিহাস ও দৃষ্টান্ত আমলে নিয়ে, জটিল ও একপেশে ব্যাখ্যা পেরিয়ে ফয়জুল এই সময়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে ‘বাংলা গদ্যচর্চার ইতিহাসে দিব্যদ্যুতিময়’ বইটি আমাদের দিয়ে গেছেন। আমাদের এর পরের কাজ বইটি পড়ে ফেলে বাংলা গদ্যকে নিজের হাতের রেখার মতো চিনে ফেলা। বাংলা গদ্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগগুলো, নতুন লেখক কিংবা পাঠক-শিক্ষার্থীদের বইটি প্রবল কাজের হবে। ৭৩টি বইয়ের বদলে একটি বইয়ে পুরো বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশ পাওয়া গেলে তার চেয়ে বড় শিক্ষকের কাজ আর কী?

এই চিনিয়ে দেওয়ার কাজটি করে দিয়েছেন বলেই বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন ফয়জুল ইসলাম। ফয়জুল ইসলাম সুমন, বাংলা কথাসাহিত্যের বন্ড, সুমন বন্ড। 

আধুনিক বাংলা গদ্যভাষার সন্ধানে।। ফয়জুল ইসলাম।। প্রকাশক: কথাপ্রকাশ ।। প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা।। পৃষ্ঠা : ৩৬০ ।। মূল্য: ৭০০ টাকা

শিমুল সালাহ্উদ্দিন, কবি ও সাংবাদিক#

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বইম ল ন ফয়জ ল ইসল ম ফয়জ ল ইসল ম র আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

শালবনে ছেচরা কই ও পাটখই

বিভতিভূষণের আরণ্যক উপন্যাসে একজন যুগলপ্রসাদ ছিলেন, যিনি লবটুলিয়ার জঙ্গলে সরস্বতী কুন্ডের পাড়ে নানা জায়গা থেকে নানা প্রজাতির গাছপালা এনে লাগাতেন। সেসব গাছে ফুল ফুটলে আনন্দে তিনি আত্মহারা হয়ে যেতেন। আমারও একজন যুগলপ্রসাদ ছিলেন, নাম আজাহার। প্রায় আমারই সমবয়সী।

টাঙ্গাইলের সখীপুরে বিভিন্ন শালবনে ঘুরতে গেলে মাঝেমধ্যে তিনি আমার সাথি হতেন। শালবনে কত গাছ! তেমন কিছুই চিনি না। কিন্তু সেই শালবনের কোলে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা আজাহার ঠিকই সেসব গাছ চিনতেন, আর জিজ্ঞেস করলে টপাটপ নাম বলে দিতেন। কিন্তু গোলমাল বাধত সেসব নাম শুনে। কেননা সেসব নাম বলতেন, তাঁদের স্থানীয় ভাষায়। বইয়ে সেসব নাম খুঁজে পাওয়া যেত না।

একদিন শালবনের মধ্যে একটা ছোট গাছ দেখলাম, গাছের গুঁড়ির চারদিকে তীক্ষ্ণসরু ও সোজা প্রচুর কাঁটা বেরিয়েছে। পাতাগুলো দেখতে কিছুট পেয়ারাপাতার মতো। প্রচুর ডালপালায় গাছটার মাথা ঝাঁকড়া হয়ে আছে। ডালের আগায় শিষের মতো মঞ্জরিতে প্রচুর ঘিয়া ও সাদাটে রঙের খুদে ফুল ফুটেছে। চিনি না। তাই আজাহারকে জিজ্ঞেস করলাম, নাম কী? চট করেই বলে দিলেন, ছেচরা কই। মাছের নাম কই হয় জানি, কিন্তু কোনো গাছের নাম কই হতে পারে? অগত্যা ছবি তুলে ওই নামকেই মনে গেঁথে ফিরে এলাম ঢাকায়।

আজাহার বললেন, এখন ফুল দেখছেন। কদিন পরেই ওসব ফুল থেকে ছোট ছোট গুলির মতো প্রচুর ফল ধরবে। ছোটবেলায় আমরা সেসব কাঁচা ফল নিয়ে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ফটকা বানিয়ে তার চোঙে একটা একটা করে ফল দিয়ে বন্দুকের মতো গুলি গুলি খেলতাম। চোঙের ভেতরে একটা সরু কাঠি ঢুকিয়ে চাপ দিয়ে সেসব ফল গুলির মতো ফাটাতাম। ফটাস করে শব্দ হতো। এ সময় মাসখানেকের জন্য আমরা এ গাছের ফল, পরে জালি খেজুর নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। শালবনে সে সময় এ গাছের অভাব ছিল না। এখন তো দেখতে হলে খুঁজে বের করতে হয়।

ফিরে এসে সে ছবি পাঠালাম জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের সাবেক বোটানিস্ট সামসুল হক ভাইয়ের কাছে। দুই দিন পরেই তিনি জানালেন, গাছটার স্থানীয় নাম ছেচরা কই, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Bridelia retusa, গোত্র ফাইলেনথেসি। বইপত্রে এ গাছের চারটি বাংলা নাম পেলাম—কাঁটাকই, কাঁটাকুশি, কামকই, আকদানা। বাংলাদেশ ছাড়াও এ গাছ আছে নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে। সাধারণত উঁচু ও শুষ্ক বনাঞ্চলে এ গাছ দেখা যায়। ছোট বৃক্ষজাতীয় গাছ, প্রায় ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়, দ্রুত বাড়ে। এ গাছের কাঁটা থাকায় বন্য প্রাণীরা এদের ধারে ঘেঁষে না, এমনকি এর বাকল দিয়েও বিষ তৈরি করা হয় বলে শুনেছি।

ফল গোলাকার, ছোট, কাঁচা ফল ময়লা সবুজ, পাকলে খোসায় লাল রং ধরে। ছেচরা কইগাছের কাঠ মাঝারি শক্ত থেকে শক্ত, কাঠের রং ময়লা লাল। রঙে ও গুণে কাঠ উৎকৃষ্ট। নির্মাণকাজ ও গরুর গাড়ির চাকা বানাতে ব্যবহার করা হয়। জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও শুষ্ক তৃণভূমিতে যদি কোনো গাছ থাকে, তবে সেসব ঘাসে আগুন দিলে এ গাছ পোড়ে না বলে কথিত রয়েছে। বীজ দ্বারা সহজে বংশবৃদ্ধি বা চারা হয়।

পূর্বাচল উপশহরের শালবনে দেখা পাটখই ফল

সম্পর্কিত নিবন্ধ