রিকশা চালানোর অবসরে পড়েন লিও তলস্তয়
Published: 28th, February 2025 GMT
কখনো রিকশা চালান তিনি, কখনো কারখানায় কাজ করেন, খেতখামারে মজুরি খাটেন, ফেরি করে সবজিও বেচেন, আবার কখনো হয়ে যান নির্মাণশ্রমিক। তবে রিকশা চালানোই তাঁর মূল পেশা। বাকি সব কাজ করেন শ্রমিকের জীবনটা কেমন, সে উপলব্ধি পেতে।
এভাবে নানা জায়গায় ঘুরে বাস্তব জীবনের উপজীব্য খুঁজে বেড়ান। এই কাজের ফাঁকে দিনে অন্তত চার ঘণ্টা পড়াশোনা করেন। মাসে কমসে কম দুটি বই কেনেন। ঘরে বই রাখার জায়গা নেই।
আলু-পেঁয়াজের সঙ্গে বস্তায় বস্তায় ভরে রেখেছেন সেসব। পড়েনও সব গুরুগম্ভীর সব কিতাব। লিও তলস্তয়, গোর্কি, ইয়ভাল নোয়াহ হারারি, ভিক্টর হুগো, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, চে গুয়েভারা, মার্ক্স ছাড়াও পৃথিবীর বাঘা বাঘা লেখকের লেখা বই আছে তাঁর কাছে।
চট্টগ্রামের এমন কোনো সাহিত্য আসর নেই, যেটাতে রশিদুল যাননি। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে তাঁর কাব্যগ্রন্থটি আমি অনেক যত্ন করে প্রকাশ করেছি।’চট্টগ্রামের প্রকাশনী নন্দন বইঘরের স্বত্বাধিকারী সুব্রত কান্তি চৌধুরীশুধু পড়েই ক্ষান্ত হননি, লিখেও চলেছেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সেই কালপুরুষ। এখনো প্রকাশ হয়নি কাব্যগ্রন্থ সমৃদ্ধ সংঘাত, প্রবন্ধের বই এক মিনিট সময়ের দাম এক শত কোটি টাকা, উপন্যাস বনমুরগি বউ, গল্পগ্রন্থ দেনু। তাঁর অনেক ছড়া, গল্প ও কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এখন লিখছেন ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থবিধি অনুসারে জটিল এক উপন্যাস গৌরীর পান্তাবেলা।
এই রিকশাচালকের নাম রশিদুল ইসলাম (৩৮)। বাড়ি নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার মহেশপুর গ্রামে। বাবা ছিলেন দরিদ্র কৃষক। ঠিকমতো পড়াশোনার খরচ দিতে পারতেন না। তাঁরও বিদ্যালয়ের ধরাবাঁধা নিয়ম ভালো লাগত না। এসএসসির পাটই চুকাতে পারেননি।
সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ছোট্ট খুপরির মতো এক কক্ষের মাটির ঘর। ঘরে বই রাখার কোনো সেলফ নেই। সদ্য পড়ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ তরফদারের বৈদিক ব্যাকরণ।ব্যাকরণ ঘাঁটাঘাঁটি ও বই সংগ্রহ
ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণবিধির উপন্যাস লিখতে গিয়ে রশিদুল পড়েছেন বিস্তর। তাঁর কাছে আছে বাংলা ব্যাকরণের অনেক বই। সংস্কৃত পণ্ডিত শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ক্রিয়াভিত্তিক ও বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন, ধীরেন্দ্রনাথ তরফদারের বৈদিক ব্যাকরণ, প্রথম বর্ণনামূলক ভাষাবিদ ও ভাষাবিজ্ঞানের জনক পাণিনির অষ্ট্যাধয়ী সংস্কৃত ব্যাকরণ, রাজা রামমোহন রায় রচিত গৌড়ীয় ব্যাকরণ, ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যবিশারদ ড.
সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ছোট্ট খুপরির মতো এক কক্ষের মাটির ঘর। ঘরে বই রাখার কোনো সেলফ নেই। সদ্য পড়ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ তরফদারের বৈদিক ব্যাকরণ। সেটা পাওয়া যায় বিছানায়। ঘরের শোয়ার জায়গার পাশাপাশি আলু–পেঁয়াজের সঙ্গে রেখেছেন তিন বস্তা বই। একে একে বের করলেন রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভোল্গা থেকে গঙ্গা, আহমদ শরীফের বাঙলা বাঙালী বাঙলাদেশ, সিমোন দ্য বোভোয়ারের দ্বিতীয় লিঙ্গ, সত্যেন সেনের আলবিরুণী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোঁয়ারি, মো. আব্দুল হালিমের দার্শনিক প্রবন্ধাবলী-তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস, আনা কারেনিনা, ইয়ভাল নোয়াহ হারারির স্যাপিয়েন্স, ভিক্টোর হুগোর লা মিজারেবল, গোর্কির মা। রশিদুল বললেন, তাঁর সব বই-ই ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি টানে ম্যাক্সিম গোর্কি আর শরৎচন্দ্রের লেখা।
রশিদুলের বাড়িতে একদিন
মহেশপুর হচ্ছে নওগাঁর ধামইরহাটের ভারতীয় সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। রশিদুলের ছোট্ট বাড়িটি গ্রামের এক পাশে। স্ত্রী মোবিনা আকতার বাড়িতে কৃষিকাজ ও ছোট্ট একটি খামার দেখাশোনা করেন। রশিদুল ইসলামের মেয়ে রাফিয়া জান্নাত এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন। ছেলে মহসিন রেজা পড়ছে চতুর্থ শ্রেণিতে।
বছরখানেক আগে চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এখন বাড়িতেই আছেন রশিদুল। ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর সঙ্গে কথা হয় ধামইরহাট আগ্রাদ্বিগুণ বাজারের বিহারের (বৌদ্ধবিহার) ওপরে বসে। সঙ্গে ছিলেন রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও মাউশি রাজশাহীর সহকারী পরিচালক আলমাছ উদ্দিনসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক।
রশিদুল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ নিয়ে যে উপন্যাসটি লিখছেন, সেখানে তিনি সাধু ভাষার প্রয়োগ করে তাঁদের জীবনচিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করছেন। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ভাষাকে উপন্যাসের উপজীব্য করে তোলা একটি কঠিন কাজ। তিনি সেই দুঃসাধ্য কাজটি করার সাহস দেখিয়েছেন।আলমাছ উদ্দিন, রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপকমাঠে ধান রোপণের কাজ করছিলেন। খবর পেয়ে উঠে এলেন রশিদুল। আজকের মজুরি তো পাওয়া যাবে না—এই প্রশ্নের উত্তরে রশিদুল বললেন, ‘টাকাপয়সা আজও নাই, কালও নাই।’ রশিদুল ইসলামের দাবি, তাঁর গৌরীর পান্তাবেলা উপন্যাস পাঠের আনন্দে পাঠক আসলে ব্যাকরণ পড়বেন। পড়ে শোনালেন পাণ্ডুলিপির অনেকটা। এটা আত্রাইপারের মোহনপুরের মাহলে সম্প্রদায়ের গৌরীর বেড়ে ওঠার কাহিনি। শুনতে শুনতে মনে হলো, সাহিত্যরসের সঙ্গে পাঠক পাবেন এতে ব্যবহৃত শব্দের ভেতরের গল্প। তিনি ‘মোহন’ ও ‘পুর’-এর ভেতরের যে ব্যাকরণ, তা গল্পের ছলে বলে গেছেন। যেমন শব্দের সব কটি বর্ণের অর্থ যোগ করে তাঁর ভাষায় মোহনপুরের অর্থ দাঁড়ায় একটি ‘রহস্য লুক্কায়িত গ্রাম’। এই উপন্যাসে গৌরীর সংলাপ রচিত হবে মাহলে ভাষায়। সেটার বাংলা অনুবাদও থাকবে। বইয়ের শেষে মাহলে শব্দের বাংলা অর্থও দেওয়া থাকবে।
জানতে চাইলে আলমাছ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, রশিদুল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ নিয়ে যে উপন্যাসটি লিখছেন, সেখানে তিনি সাধু ভাষার প্রয়োগ করে তাঁদের জীবনচিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করছেন। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ভাষাকে উপন্যাসের উপজীব্য করে তোলা একটি কঠিন কাজ। তিনি সেই দুঃসাধ্য কাজটি করার সাহস দেখিয়েছেন।
পাণ্ডুলিপি ও বর্ণবিধি
রশিদুল ইসলামের গৌরীর পান্তাবেলা উপন্যাসটি এখনো পাণ্ডুলিপি পর্যায়ে আছে। এটি একই সঙ্গে জীবনমুখী ব্যাকরণ। উপন্যাসের নায়িকা গৌরী মোহনপুরের আত্রাইপারের মাহলে সম্প্রদায়ের তরুণী। ভিটেমাটি-সম্ভ্রম হারিয়ে আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারকের উদ্দেশে এমন একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন, যা একই সঙ্গে আক্রমণাত্মক ও শুনতে আদিরসাত্মক। উপন্যাসে শব্দটির বর্ণভিত্তিক অর্থ বের করা হয়েছে। সেই ব্যাখ্যায় শব্দটি আদৌ আদিরসাত্মক নয়, বরং জীবনমুখী আঞ্চলিক বাংলা একটি শব্দ।
ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণবিধি বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে একটি উদাহরণ দেন রশিদুল। আধুনিক ভাষাবিদেরা লিখছেন, ‘বাড়ি’। এই বাড়ি মানে কিন্তু বেতের বাড়ি। হ্রস্ব ই–কার হচ্ছে গতি। আর ঈ–কার হচ্ছে গতিশীলতার স্পেস। যেমন ‘বাড়ী’ হচ্ছে বেড়ে ওঠার স্পেস। আদতে বাড়ি বোঝাতে ঈ–কারই বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন ব্যাকরণবিদেরা।
২০০৬ সালে চট্টগ্রামে যান রশিদুল। চট্টগ্রামের প্রকাশনী নন্দন বইঘর রশিদুল ইসলামের সেই কালপুরুষ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী সুব্রত কান্তি চৌধুরী বললেন, ‘আমি জানতাম না যে রশিদুল ভাই আমাকে ভালোমতো চেনেন। নন্দনে এসে বই পড়তেন। একদিন মেলা শেষে বই নিয়ে যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিলাম। অতি উৎসাহী হয়ে রশিদুল ইসলাম রিকশায় নিয়ে এলেন। যেতে যেতে তাঁর পরিচয় পাই। রিকশা চালানোর মতো কঠোর পরিশ্রমের পরেও তিনি দিনে চার ঘণ্টা পড়াশোনা করেন। এই খাটুনির টাকায় মাসে দুটি বই কেনেন। চট্টগ্রামের এমন কোনো সাহিত্য আসর নেই, যেটাতে রশিদুল যাননি। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে তাঁর কাব্যগ্রন্থটি আমি অনেক যত্ন করে প্রকাশ করেছি।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জনগ ষ ঠ র উপন য স ব য করণ ব য কর র জ বন
এছাড়াও পড়ুন:
ইতিহাসের দ্রুততম মানবের এখন সিঁড়ি ভাঙতে দম ফুরিয়ে আসে
হঠাৎ মনে হতে পারে, কথাবার্তায় লোকটা এখন তো বেশ সাদামাটা। তা-ই কি?
মোটেও না। চেনা সেই ক্যারিশমা যে চলে যায়নি, সেটা বোঝা গেল ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উসাইন বোল্ট যখন সোজা বলে দিলেন, কেন তাঁর রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারেননি। মনে হবে, এই তো সেই বোল্ট। আবার একটু ধাক্কাও লাগবে পরের কথাগুলো শুনলে। একসময়ের সুপারম্যান এখন তাহলে এমন আটপৌরে জীবন কাটাচ্ছেন! যে জীবনে নাকি সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় তাঁর দম ফুরিয়ে আসে! অথচ এই লোকটাই একসময় ১০০ মিটার দৌড়েছেন ৯.৫৮ সেকেন্ডে।
আরও পড়ুনআকাশছোঁয়ার অভিযানে ডুপ্লান্টিসের আবারও বিশ্ব রেকর্ড১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫টেলিগ্রাফের সঙ্গে সাক্ষাৎকারটা বোল্ট দিয়েছেন টোকিওতে। বিশ্ব অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপ দেখতে গেছেন সেখানে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ২০১৭ সালে অবসরের পর এই প্রথম অ্যাথলেটিকসের কোনো বড় আসর দেখতে গেলেন আটবারের এই অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন। জাপানি দর্শকেরা অবশ্য তাঁকে দেখে ঠিকই উল্লাসে ফেটে পড়েছে। তবে বোল্ট এখন বদলে গেছেন অনেকটাই। জ্যামাইকায় এখন তাঁর ঘরোয়া জীবনটা আলোয় থাকার সময়ের সেই জীবনের সঙ্গে একেবারেই মেলে না।
অবসর নেওয়ার পর এই প্রথম অ্যাথলেটিকসের কোনো বড় আসরে এলেন বোল্ট। টোকিওতে বিশ্ব অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে