রিকশা চালানোর অবসরে পড়েন লিও তলস্তয়
Published: 28th, February 2025 GMT
কখনো রিকশা চালান তিনি, কখনো কারখানায় কাজ করেন, খেতখামারে মজুরি খাটেন, ফেরি করে সবজিও বেচেন, আবার কখনো হয়ে যান নির্মাণশ্রমিক। তবে রিকশা চালানোই তাঁর মূল পেশা। বাকি সব কাজ করেন শ্রমিকের জীবনটা কেমন, সে উপলব্ধি পেতে।
এভাবে নানা জায়গায় ঘুরে বাস্তব জীবনের উপজীব্য খুঁজে বেড়ান। এই কাজের ফাঁকে দিনে অন্তত চার ঘণ্টা পড়াশোনা করেন। মাসে কমসে কম দুটি বই কেনেন। ঘরে বই রাখার জায়গা নেই।
আলু-পেঁয়াজের সঙ্গে বস্তায় বস্তায় ভরে রেখেছেন সেসব। পড়েনও সব গুরুগম্ভীর সব কিতাব। লিও তলস্তয়, গোর্কি, ইয়ভাল নোয়াহ হারারি, ভিক্টর হুগো, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, চে গুয়েভারা, মার্ক্স ছাড়াও পৃথিবীর বাঘা বাঘা লেখকের লেখা বই আছে তাঁর কাছে।
চট্টগ্রামের এমন কোনো সাহিত্য আসর নেই, যেটাতে রশিদুল যাননি। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে তাঁর কাব্যগ্রন্থটি আমি অনেক যত্ন করে প্রকাশ করেছি।’চট্টগ্রামের প্রকাশনী নন্দন বইঘরের স্বত্বাধিকারী সুব্রত কান্তি চৌধুরীশুধু পড়েই ক্ষান্ত হননি, লিখেও চলেছেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সেই কালপুরুষ। এখনো প্রকাশ হয়নি কাব্যগ্রন্থ সমৃদ্ধ সংঘাত, প্রবন্ধের বই এক মিনিট সময়ের দাম এক শত কোটি টাকা, উপন্যাস বনমুরগি বউ, গল্পগ্রন্থ দেনু। তাঁর অনেক ছড়া, গল্প ও কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এখন লিখছেন ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থবিধি অনুসারে জটিল এক উপন্যাস গৌরীর পান্তাবেলা।
এই রিকশাচালকের নাম রশিদুল ইসলাম (৩৮)। বাড়ি নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার মহেশপুর গ্রামে। বাবা ছিলেন দরিদ্র কৃষক। ঠিকমতো পড়াশোনার খরচ দিতে পারতেন না। তাঁরও বিদ্যালয়ের ধরাবাঁধা নিয়ম ভালো লাগত না। এসএসসির পাটই চুকাতে পারেননি।
সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ছোট্ট খুপরির মতো এক কক্ষের মাটির ঘর। ঘরে বই রাখার কোনো সেলফ নেই। সদ্য পড়ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ তরফদারের বৈদিক ব্যাকরণ।ব্যাকরণ ঘাঁটাঘাঁটি ও বই সংগ্রহ
ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণবিধির উপন্যাস লিখতে গিয়ে রশিদুল পড়েছেন বিস্তর। তাঁর কাছে আছে বাংলা ব্যাকরণের অনেক বই। সংস্কৃত পণ্ডিত শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ক্রিয়াভিত্তিক ও বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন, ধীরেন্দ্রনাথ তরফদারের বৈদিক ব্যাকরণ, প্রথম বর্ণনামূলক ভাষাবিদ ও ভাষাবিজ্ঞানের জনক পাণিনির অষ্ট্যাধয়ী সংস্কৃত ব্যাকরণ, রাজা রামমোহন রায় রচিত গৌড়ীয় ব্যাকরণ, ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যবিশারদ ড.
সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ছোট্ট খুপরির মতো এক কক্ষের মাটির ঘর। ঘরে বই রাখার কোনো সেলফ নেই। সদ্য পড়ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ তরফদারের বৈদিক ব্যাকরণ। সেটা পাওয়া যায় বিছানায়। ঘরের শোয়ার জায়গার পাশাপাশি আলু–পেঁয়াজের সঙ্গে রেখেছেন তিন বস্তা বই। একে একে বের করলেন রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভোল্গা থেকে গঙ্গা, আহমদ শরীফের বাঙলা বাঙালী বাঙলাদেশ, সিমোন দ্য বোভোয়ারের দ্বিতীয় লিঙ্গ, সত্যেন সেনের আলবিরুণী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোঁয়ারি, মো. আব্দুল হালিমের দার্শনিক প্রবন্ধাবলী-তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস, আনা কারেনিনা, ইয়ভাল নোয়াহ হারারির স্যাপিয়েন্স, ভিক্টোর হুগোর লা মিজারেবল, গোর্কির মা। রশিদুল বললেন, তাঁর সব বই-ই ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি টানে ম্যাক্সিম গোর্কি আর শরৎচন্দ্রের লেখা।
রশিদুলের বাড়িতে একদিন
মহেশপুর হচ্ছে নওগাঁর ধামইরহাটের ভারতীয় সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। রশিদুলের ছোট্ট বাড়িটি গ্রামের এক পাশে। স্ত্রী মোবিনা আকতার বাড়িতে কৃষিকাজ ও ছোট্ট একটি খামার দেখাশোনা করেন। রশিদুল ইসলামের মেয়ে রাফিয়া জান্নাত এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন। ছেলে মহসিন রেজা পড়ছে চতুর্থ শ্রেণিতে।
বছরখানেক আগে চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এখন বাড়িতেই আছেন রশিদুল। ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর সঙ্গে কথা হয় ধামইরহাট আগ্রাদ্বিগুণ বাজারের বিহারের (বৌদ্ধবিহার) ওপরে বসে। সঙ্গে ছিলেন রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও মাউশি রাজশাহীর সহকারী পরিচালক আলমাছ উদ্দিনসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক।
রশিদুল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ নিয়ে যে উপন্যাসটি লিখছেন, সেখানে তিনি সাধু ভাষার প্রয়োগ করে তাঁদের জীবনচিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করছেন। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ভাষাকে উপন্যাসের উপজীব্য করে তোলা একটি কঠিন কাজ। তিনি সেই দুঃসাধ্য কাজটি করার সাহস দেখিয়েছেন।আলমাছ উদ্দিন, রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপকমাঠে ধান রোপণের কাজ করছিলেন। খবর পেয়ে উঠে এলেন রশিদুল। আজকের মজুরি তো পাওয়া যাবে না—এই প্রশ্নের উত্তরে রশিদুল বললেন, ‘টাকাপয়সা আজও নাই, কালও নাই।’ রশিদুল ইসলামের দাবি, তাঁর গৌরীর পান্তাবেলা উপন্যাস পাঠের আনন্দে পাঠক আসলে ব্যাকরণ পড়বেন। পড়ে শোনালেন পাণ্ডুলিপির অনেকটা। এটা আত্রাইপারের মোহনপুরের মাহলে সম্প্রদায়ের গৌরীর বেড়ে ওঠার কাহিনি। শুনতে শুনতে মনে হলো, সাহিত্যরসের সঙ্গে পাঠক পাবেন এতে ব্যবহৃত শব্দের ভেতরের গল্প। তিনি ‘মোহন’ ও ‘পুর’-এর ভেতরের যে ব্যাকরণ, তা গল্পের ছলে বলে গেছেন। যেমন শব্দের সব কটি বর্ণের অর্থ যোগ করে তাঁর ভাষায় মোহনপুরের অর্থ দাঁড়ায় একটি ‘রহস্য লুক্কায়িত গ্রাম’। এই উপন্যাসে গৌরীর সংলাপ রচিত হবে মাহলে ভাষায়। সেটার বাংলা অনুবাদও থাকবে। বইয়ের শেষে মাহলে শব্দের বাংলা অর্থও দেওয়া থাকবে।
জানতে চাইলে আলমাছ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, রশিদুল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ নিয়ে যে উপন্যাসটি লিখছেন, সেখানে তিনি সাধু ভাষার প্রয়োগ করে তাঁদের জীবনচিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করছেন। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ভাষাকে উপন্যাসের উপজীব্য করে তোলা একটি কঠিন কাজ। তিনি সেই দুঃসাধ্য কাজটি করার সাহস দেখিয়েছেন।
পাণ্ডুলিপি ও বর্ণবিধি
রশিদুল ইসলামের গৌরীর পান্তাবেলা উপন্যাসটি এখনো পাণ্ডুলিপি পর্যায়ে আছে। এটি একই সঙ্গে জীবনমুখী ব্যাকরণ। উপন্যাসের নায়িকা গৌরী মোহনপুরের আত্রাইপারের মাহলে সম্প্রদায়ের তরুণী। ভিটেমাটি-সম্ভ্রম হারিয়ে আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারকের উদ্দেশে এমন একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন, যা একই সঙ্গে আক্রমণাত্মক ও শুনতে আদিরসাত্মক। উপন্যাসে শব্দটির বর্ণভিত্তিক অর্থ বের করা হয়েছে। সেই ব্যাখ্যায় শব্দটি আদৌ আদিরসাত্মক নয়, বরং জীবনমুখী আঞ্চলিক বাংলা একটি শব্দ।
ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণবিধি বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে একটি উদাহরণ দেন রশিদুল। আধুনিক ভাষাবিদেরা লিখছেন, ‘বাড়ি’। এই বাড়ি মানে কিন্তু বেতের বাড়ি। হ্রস্ব ই–কার হচ্ছে গতি। আর ঈ–কার হচ্ছে গতিশীলতার স্পেস। যেমন ‘বাড়ী’ হচ্ছে বেড়ে ওঠার স্পেস। আদতে বাড়ি বোঝাতে ঈ–কারই বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন ব্যাকরণবিদেরা।
২০০৬ সালে চট্টগ্রামে যান রশিদুল। চট্টগ্রামের প্রকাশনী নন্দন বইঘর রশিদুল ইসলামের সেই কালপুরুষ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী সুব্রত কান্তি চৌধুরী বললেন, ‘আমি জানতাম না যে রশিদুল ভাই আমাকে ভালোমতো চেনেন। নন্দনে এসে বই পড়তেন। একদিন মেলা শেষে বই নিয়ে যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিলাম। অতি উৎসাহী হয়ে রশিদুল ইসলাম রিকশায় নিয়ে এলেন। যেতে যেতে তাঁর পরিচয় পাই। রিকশা চালানোর মতো কঠোর পরিশ্রমের পরেও তিনি দিনে চার ঘণ্টা পড়াশোনা করেন। এই খাটুনির টাকায় মাসে দুটি বই কেনেন। চট্টগ্রামের এমন কোনো সাহিত্য আসর নেই, যেটাতে রশিদুল যাননি। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে তাঁর কাব্যগ্রন্থটি আমি অনেক যত্ন করে প্রকাশ করেছি।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জনগ ষ ঠ র উপন য স ব য করণ ব য কর র জ বন
এছাড়াও পড়ুন:
তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়
ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত হয়েছিল সংবিধানে, তা–ই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে আপিল বিভাগে এ–সংক্রান্ত শুনানিতে বলেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল–পরবর্তী নির্বাচনগুলোর চিত্র দেখিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেছেন, ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে—দেশের জনগণ এমন বিতর্কিত কোনো নির্বাচন হোক, তা চায় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ওপর আজ রোববার ষষ্ঠ দিনের মতো শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে বিএনপি মহাসচিবের আপিল–সংক্রান্ত শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন।
সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। বেলা ১১টা থেকে মাঝে বিরতি দিয়ে ১টা পর্যন্ত শুনানি চলে। পরবর্তী শুনানির জন্য মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দিন রাখা হয়েছে। এদিন বিরতির পর শুনানি শুরুর আগে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে আসেন বাংলাদেশে সফররত নেপালের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাউত। বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে বসে এই শুনানি পর্যবেক্ষণ করেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই একটি আলোচিত বিষয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে যুক্ত করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এই ব্যবস্থা বাতিল করে। তার আগে সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
ওই রায়ের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও আপিল বিভাগের রুলসের ব্যত্যয় ঘটেছে দাবি করে শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রায়ে সইয়ের আগেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ সংশোধনী) করে। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও স্বাক্ষরের (বিচারপতিদের রায়ে সই করা) আগে সরকার সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের বলে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে, যা দেশবাসীর জানা। দেশের বিবেকবান মানুষ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এই সংবিধান সংশোধনকে সরকারের হীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল। এটি জনগণের বিরুদ্ধে বড় ষড়যন্ত্র।’
বিএনপির একসময়ের আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন শুনানিতে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছেন। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার লক্ষ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) দেশের প্রচলিত আইন ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুলস যথাযথভাবে অনুসরণ না করে সর্বশেষ (পূর্ণাঙ্গ রায়) রায় দেন, যা প্রথমে দেওয়া রায়ের (শর্ট অর্ডার সংক্ষিপ্ত রায়) সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’
শুনানিতে অবসরের পর রায়ে সই প্রসঙ্গ
অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করলে তার আইনগত মূল্য কী হবে—এ প্রসঙ্গ ওঠে শুনানিতে। বিরতির পর শুনানিতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিবের অপর আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, রায় ঘোষণা ও রায়ে সই করা দুটি ভিন্ন বিষয়। রায় ঘোষণার সময় এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদে আসীন ছিলেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে যা ছিল, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে।
দেওয়ানি কার্যবিধি, আপিল বিভাগের রুলস ও সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘শর্ট অর্ডারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে পার্থক্য, তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করেছেন একজন বিচারপতি। এই বিচারপতিও বলেননি অবসরের পরে বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা রায়টি অবৈধ হয়েছে। স্বাক্ষর পরে করেছেন বলে রায় অবৈধ বলা যাবে না। কারণ, অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করতে পারবেন না কিংবা কত দিনের মধ্যে সই না করলে সেটি অবৈধ হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আইনে নেই।’
রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রকাশ্য আদালতে কোনো বিচারপতি যখন কোনো রায় দেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে দিলে ছোটখাটো দাড়ি, কমা, শব্দ বাদ পড়েছে—এগুলো ছাড়া যেকোনো পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই সেটি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) ছাড়া হবে না, যার ওপর শুনানি চলছে।’
এ মামলায় সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়। ওই প্রসঙ্গে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক বলেন, ‘অবসরের পর রায়ে সই করলে তা বাতিল বা অকার্যকর হবে না। যেদিন প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করলেন, সেই তারিখ হচ্ছে মূল। এটি হচ্ছে রায়ের তারিখ। কবে সই করলেন, এটি প্রাসঙ্গিক নয়। আপিল বিভাগের রুলসে বলা আছে, এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধির (সিপিসি) বিধান কার্যকর হবে না। আপিল বিভাগের জন্য সিপিসি প্রযোজ্য নয়।’
মামলার পূর্বাপর
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন (রিভিউ) করেন। সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।
রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে অপর রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এ অনুসারে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের করা রিভিউসহ অপর রিভিউ আবেদন এবং বিএনপির মহাসচিবের আপিল শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।
পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের ওপর ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। এরপর ইন্টারভেনার হিসেবে যুক্ত সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এরপর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল এবং এ এস এম শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন। শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য উপস্থাপনের পর হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক শুনানি করেন। এরপর বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে জয়নুল আবেদীন শুনানি শুরু করেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পর গত আগস্টে বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হন। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।