রমজানে আরও জোরদার হচ্ছে অভিযান, থাকছে না ‘ডেভিল হান্ট’ নাম
Published: 3rd, March 2025 GMT
রোজা ও ঈদের কেনাকাটা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ঘিরে সক্রিয় হচ্ছে পেশাদার ও মৌসুমি অপরাধীরা। জাল টাকার কারবার, ছিনতাই, ডাকাতি, গাড়ি চুরি, অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির কিছু তৎপরতা ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। এ অবস্থায় রমজান মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযান আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে অভিযানের নাম ‘ডেভিল হান্ট’ আর থাকছে না বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়–সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।
রমজান মাসে বিশেষ কিছু অপরাধ বৃদ্ধির আশঙ্কার কথা একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এমন আশঙ্কা সামনে রেখে সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা প্রস্তুতি জোরদার করতে বলা হয়েছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোও রাজধানীসহ সারা দেশে নিরাপত্তাব্যবস্থা নতুনভাবে সাজিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল রোববার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে কোর কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য চলমান বিশেষ অভিযান রমজান মাসে আরও জোরদার করা হবে। মহাসড়কে ডাকাতি ও চাঁদাবাজি ঠেকাতে এবং ব্যাংকে বড় অঙ্কের টাকা জমা ও উত্তোলনের সময় ডাকাতি বন্ধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে শুরু হয় অপারেশন ডেভিল হান্ট। ১ মার্চ পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর এই অভিযানে ১১ হাজার ৮৮২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুরসহ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলার শিকার হন ১৫-১৬ জন শিক্ষার্থী। তাঁদের একজন মারা যান। এর পর থেকে চলতে থাকে বিশেষ অভিযান।
গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোর কমিটির বৈঠকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নিয়েও আলোচনা হয়। বৈঠকে বলা হয়, অপরাধ দমনে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলবে, তবে অপারেশন ডেভিল হান্ট নাম থাকবে না। বিশেষ অভিযানে যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা না ঘটে, কোর কমিটির বৈঠকে এ বিষয় নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নাম নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়সহ অনেকেই এই নাম পছন্দ করছেন না বলে গতকালের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এমন অবস্থায় অপরাধ দমনে যৌথ বাহিনীর অভিযান আরও জোরদার করা হলেও ডেভিল হান্ট নামটি আর ব্যবহার করা হবে না বলে জানা গেছে।
বৈঠকের এই সিদ্ধান্তের পর গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ডেভিল হান্টে গ্রেপ্তারের সংখ্যা জানানো হয়নি। যদিও ৮ ফেব্রুয়ারি এ অভিযান শুরুর পর থেকে প্রতিদিনই আলাদাভাবে অপারেশন ডেভিল হান্টে গ্রেপ্তারের খবর জানানো হতো।
সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য চলমান বিশেষ অভিযান রমজান মাসে আরও জোরদার করা হবে। মহাসড়কে ডাকাতি ও চাঁদাবাজি ঠেকাতে এবং ব্যাংকে বড় অঙ্কের টাকা জমা ও উত্তোলনের সময় ডাকাতি বন্ধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।রমজানে অপরাধ বৃদ্ধির শঙ্কাআইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, রোজা ও ঈদের কেনাকাটা ঘিরে রমজান মাসে মানুষের তৎপরতা বাড়ে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও বাড়ে লেনদেন। গভীর রাত পর্যন্ত বিপণিবিতানকেন্দ্রিক জনসমাগমও বেড়ে যায়। তারাবিহর নামাজ ও সাহ্রি ঘিরেও পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে সর্বত্র রাতের বেলায় মানুষের উপস্থিতি থাকে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাপক জনসমাগমের সুযোগটিই কাজে লাগায় অপরাধীরা। ব্যক্তিগত গাড়ি ও যানবাহন রেখে মালিক দীর্ঘক্ষণ দূরে থাকলে সেগুলো অপরাধীদের চুরির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ব্যক্তির সঙ্গে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়া এবং লেনদেনে জাল নোট চালিয়ে দিতে তৎপর হয় অপরাধীরা। এ জন্য সব সময় রমজানে জাল নোটবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
পুলিশ ও র্যাব সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, রমজানে ‘টানা পার্টির’ দৌরাত্ম্য বাড়ে। বিপণিবিতানে যাওয়া মানুষ ছিনতাই ও ডাকাতির লক্ষ্যবস্তু হন। গাড়ি চুরির সংঘবদ্ধ চক্রগুলোও এ সময় সক্রিয় হতে থাকে। এই ঘটনাগুলো ইফতারির বাজার, বিপণিবিতান, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট ঘিরে বেশি ঘটে। এ জন্য জনসমাগম বেশি এমন এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে.
ঈদুল ফিতর সামনে রেখে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় বলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির (বিএসওএ) এক জরিপে উঠে এসেছে। মূলত রমজান মাস ঘিরে সক্রিয় অপরাধী চক্রের অন্যতম লক্ষ্য থাকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ছিনতাই ও ডাকাতি। অর্থ পরিবহন এবং অর্থ লেনদেনের সময় এসব ঘটনা বেশি ঘটে থাকে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে পুলিশের সহযোগিতা নিতে ইতিমধ্যে আহ্বান জানানো হয়েছে। তা ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক বিশেষ নজরদারি করতে পুলিশের নির্দেশনা রয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) ইনামুল হক সাগর প্রথম আলোকে বলেন, অপরাধ দমনে সারা দেশে বিশেষ অভিযান চলছে। রমজান ঘিরে অপরাধ মোকাবিলায় বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন পুলিশের পাঁচ শতাধিক টহল দল বের হচ্ছে। নগদ অর্থ উত্তোলন ও পরিবহনে রাজধানীতে ‘মানি এসকর্ট’ সেবা দিচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
সব সময় রমজান ঘিরে টানা পার্টি, ছিনতাইকারী চক্র, জাল টাকার কারবারিসহ সুনির্দিষ্ট কিছু অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সারা দেশে র্যাবের ২০০–এর মতো টহল দল কাজ করছে। এদের পাশাপাশি সাদাপোশাকে র্যাব সদস্যরা বিপণিবিতান, ইফতারির বাজার ও জনসমাগম বেশি এমন এলাকাগুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন।র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌসরমজানের প্রথম দিনে যা করল পুলিশরমজান মাস শুরুর প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ৫৭৫টি টহল দল রাজধানীতে নিয়োজিত ছিল বলে জানিয়েছে ডিএমপি। ৬৫টি তল্লাশিচৌকি পরিচালনা করা হয়েছে এ সময়। বিভিন্ন অপরাধে ঢাকায় ১৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ৬ জন ডাকাত, ১৮ জন পেশাদার ছিনতাইকারী, ৪ জন চাঁদাবাজ, ১০ জন চোর বলে জানিয়েছে ডিএমপি।
ডিএমপির উপকমিশনার (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে ডিএমপিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অংশগ্রহণে সমন্বিত তল্লাশিচৌকি ও টহল কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে।
ডিএমপির ক্রাইম কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার সূত্রে জানা যায়, ডিএমপির টহল টিমের পাশাপাশি মহানগরীর বিভিন্ন অপরাধপ্রবণ স্থানে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলো কাজ করছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) ১৪টি, অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) ১২টি এবং র্যাবের ১০টি টহল দল ডিএমপির সঙ্গে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। এ ছাড়া পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট এপিবিএন ২০টি তল্লাশিচৌকি পরিচালনা করেছে। এ ধরনের কার্যক্রম সারা মাস চলবে।
ডিএমপির পুলিশ সদস্য, বিজিবি, আনসার ও কোস্টগার্ডের সদস্যদের জন্য মোটরসাইকেল কেনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে; যাতে তাৎক্ষণিকভাবে অলিগলি টহল দিয়ে অপরাধীদের ধরা সম্ভব হয়। ছিনতাইকারী, ডাকাত, কিশোর গ্যাং ও অপরাধপ্রবণ অন্য স্থানগুলোতে সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।কোর কমিটির একগুচ্ছ সিদ্ধান্তগতকালের কোর কমিটির সভার বিষয়ে এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটপ্রধান, উপপুলিশ কমিশনার, সেনাবাহিনীর মাঠে নিয়োজিত ব্রিগেডপ্রধান ও অন্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা প্রতিটি ঘটনার বিষয়ে গণমাধ্যমকে জানাবেন। মিথ্যা, গুজব ও অপপ্রচারের বিপরীতে সত্য তথ্য প্রচারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেবে সরকার।
থানাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের তালিকা হালনাগাদ করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে কোর কমিটির সভায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডিএমপির পুলিশ সদস্য, বিজিবি, আনসার ও কোস্টগার্ডের সদস্যদের জন্য মোটরসাইকেল কেনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে; যাতে তাৎক্ষণিকভাবে অলিগলি টহল দিয়ে অপরাধীদের ধরা সম্ভব হয়। ছিনতাইকারী, ডাকাত, কিশোর গ্যাং ও অপরাধপ্রবণ অন্য স্থানগুলোতে সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
সভায় আরও জানানো হয়, মামলা যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্তকরণে জেলা ও মহানগর পর্যায়ে মামলা মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে ঝটিকা পরিদর্শনে যাবে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
জুলাই বিপ্লবের শহীদ পরিবারের মামলাগুলো নিয়মিতভাবে গুরুত্বের সঙ্গে তদারকি করা হচ্ছে; যাতে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্তপূর্বক আইনের আওতায় নিয়ে আসা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তল্লাশিচৌকি ও অপরাধপ্রবণ এলাকায় টহল সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী নির্দিষ্ট এলাকাসমূহে জোরদার অপারেশন পরিচালনা করছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে নিয়মিত টহলের পাশাপাশি নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের সদস্যদের অতিরিক্ত টহলে নিয়োজিত করা হয়েছে। ঢাকা শহরের আশপাশে বিশেষ করে টঙ্গী, বছিলা, কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল বাড়ানো হয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অপর ধ ব দ ধ র গ র প ত র কর পর স থ ত র ক র কম ট র রমজ ন ম স অপর ধ দ র পদক ষ প ন ড এমপ র য় অপর ধ অপর ধ র য় রমজ ন ল নদ ন র জন য র সদস ইউন ট সদস য সমন ব প রথম টহল দ ব যবস সরক র গতক ল
এছাড়াও পড়ুন:
অজ্ঞাতনামা লাশ আর কারা হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় জনমনে সন্দেহ: এমএসএফ
চলতি অক্টোবর মাসে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশ এবং কারা হেফাজতে মৃত্যু সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। এ তথ্য তুলে ধরেছে মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। প্রতিষ্ঠানটির অক্টোবর মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এমএসএফ বলেছে, এসব ঘটনায় জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ দুই ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে।
এমএসএফ প্রতি মাসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে। আজ শুক্রবার অক্টোবর মাসের প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এমএসএফ মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করে।
বেড়েছে অজ্ঞাতনামা লাশএমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে মোট ৬৬টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়; বরং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে (সেপ্টেম্বর) এর সংখ্যা ছিল ৫২। এসব অজ্ঞাতনামা লাশের বেশির ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়। অল্পসংখ্যক মৃতদেহ গলাকাটা, বস্তাবন্দী ও রক্তাক্ত বা শরীরে আঘাতের চিহ্নসংবলিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
এমএসএফ বলেছে, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েই চলেছে এবং তা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১টি শিশু, ১ কিশোর, ১১ জন নারী ও ৫৩ জন পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ বছর বয়সী শিশু; ১৫ বছর বয়সী কিশোর; ২০ থেকে ৩০ বয়সী ১৫ জন পুরুষ ও ২ জন নারী; ৩১ থেকে ৪০ বয়সী ১৯ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী; ৪১ থেকে ৫০ বয়সী ১ নারী ও ৫ জন পুরুষ এবং ৫০ বছর বয়সের বেশি ১১ জন পুরুষ ও ১ নারী রয়েছেন। এর মধ্যে অজ্ঞাতনামা তিনজনের বয়স শনাক্ত করা যায়নি।
এমএসএফ বলেছে, শুধু অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং পরিচয় জানার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
কারা হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছেইএমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে কারা হেফাজতে মোট ১৩ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এ সংখ্যা ছিল মোট ৮। এ মাসে ছয়জন কয়েদি ও সাতজন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন কয়েদি ও দুজন হাজতি, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন কয়েদি ও শেরপুর জেলা কারাগারে একজন কয়েদি মারা যান। এ ছাড়া খুলনা জেলা কারাগারে, টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে, চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে, সিরাজগঞ্জ কারাগারে ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে একজন করে হাজতি বন্দী মারা যান। সব বন্দীর মৃত্যু হয় কারাগারের বাইরে হাসপাতালে।
এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কারা হেফাজতে মৃত্যু এবং অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বৃদ্ধি মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লাশ উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। কিন্তু এসব লাশ উদ্ধার করে তার পরিচয় শনাক্ত করা এবং সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করাই শুধু নয়, এসব লাশ আত্মীয়-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসব বাহিনীর কাজ। কিন্তু একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা করা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আর কোনো কাজ নেই।
সাইদুর রহমান বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং হেফাজতে মৃত্যু বৃদ্ধি জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে।
গণপিটুনিতে হত্যা চলছেই, বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতাঅক্টোবর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। এর মধ্যে ২ জন নিহত এবং ৫৪৭ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ এবং নিহত ব্যক্তিরা বিএনপির কর্মী–সমর্থক। সেপ্টেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৮টি ঘটনা ঘটেছিল।
সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার মধ্যে ১১টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিকাণ্ড এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অক্টোবর মাসে মোট গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। আগের মাসে এ ঘটনা ঘটেছিল ৪৩টি। এ মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২। আগের মাসে নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন।