আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবার নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সমতা ক্ষমতায়ন অধিকার: নারী কন্যা সবার।’ স্লোগানটি সমাজে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নারীদের প্রতি ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণ, জেন্ডারকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, সবুজ অর্থনীতি ও যত্নশীল সমাজ গঠন, নারীবাদী সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করা এবং সর্বোপরি সর্বত্র নারীর উপস্থিতিকে দৃঢ় করতে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। উদ্বেগের বিষয় হলো যুদ্ধ, সংঘর্ষ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোকে নারীর সেবা খাতে যেখানে বৈশ্বিক সহায়তা কমে আসছে, সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী ইউএসএআইডির প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে নারীর উন্নয়নে আর্থিক সহায়তা আরও কমে যাবে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখতে পাই, নানাবিধ বাধা পেরিয়ে বাংলাদেশের নারীরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। সন্তান, সম্পদের সুরক্ষা তো বটেই; দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় তঁাদের অবদান সারা বিশ্বে স্বীকৃত। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মানবসম্পদ উন্নয়নেও নারীর অবদান উল্লেখযোগ্য। গড় আয়ুতে নারী অনেক আগেই পুরুষকে ছাড়িয়ে গেছেন।
আমাদের সংবিধান নারী–পুরুষনির্বিশেষে পাঁচ মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সংবিধানে জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সমানাধিকার নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও নারীর প্রতি বৈষম্য ঘোচেনি। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মেয়েরা অপুষ্টির দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছে।
নারীরা দেশের পোশাক খাতে বিপ্লবের সূচনা করেছেন। অথচ গবেষণা বলছে, অঞ্চলভেদে দেশে নারী পোশাকশ্রমিকদের মজুরিতে ৫১ থেকে ৬০ শতাংশ বৈষম্য বিরাজমান। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। হাসপাতালগুলোয় নারীদের আসনসংখ্যা এখনো পুরুষের সমান করা যায়নি। প্রশাসনে নারীদের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে তঁাদের অংশগ্রহণ সীমিত।
এখনো নারীদের জন্য নিরাপদ শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই, ট্রেনে-বাসে নারী ও কন্যাশিশুরা ধর্ষণ ও নিগ্রহের শিকার হয়। বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুল-কলেজ বা কর্মস্থলে যেতে গণপরিবহনে আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। বাল্যবিবাহের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সারা বিশ্বে অষ্টম এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম।
গবেষণা, সমীক্ষা আর সূচকে দেশে নারীর প্রতি বৈষম্যের যে ছবি, তা বেদনাদায়ক। আমরা মনে করি, নারীর সম-অধিকার প্রতিদিনের ইস্যু, জরুরি ইস্যু। শুধু ৮ মার্চ নারীর প্রতি সমানুভূতি না দেখিয়ে, বছরের বাকি ৩৬৪ দিনও জেন্ডার সমতার কথা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।
২০২৪ সালের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিকবার আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতেছেন নারী ফুটবলাররা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, নারী খেলোয়াড়দের প্রতি রাষ্ট্র বরাবর বৈষম্যমূলক আচরণ করে এসেছে, তাঁদের ন্যায্য মজুরি ও সুযোগ–সুবিধা থেকেও বঞ্চিত রাখা হয়। মাঠ থেকে আবাসস্থল—কোথাও নারী খেলোয়াড়দের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা যায়নি।
কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলেছিলেন, ‘বিশ্বে যা–কিছু মহান সৃষ্টি চির–কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ নারী ও পুরুষ উভয়কে নিয়ে আমাদের সমাজ ও বিশ্ব। কাউকে পেছনে রেখে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। ২০২৫ সালে এসে, বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নে যেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আছে, তেমনি সামাজিক বাধাও কম নয়। বিভিন্ন স্থানে নারীদের ফুটবল খেলা ও গান গাওয়ায় বাধা দিচ্ছেন একশ্রেণির মানুষ। পোশাক নিয়েও তাদের হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। রাস্তায়, পরিবহনে চলতে গিয়ে এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চরম বুলিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে নারীদের। এসব পেরিয়ে বাংলাদেশের নারী পরিবার, কর্মক্ষেত্রসহ সমাজজীবনের সব ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে সক্ষম হবে, এবারের নারী দিবসে এটাই প্রত্যাশিত।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
অনশনের পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেলেন ছয় সমন্বয়ক
নিরাপত্তার অজুহাতে গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয়জন সমন্বয়ককে। আটক থাকার এক পর্যায়ে তাঁরা অনশন শুরু করেন। ৩২ ঘণ্টা অনশনের পর ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) দুপুরে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের দুটি গাড়িতে করে যাঁর যাঁর ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।
সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ছয় দিন; সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে পাঁচ দিন এবং নুসরাত তাবাসসুমকে চার দিন ডিবি কার্যালয়ে তখন আটক রাখা হয়েছিল। এই ছয় সমন্বয়কের মধ্যে নাহিদ এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। সারজিস, হাসনাত ও নুসরাত এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আবু বাকের এখন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক।
ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার সেই ঘটনা সম্পর্কে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার বোনের বাসার লোকেশন (ঠিকানা) দিয়েছিলাম ডিবিকে। ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) ডিবি তাদের তত্ত্বাবধানেই আমাদের ছয়জনকে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। বোনের বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর আমি প্রথমে আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানিকনগরের একটা জায়গায় দেখা করি। আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। কীভাবে এক দফার (সরকার পতনের) ঘোষণায় যাওয়া যায়, সে বিষয়েও সেদিন আমরা চিন্তা করি।’
সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচির আওতায় গণসংগীত, পথনাটক, দেয়াললিখন, স্মৃতিচারণা ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয় রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১৬টি জেলা ও মহানগরে। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু জায়গায় শিক্ষক ও আইনজীবীরা অংশ নেন। তবে কোথাও কোথাও কর্মসূচিতে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়।
প্রতিবাদ, বিক্ষোভসেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উদ্যোগে পৃথক সমাবেশ-মানববন্ধন ও মিছিল করা হয়। পাশাপাশি সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করে ছাত্র-জনতা।
‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যা’র প্রতিবাদে ১ আগস্ট বেলা ১১টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল শিল্পী ও কলাকুশলীদের। ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে তাঁরা প্রথমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ–সংলগ্ন ইন্দিরা রোডের প্রান্তে সমবেত হন। সেদিন সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিল্পীরা ব্যানার-পোস্টার নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।
পরে শিল্পীরা ইন্দিরা রোড দিয়ে শোভাযাত্রা করে ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের কাছে সমবেত হন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা সেখানে সড়কের পাশে ব্যানার-পোস্টার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, যে বর্বর পন্থায় শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে দমন করা হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না।
দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীদের সমাবেশ থেকে সেদিন শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের বিচার, গণগ্রেপ্তার, মামলা ও হয়রানি বন্ধের দাবি করা হয়। সমাবেশ থেকে আরও জানানো হয়, শিল্পীরা তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।
সেদিন বিকেলে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ের সামনে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। মানববন্ধনে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, গুলি করে শিশুসহ নির্বিচার মানুষ হত্যার তদন্ত জাতিসংঘের অধীনে করতে হবে।
সেই মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) বলেন, হত্যার বিচার করতে হবে। হুকুমদাতাদেরও বিচার করতে হবে।
কূটনীতিকদের ‘ব্রিফ’জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে ১ আগস্ট বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সেই ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানান।