সিলেটের গোয়াইনঘাটের লেঙ্গুড়া এলাকা থেকে বছর তিনেক আগে সাভারে এসে পোশাক কারখানায় কাজ নেন আফজাল হোসেন (৪০)। তাঁর সঙ্গে এলাকার আরও জনা তিনেক পুরুষও এসেছিলেন তখন। একই ভাড়া বাসায় উঠেছিলেন। এলাকায় কাজের অভাব, মজুরি কম; এক দিন কাজ থাকলে সাত দিন নেই। এভাবে অনিশ্চয়তায় দিন পার করা আফজাল যখন ঢাকায় এসে কাজ পান, তখন বেতন ছিল সাড়ে সাত হাজার টাকা। কিন্তু বাসা ভাড়া, খাওয়ার খরচ আর গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর পর মাসের শেষ দিকে হাতে আর কোনো টাকাই থাকত না। ধারকর্জ করে মাস শেষ করতে হতো। এভাবে দিনের পর দিন পার করছিলেন। সম্প্রতি শেষ সম্বল চাকরিটাও খুইয়েছেন।

গত সোমবার ঢাকার সাভার বাজার মোড়ে কথা হয় আফজালের সঙ্গে। তিনি তখন কাজ খুঁজছিলেন। বললেন, ‘হাড়ভাঙা খাটুনি, দেরি করলে বেতন কাটা, কথায় কথায় গালি আর মাসের শেষে পকেটেও কিছু নেই। এই কাজের কোনো মানে হয় না। শখ কইরা ১০০ টাকাও নিজে খাইবার পারি না। আবার এলাকায় যে ফিরব, গিয়া করমু কী? বাড়িতে এক ছেলে, এক মেয়ে, বউ, অসুস্থ বাবা-মা, তাগো কথা ভাইবা আর ফেরা হয় না। আমার নিজের ইচ্ছার কোনো দাম নাই। আমি মানুষের হুকুমের গোলাম।’

জলবায়ু ঝুঁকির সঙ্গে অভিবাসন এবং আধুনিক দাসত্বের যোগসূত্র বুঝতে সিলেট ও পিরোজপুরে জরিপ চালানো হয়। এই দুই এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ স্পষ্ট।রিতু ভরদ্বাজ, প্রধান গবেষক, জলবায়ু পরিবর্তন, আইআইইডি

সাভারের যে তৈরি পোশাক কারখানায় আফজাল কাজ করতেন, দিন কয়েক আগে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। বেতনের জন্য তিনি আর অন্য শ্রমিকেরা ৩ মার্চ ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছিলেন। কোনো কাজ হয়নি। দুই সপ্তাহ ধরে বেকার বসে আছেন। তাই নতুন কোনো কাজের খোঁজে বেরিয়েছিলেন।

আফজালের এমন দশা বাংলাদেশের আধুনিক ‘দাসত্বের’ একটি চিত্র। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (আইআইইডি) প্রকাশিত এক গবেষণায় বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রগুলোতে দাসত্বের বিষয়টি উঠে এসেছে। ‘এক্সপোজড অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেড: ক্লাইমেট চেঞ্জ, মাইগ্রেশন অ্যান্ড মডার্ন স্ল্যাভারি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণাটিতে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সহায়-সম্বল হারিয়ে মালিকপক্ষের দাস হয়ে উঠছে বাংলাদেশের জলবায়ু অভিবাসীরা।

গবেষণার সূত্র ধরে খোঁজ নিতে গিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে অভিবাসী হয়েছেন, এমন পরিবারের অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। পিরোজপুরের বলেশ্বর নদের জেলে বেল্লাল খন্দকার (৩৫) তেমনই একজন। জেলার মঠবাড়িয়ার বড় মাছুয়ার খেজুরবাড়ি এলাকার বাসিন্দা বেল্লাল মাছের আড়তের মহাজনের কাছ থেকে অগ্রিম দাদনসহ বিভিন্ন এনজিও থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ঋণ করেছিলেন। পরিশোধ করতে না পেরে এলাকা ছেড়েছেন। তাঁর আত্মীয়স্বজন জানান, বেল্লাল এখন চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন।

বেল্লাল খন্দকারের মা রেনু বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বলেশ্বর নদে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। প্রতিদিন ১০-১৫টি ছোট সাইজের ইলিশ পাওয়া যায়। সেই মাছ বিক্রি করে আমার ছেলে মহাজনের দেনা পরিশোধ করতে পারে নাই। উল্টা তার দেনা আরও বাড়ছে। পরে চট্টগ্রামে চলে যেতে হইছে তাকে।’

২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকেই তাঁদের জীবন-জীবিকার পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে বলে জানান রেনু। তিনি বলেন, ‘ছেলেটা যে কেমন আছে নাতিপুতি লইয়া, ওর কথা মনে হইলেই মনডা কেমন করে।’

দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, নারী ও উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে কাজ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিরা অভিবাসী হন অদক্ষতা নিয়ে। যে কাজ তাঁরা শুরু করেন, সেটা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে কাজ করতে সাহস পান না। ফলে তাঁদের পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হয়। তৈরি পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়।

অধ্যাপক শরমিন্দ আরও বলেন, ইটভাটা বা নির্মাণশ্রমিকেরা আসলে নানা ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তাঁরা আগে থেকেই দাদন নিয়ে রাখেন, ফলে মালিকপক্ষ যে পারিশ্রমিক দেয়, তা নিয়েই তাঁদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। দেশের বাইরে যাওয়া নির্মাণশ্রমিকদের ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়ে অসহনীয় পরিস্থিতি মেনে নেওয়া ছাড়া আসলে উপায় নেই।

কী এই আধুনিক দাসত্ব

‘সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ছোটগল্প ‘হৈমন্তী’তে শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও মানবিক মূল্যবোধ উপস্থাপন করতে ‘সম্পদ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। আর যা ব্যবহার করা যায়, প্রয়োজন হলে হস্তান্তর করা যায়—এমন ব্যক্তি বা বস্তুকে ‘সম্পত্তি’ বুঝিয়েছিলেন। কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিকে যখন সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়, ব্যক্তিগত অধিকার কেড়ে নিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে কাজে নিযুক্ত করা হয়—এমন পরিস্থিতিকে আধুনিক দাসত্ব বলছে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন।

গোয়াইনঘাটের ডৌবাড়ী গ্রামের জেলে ফখরুল ও আবদুল আমিন। আগে হাওরে গেলে ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকার মাছ পেতেন, এখন পান ৩০০-৪০০ টাকার মাছ। আয় কমে যাওয়ায় তাঁদের অনেকেই এলাকা ছেড়েছেন। পেশাও বদলে ফেলছেন। তাঁরাও এলাকা ছাড়ার কথা ভাবছেন.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর স থ ত ক জ কর এল ক য় জলব য় আফজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

প্রেম ছিল না তবু কেন মধুবালাকে বিয়ে করেছিলেন কিশোর কুমার

দিলীপ কুমারের সঙ্গে বিচ্ছেদের কিছুদিন পরই কিশোর কুমারকে বিয়ে করেন অভিনেত্রী মধুবালা। তবে তখন তিনি ছিলেন অসুস্থ। কিশোর কুমার জানিয়েছিলেন, ভালোবাসা থেকে নয়, বরং কথা রাখতেই তিনি এ বিয়ে করেছিলেন।
মধুবালা ও দিলীপ কুমারের প্রেম নিয়ে একসময় মুখর ছিল মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু অভিনেত্রীর বাবার বাধার কারণে সে সম্পর্কে ফাটল ধরে এবং দুজনের বিচ্ছেদ ঘটে। কিছুদিন পরেই কিশোর কুমারকে বিয়ে করেন মধুবালা। তাঁদের এই বিয়ে অনেককে চমকে দিয়েছিল। কারণ, তাঁদের প্রেমের কথা তখনো গোপন ছিল। তবে মধুবালার শরীর তখন ভালো যাচ্ছিল না। বলা হয়, দীর্ঘ রোগভোগের সময় কিশোর কুমার তাঁকে মায়ের বাড়িতে রেখেই চলে যান।

দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কিশোর কুমার বলেছিলেন, ‘বিয়ের আগেই জানতাম, ও খুব অসুস্থ। কিন্তু কথা তো দিয়েছিলাম। তাই সে কথা রেখেই ওকে ঘরে এনেছিলাম স্ত্রী হিসেবে। জানতাম, ওর জন্মগত হৃদ্‌রোগ আছে। তবু ৯ বছর ধরে সেবা করেছি। চোখের সামনেই ওকে মরতে দেখেছি। কেউ বুঝবে না এর যন্ত্রণা, না ভুগলে। ও অসম্ভব সুন্দরী ছিল। আর কত যন্ত্রণায় মারা গেছে, সেটা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। হতাশায় চিৎকার করত, কান্নাকাটি করত। এত প্রাণোচ্ছল মানুষ নয়টা বছর বিছানায় শুয়ে থাকবে—এ কল্পনাই করা যায় না। ডাক্তার বলেছিল, ওকে হাসিখুশি রাখতে হবে। আমি তা–ই করেছি—ওর শেষনিশ্বাস পর্যন্ত। কখনো হেসেছি, কখনো কেঁদেছি ওর সঙ্গে।’

তবে কিশোর কুমারের এই বক্তব্য নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। কারণ, পরে ফিল্মফেয়ার সাময়িকীতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একেবারে ভিন্ন কথা বলেন তিনি। সেই সাক্ষাৎকারে কিশোর কুমার বলেন, ‘মধুবালার সঙ্গে আমি প্রেমে পড়িনি কখনো। বরং ওর প্রেমিক ছিল আমার বন্ধু দিলীপ কুমার। আমি তো শুধু ওদের বার্তা পৌঁছে দিতাম। বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়েছিল মধুবালাই। এমনকি, যখন আমার প্রথম স্ত্রী রুমা তখনো আমার সঙ্গে ছিল, তখনো মধু বলত, “ওকে কখনো ছেড়ো না, না হলে আমি তোমার হয়ে যাব।”’

আরও পড়ুনকিশোর কুমার কি সত্যিই ঘরে কঙ্কাল আর মাথার খুলি নিয়ে ঘুমাতেন২৭ মে ২০২৫

মধুবালার পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, চিকিৎসকেরা তখন বলেছিলেন, অভিনেত্রীর পক্ষে শারীরিক সম্পর্ক কিংবা সন্তানধারণ কোনো কিছুই সম্ভব নয়। সেই বাস্তবতা হয়তো প্রভাব ফেলেছিল কিশোরের সিদ্ধান্তে। এক ঘনিষ্ঠজন বলেন, ‘আমরা বলছি না কিশোরদা ভুল করেছিলেন। ডাক্তার তো স্পষ্ট বলেছিল—শারীরিক সম্পর্ক বা সন্তান কোনোটাই সম্ভব নয়। তবে একজন নারীর তো মানসিক সঙ্গীও দরকার হয়।’
ওই ঘনিষ্ঠজন আরও জানান, কিশোর কুমার তিন মাসে একবার আসতেন মাত্র। বলতেন, ‘আমি এলে তুমি কাঁদবে, আর এতে তোমার হৃদ্‌যন্ত্রের ক্ষতি হবে। তুমি বিষণ্ন হয়ে পড়বে।’ সে সময় মধু অনেক ছোট ছিলেন, ঈর্ষাও ছিল স্বাভাবিক। হয়তো এ দূরত্বই ধীরে ধীরে তাঁকে শেষ করে দিয়েছিল।
১৯৬৯ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বলিউড অভিনেত্রী মধুবালা

সম্পর্কিত নিবন্ধ