ব্যক্তিগত নজরদারি থেকে রাষ্ট্রকে সরে আসতে হবে: ইফতেখারুজ্জামান
Published: 20th, March 2025 GMT
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবির) পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ব্যক্তিগত নজরদারি মাধ্যমে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হরণ হয়। এ থেকে রাষ্ট্রকে সরে আসতে হবে। ব্যক্তির পরিবর্তন হলেও প্রতিষ্ঠানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যে সংস্থাগুলো নজরদারিতে রয়েছে, সেগুলোর সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে রোডম্যাপ প্রণয়নের দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
গত ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশে অভ্যুত্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতিবেদন জেনেভা থেকে প্রকাশ করে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান দল। ৫ মার্চ জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে সে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার টুর্ক ও অন্যরা। প্রতিবেদনে এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বিলুপ্তির সুপারিশের পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) কেবল সীমান্তরক্ষা এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরকে কেবল সামরিক গোয়েন্দা তৎপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সুপারিশ রয়েছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুটি প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করার কথা বলা হয়েছে—একটি র্যাব, আরেকটি ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এমটিএমসি)। এমটিএমসিএর মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি নজরদারি সমাজে পরিণত করা হয়েছিল। এটিকে বিলুপ্ত করতে হবে। নজরদারির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকার লুণ্ঠিত হয় এমন নজরদারি থেকে ফিরে আসতে হবে। ডিজিএফআইয়ের ওপর মানুষের অধিকার–সংক্রান্ত গোয়েন্দাগিরির দায়িত্ব বর্তায় না। শুধু সামরিক গোয়েন্দা কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। আনসার ভিডিপির সামরিক কর্তৃত্ব বন্ধ করতে হবে।
পুলিশ ও নিরাপত্তার খাত সম্পর্কে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরে টিআইবির পরিচালক বলেন, একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন তৈরি করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুলিশ সংস্কার কমিশন এটার বিষয়ে জোরালোভাবে অবস্থান নেয়নি, কেন নেয়নি তা বোধগম্য নয়। টিআইবি মনে করে, অবশ্যই স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে।
জাতিসংঘের প্রকাশিত প্রতিবেদনে ৫টি খাতে ৪৩টি সুপারিশের প্রসঙ্গ টেনে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার কর্মী, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে যেসব দাবি জানিয়ে আসছে, সেগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি বিবেচনায় নিত, তাহলে এ প্রতিবেদনের দরকার হতো না, অন্যদিকে বাংলাদেশে যেভাবে কর্তৃত্ববাদ বিকাশ হয়েছিল, সেটিও হতো না।
সংস্কার কমিশনের ছয়টি প্রতিবেদন হয়েছে, আরও পাঁচটি হবে জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমার জানামতে পাঁচটিসহ ছয়টি প্রতিবেদনের সুপারিশের সঙ্গে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের মিল আছে। যে কথাগুলো জাতিসংঘ বলেছে, সেগুলো খুব একটা রকেট সায়েন্স তা না, তবে আমাদের দীর্ঘদিনের যে উদ্বেগ ছিল, সেটিকে একটি আন্তর্জাতিক দলিলের মধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে। সে কারণেই এটি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি প্রতিরোধের কথা চিন্তা করি, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করি, তাহলে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার বিচার অবশ্যই করতে হবে। এর পাশাপাশি প্রতিকার ও প্রতিরোধ করতে হবে।’
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে করণীয় নির্ধারণ করতে সরকারের কাছ থেকে সময় উল্লেখ করে একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চান টিআইবির পরিচালক। তিনি বলেন, এ সরকার নির্বাচন পর্যন্ত আছে। তারা এমন একটি রোডম্যাপ তৈরি করে দেবেন, যাতে পরের নির্বাচিত সরকার সে রোডম্যাপ অনুযায়ী দাবিগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে।
প্রতিবেদনে আদিবাসী এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিষয়গুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, পরিচয়ভিত্তিক যে মানুষের অবস্থান, সেটিকে ভিত্তি করে মানুষকে হয়রানি করা, নির্যাতন করা, বৈষম্য করা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ব্লাস্টের পরিচালক মো.
নারী পক্ষের প্রতিনিধি রওশন আরা বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে কিন্তু বলা হয়েছে, এটা আরও বেশি তদন্ত করতে হবে; কিন্তু সেটি কে করবে? এটা নিয়ে এখনও খুব পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে আহতরা যাতে সুস্থ জীবন ফিরে পায়, সে জন্য পর্যাপ্ত অনুদান আসছে, সে ধরনের একটা পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু সেটা আসলে কতটুকু হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের সুপারিশমালার লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সমন্বয়ক তামান্না হক রীতি। সেখানে নাগরিক উদ্যেগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)–এর পরিচালক শামসুল হুদা, স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন কর্মকার, নারীপক্ষের সদস্য রওশন আরা উপস্থিত ছিলেন।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় ব্যাংক খুলেছে, নেই নগদ অর্থ
ইসরায়েলের আগ্রাসনের শিকার ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির ফলে কিছু কিছু ব্যাংক খুলেছে। তবে নগদ অর্থের ঘাটতির কারণে বড় সমস্যায় পড়েছেন গাজাবাসী। নগদ অর্থসংকটের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
দুই বছর ধরে গাজায় নির্বিচার হামলায় ঘরবাড়ি, স্কুল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো অনেক ব্যাংক ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ছয় দিন পর ১৬ অক্টোবর থেকে কিছু ব্যাংক খোলা শুরু করে। এসব ব্যাংক থেকে অর্থ তুলতে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভিড় করেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর তাঁদের বেশির ভাগকে হতাশা নিয়েই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পরও গাজায় ইসরায়েলের সেনাদের হামলায় দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গাজায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৫২৭। যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় ত্রাণসহ যেকোনো কিছু ঢুকছে ইসরায়েলের নজরদারিতেই।
নগদ অর্থের জন্য মধ্য গাজার নুসেইরাতে ব্যাংক অব প্যালেস্টাইনের বাইরে সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওয়ায়েল আবু ফারেস (৬১)। তিনি বলেন, ব্যাংকে কোনো অর্থ নেই। নগদ অর্থের সঞ্চালন নেই। হতাশার সুরে ছয় সন্তানের এই বাবা বলেন, ব্যাংকে এসে কাগজপত্রের লেনদেন করে চলে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
গাজায় খাবার কেনা বা বিভিন্ন পরিষেবার বিল দেওয়ার মতো প্রায় সব দৈনন্দিন লেনদেন নগদ অর্থে করতে হয়। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামলা শুরু হওয়ার পর গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছেন ইসরায়েলি সেনারা। ফলে সেখানে নিত্যপণ্য ও অন্যান্য সরঞ্জামের মতো নগদ অর্থও ঢুকতে পারছে না। যদিও যুদ্ধবিরতির পর এখন কিছু কিছু ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকছে।
গাজাভিত্তিক অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ আবু জাইয়্যাব বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ব্যাংক খোলা আছে, শীতাতপ যন্ত্রও চালু আছে। কিন্তু ইলেকট্রনিক লেনদেন ছাড়া মূলত আর কিছুই হচ্ছে না। কারণ, কোনো আমানত নেই। তাই নগদ অর্থ তোলা সম্ভব হচ্ছে না।
আবু জাইয়্যাব বলেন, ব্যাংক যেহেতু নগদ অর্থ দিতে পারছে না, তাই বেতন ক্যাশ করতে মানুষজন কিছু লোভী ব্যবসায়ীর কাছে যাচ্ছেন। তাঁদের ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি অর্থের বিনিময়ে বেতন ক্যাশ করতে হচ্ছে।
‘আমরা আর পারছি না’
গাজায় একসময় ব্যাংক লেনদেন এক ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যেত জানিয়ে সাত সন্তানের মা ইমান আল-জাবারি বলেন, ‘এখন ব্যাংকে লেনদেন করতে আপনাকে দুই বা তিন দিন যেতে হয়। একাধিকবার যাতায়াত করতে হয়। পুরোটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এত কিছু করে আপনি ৪০০-৫০০ শেকেলের (১২৩-১৫৩ ডলার) মতো তুলতে পারবেন। বর্তমানে অতি উচ্চমূল্যের বাজারে এই অর্থ দিয়ে কী কেনা যায় বলেন? আমরা আর পারছি না।’
নগদ অর্থের ঘাটতি অধিকাংশ গাজাবাসীর জন্য সমস্যা সৃষ্টি করলেও কিছু মানুষ এই সংকটকে জীবিকার উপায় হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন। মানাল আল-সাইদির মতো কেউ কেউ ছেঁড়া-ফাটা ব্যাংক নোট জোড়াতালি দেওয়ার কাজ করছেন। এতে তাঁদের রুটি-রুজি জুটছে। ৪০ বছর বয়সী এই নারী বলেন, ‘কাজ করে আমি দৈনিক ২০-৩০ শেকেল (৬-৯ ডলার) আয় করতে পারি। যা আয় হয়, তা দিয়ে আমি একটি রুটি, অল্প শিম ও ভাজাপোড়াসহ টুকটাক কিছু কিনতে পারি।’
ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজায় সবজির দাম আকাশছোঁয়া। মানাল আল-সাইদি বলেন, ‘সবজি বা এ জাতীয় অন্য কিছু কেনার মতো অর্থ আমি আয় করতে পানি না। আমার যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোমতে দিন চলে যায়।’
নগদ অর্থসংকটে জর্জরিত গাজার অনেক মানুষকে ডিম বা চিনির মতো প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্যও ব্যাংক অ্যাপের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক লেনদেনে ভরসা করতে হচ্ছে। এই সংকটে বিক্রেতারা অতিরিক্ত দাম আদায় করছেন।
নগদ অর্থ কখন ব্যাংকে আসবে ঠিক নেই
গাজায় বর্তমানে ত্রাণ সরবরাহ নজরদারি করছে ইসরায়েলে সেনাবাহিনীর ‘কো-অর্ডিনেটর অব গভর্নমেন্ট অ্যাকটিভিটিজ ইন দ্য টেরিটরিজ (সিওজিএটি)’ নামের একটি শাখা। কখন বা কীভাবে নগদ অর্থ গাজায় প্রবেশের অনুমোদন দেওয়া হবে, তা জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
নগদ অর্থের ঘাটতি গাজাবাসীর সংকটকে নানা দিক থেকে আরও নাজুক করে তুলেছে। তাঁবু, খাবার ও ওষুধ কিনতে অনেকে এরই মধ্যে সব সঞ্চয় শেষ করে ফেলেছেন ও হাতের কাছে যে সম্বল ছিল, তা-ও বিক্রি করে দিয়েছেন। কিছু মানুষ টিকে থাকার জন্য বিনিময় পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করছেন।
ফিলিস্তিনি ব্যবসায়ী সামির নামরাউতি (৫৩) জানান, এমন কিছু টাকা হাতে আসছে, যা অতিব্যবহারের ফলে চেনার উপায় নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এসব টাকা নিচ্ছেন। নামরাউতির ভাষায়, ‘আমার কাছে নোটের সিরিয়াল নম্বর গুরুত্বপূর্ণ। যতক্ষণ সিরিয়াল নম্বর আছে, ততক্ষণ আমি নোটকে টাকা হিসেবে বিবেচনা করি।’