জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিএনপির মুখপাত্র সালাহ উদ্দিন আহমদ সংস্কার বাস্তবায়নের পথ হিসেবে গণপরিষদের নির্বাচন ও গণভোটের অনুপযুক্ততার আলাপ তুললেন। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, গণপরিষদ ব্যবহৃত হয় কেবল নতুন সংবিধান তৈরির সময়। তাই বাংলাদেশের জন্য সেটা অনুপযুক্ত। আর বর্তমান সংবিধানে যেহেতু নির্দিষ্ট করা আছে গণভোট কোন কোন ধারার ক্ষেত্রে হতে পারবে, তাই সংবিধানের অন্যান্য ধারা পরিবর্তনের এখতিয়ার গণভোটের নেই।

সংবিধান তৈরির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, সংবিধানের বড় কোনো পরিবর্তনের জন্য গণপরিষদের নির্বাচন একটি প্রচলিত পদ্ধতি। সাধারণত একটি দেশ যখন কোনো একনায়কমুক্ত হয় অথবা গৃহযুদ্ধের অবসান হয়, তখন সেই নয়া রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে জনবান্ধব ও বিধিবদ্ধ করার জন্য গণপরিষদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

সংবিধান সংস্কারে গণপরিষদ ব্যবহারের অনেক উদাহরণ আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির ছাপ মুছে ফেলতে ১৯৪৬ সালে ইতালির গণপরিষদ নির্বাচিত হয়েছিল, যা ১৮৪৮ সালের স্ট্যাচুটো আলবার্টিনো প্রতিস্থাপন করে বড় ধরনের সংস্কার এনেছিল। তুরস্কে (১৯২১, ১৯২৪, ১৯৬১, ১৯৮২) একাধিক গণপরিষদ গঠিত হয়। ১৯২১ ও ১৯২৪ সালের সংবিধান মূলত উসমানীয় আমলের কাঠামোর সংশোধন ছিল। পরে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ১৯৬১ ও ১৯৮২ সালের গণপরিষদ বড় ধরনের সংবিধান সংশোধন আনে, যা নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়।

দক্ষিণ আমেরিকায় চিলিতে ২০২১ সালে একটি গণপরিষদ নির্বাচিত হয়েছিল, যা ১৯৮০ সালের পিনোশে আমলের সংবিধান প্রতিস্থাপন করে। কলম্বিয়া রাজনৈতিক সহিংসতা ও বিচারহীনতা থেকে মুক্তির জন্য ১৯৯১ সালে জাতীয় গণপরিষদের মাধ্যমে ১৮৮৬ সালের সংবিধান প্রতিস্থাপন করে। বলিভিয়া ১৮২৫ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৭ বার সংবিধান প্রতিস্থাপন করেছে। গত ১০০ বছরে সেটা হয়েছে ৪ বার, যার মধ্যে ৪ বার হয়েছে গণপরিষদের মাধ্যমে।

আমাদের কাছের দেশ ফিলিপাইনে ১৯৭১ সালে সৃষ্ট সংবিধান কমিশন ১৯৩৫ সালের সংবিধান পরিবর্তন করে ১৯৭৩ সালের সংবিধান গঠন করে ফার্দিনান্দ মার্কোসের শাসনকালকে বৈধতা দেয়। পরে ১৯৮৬ সালের গণ–আন্দোলনের পর তৈরি সংবিধান কমিশন ১৯৮৭ সালে সেই সংবিধান প্রতিস্থাপন করে।

এত উদাহরণ থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায়, সময়–সময় একটা দেশে যখন একটা নতুন রাজনৈতিক অধ্যায় শুরু হয়, তখন নাগরিকদের অধিকার সুসংহত করার জন্য সংবিধানের আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সেই আমূল পরিবর্তন যাচাই–বাছাই করে বৈধতা দেওয়ার জন্য গণপরিষদ তৈরি করা হয়। গণপরিষদের কাজ তিনটি—এক.

সংবিধানের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রতিনিধিদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার ব্যবস্থা করা, দুই. সেই আলোচনা থেকে একটা খসড়া প্রস্তাব তৈরি করা এবং তিন. সেই প্রস্তাবের পক্ষে সদস্যদের সম্মতি আদায় করে নতুন বা সংশোধিত সংবিধান অধিষ্ঠিত করা।

সংবিধান অধিষ্ঠিত করার আরেকটা উপায় হচ্ছে খসড়া সংস্কার প্রস্তাবকে গণভোটে এনে বিধিবদ্ধ করা। এ সংস্কার প্রস্তাবের খসড়া গণপরিষদ যেমন করতে পারে, তেমনি দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ দিয়েও করা যায়।

যেমন কেনিয়ার ২০১০ সালের সংবিধান কেনিয়ার কমিটি অব এক্সপার্টস তৈরি করে। বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে প্রক্রিয়াটি জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছিল এবং সফল গণভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় আইনবিশেষজ্ঞ ও সংবিধানবিশেষজ্ঞদের নিয়ে গড়া সংবিধানবিষয়ক কারিগরি কমিটি নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান খসড়া তৈরি করেছিল। যুক্তরাজ্যে ২০১৪ সালের স্কটিশ স্বাধীনতা সংবিধান প্রস্তাব তৈরি হয় বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে, যা পরবর্তী সময়ে গণভোটে প্রত্যাখ্যাত হয়।

বর্তমান বাস্তবতায় ঐকমত্য কমিশন সব রাজনৈতিক পক্ষকে ন্যূনতম ঐক্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একবার সেই ঐক্যে পৌঁছাতে পারলে কমিশন নিজেই সেই ঐকমত্য থেকে সংবিধান সংস্কারের পূর্ণ খসড়া জাতির সামনে নিয়ে আসতে পারবে। ফলে গণপরিষদের প্রথম দুটি কাজ আলোচনার মাধ্যমে যাচাই–বাছাই করা এবং খসড়া প্রস্তাব তৈরি করা। দুটিই ঐকমত্য কমিশন আমাদের জন্য করে দিচ্ছে।

কানাডায় ১৯৯২ সালে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক নেতাদের উদ্যোগে তৈরি একটি সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব পরবর্তী সময়ে গণভোটে প্রত্যাখ্যাত হয়। ফ্রান্সে ১৯৫৮ সালের ফরাসি সংবিধান আইনবিশেষজ্ঞ মিশেল ডেব্রে, চার্লস দে গলের নির্দেশনায় খসড়া করেন। এটি পঞ্চম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে এবং নির্বাহী ক্ষমতা শক্তিশালী করে।

তিউনিসিয়ায় আইনবিশেষজ্ঞ ও ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্টেট আরব বসন্তের পর ২০১৪ সালের সংবিধান খসড়া তৈরি করেন। এ প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্টেট নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করে। আমাদের উপমহাদেশে শ্রীলঙ্কাতেও আইনবিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা তাদের ১৯৭৮ সালের সংবিধান রচিত হয়, যা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জে আর জয়াবর্ধনের সরকার অনুমোদন করে। এটি ১৯৭২ সালের সংবিধান পরিবর্তন করে, নির্বাহী প্রেসিডেন্সি ও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু করে।

এই উদাহরণগুলো থেকে দেখা যায়, দেশের মানুষের স্বার্থে অনেক দেশে বিশেষজ্ঞ-নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব ব্যবহার হয়ে এসেছে। আমাদের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংস্কার প্রস্তাব তৈরির কাজে সেই বিশেষজ্ঞ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

এখন প্রশ্ন হলো এ সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংসদ, গণপরিষদ নাকি গণভোট—কোন উপায় আমাদের জন্য সবচেয়ে প্রযোজ্য।

আইন তৈরি করাটাই সংসদের কাজ। সময়–সময় সদস্যদের দুই–তৃতীয়াংশের সম্মতিতে সংবিধানের সংশোধনী আনার ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু সংবিধানের আমূল পরিবর্তন যখন সময়ের দাবি হয়ে ওঠে, তখন আগের সংবিধানের বলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতার সেই বৃহৎ সংস্কার বাস্তবায়ন করার অযোগ্য হয়ে পরেন। তখন প্রয়োজন পড়ে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব তৈরি করার জন্য গণপরিষদের বা কোনো বিশেষজ্ঞ দলের। সেই প্রস্তাব অনুমোদন আবার করতে পারে গণপরিষদ নিজে বা গণভোটের মাধ্যমে।

মনে রাখতে হবে, সংসদ ও গণপরিষদ হচ্ছে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র আর গণভোট হচ্ছে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র। নাগরিকেরাই যেহেতু দেশের মালিক, সেহেতু তাঁদের প্রত্যক্ষ সম্মতি হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ম্যান্ডেট। সংগত কারণেই প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের তুলনায় গণভোটের ম্যান্ডেট অনেক পোক্ত।

বর্তমান বাস্তবতায় ঐকমত্য কমিশন সব রাজনৈতিক পক্ষকে ন্যূনতম ঐক্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একবার সেই ঐক্যে পৌঁছাতে পারলে কমিশন নিজেই সেই ঐকমত্য থেকে সংবিধান সংস্কারের পূর্ণ খসড়া জাতির সামনে নিয়ে আসতে পারবে। ফলে গণপরিষদের প্রথম দুটি কাজ আলোচনার মাধ্যমে যাচাই–বাছাই করা এবং খসড়া প্রস্তাব তৈরি করা। দুটিই ঐকমত্য কমিশন আমাদের জন্য করে দিচ্ছে।

তৃতীয় ধাপ বা অনুমোদনের জন্য আমরা গণপরিষদের নির্বাচন করতে পারি, কিন্তু নির্বাচনই যখন করছি, তখন প্রতিনিধির কাছে না গিয়ে সরাসরি জনগণের কাছে যাওয়াটাই উত্তম। তার মানে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব সরাসরি গণভোটে তোলা যাবে।

সব জনপ্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলের সম্মতি নিয়েই যেহেতু সংস্কার প্রস্তাব রচিত হবে, নাগরিকদের সম্মতি পাওয়ার সম্ভাবনা এই গণভোটে খুব বেশি বলেই আমরা ভেবে নিতে পারি।

গণভোটে পাস করা সংশোধিত সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে দ্রুত একটা সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার তুলে দিতে পারলে দেশের মানুষ এক জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের স্বাদ পাবে।

সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের একজন রাজনৈতিক কর্মী

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স স ক র প রস ত ব প রস ত ব ত র ই ঐকমত য র জন য স র জন ত ক আম দ র জ ব স তবত গণভ ট র ন র জন

এছাড়াও পড়ুন:

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি পর্যালোচনা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা। বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান আলোচনার অগ্রগতি পর্যালোচনা করেন তাঁরা।

আজ সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ও প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বৈঠকে সংস্কারপ্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যেসব আলোচনা হয়েছে, সে বিষয়ে কমিশন প্রধানকে অবহিত করেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, বিচারপতি এমদাদুল হক ও সফর রাজ হোসেনও এতে অংশ নেন। সে আলোকে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা।

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিল্প ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে মানবিক করিডরের সিদ্ধান্ত নিতে হতো: নাহিদ ইসলাম
  • অনির্বাচিত সরকারের করিডোর দেওয়ার এখতিয়ার নেই: বিএনপি
  • অনির্বাচিত সরকারের করিডোর দেওয়ার এখতিয়ার নেই
  • ‘মানবিক করিডর’ প্রতিষ্ঠার আগে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে হবে: চরমোনাই পীর
  • এই প্রথম সকলে মিলে রাষ্ট্র বিনির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়েছে: আলী রীয়াজ
  • প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক
  • মানবিক করিডরের সিদ্ধান্ত হলেও শর্ত নিয়ে চলছে আলোচনা
  • ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক
  • প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি পর্যালোচনা
  • স্পেন ও পর্তুগালে ভয়াবহ বিদ্যুৎবিভ্রাট, সব ধরনের গণপরিবহনে বিপর্যয়