পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে পাওনা বুঝে না পাওয়ায় রাজধানীর শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন গাজীপুরের টিএনজেড গ্রুপের পোশাকশ্রমিকেরা।

শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধে গতকাল শুক্রবার গ্রুপের পরিচালক শরীফুল ইসলামকে থানা-পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। তিনি পরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের কাছে কারখানার যন্ত্রপাতি, আসবাব ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি করে আজ শনিবার পাওনা পরিশোধ করার লিখিত প্রতিশ্রুতি দেন।

এদিকে ঈদের বাকি আর এক–দুই দিন। বেতন-ভাতা পরিশোধে সরকার নির্ধারিত সময়সীমা ইতিমধ্যে পার হয়েছে। তবে এখনো অনেক কারখানা উৎসব ভাতা বা বোনাস ও মার্চের অর্ধেক বেতন দেয়নি। যদিও বেতন-ভাতা পরিশোধের সুবিধার্থে শিল্পাঞ্চলে ব্যাংকের শাখা বিশেষ ব্যবস্থায় আজ খোলা থাকবে। লেনদেন চলবে তিন ঘণ্টা, ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত।

শ্রমিকের বেতন-বোনাস পরিশোধ নিয়ে গতকালও দুই ধরনের পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। শিল্প পুলিশ বলেছে, গতকাল বেলা তিনটা পর্যন্ত তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ২ হাজার ৮৮৬ কারখানার মধ্যে ১০ শতাংশ ঈদের বোনাস ও ৫৯ শতাংশ মার্চ মাসের অর্ধেক বেতন দেয়নি। এসব কারখানার মধ্যে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর সদস্য নয় এমন কারখানা রয়েছে। অবশ্য তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দাবি, তাদের সচল ৯৭ শতাংশ কারখানা বোনাস ও ৯৩ শতাংশ বেতন দিয়েছে। আর নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ বলছে, দুটি কারখানা ছাড়া অন্যগুলোয় বেতন-ভাতা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।

ঈদের বাকি আর এক–দুই দিন। বেতন-ভাতা পরিশোধে সরকার নির্ধারিত সময়সীমা ইতিমধ্যে পার হয়েছে। তবে এখনো অনেক কারখানা উৎসব ভাতা বা বোনাস ও মার্চের অর্ধেক বেতন দেয়নি।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর প্রশাসক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে গত রাতে বলেন, টিএনজেড ও এসসেইন অ্যাপারেলস—এই দুই কারখানার বেতন-ভাতা নিয়ে সমস্যা রয়েছে। টিএনজেডের পরিচালক শনিবার বিকেলের মধ্যে শ্রমিকের পাওনা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এসসেইন অ্যাপারেলসের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। এর বাইরে যেসব কারখানা বেতন বা বোনাস দেয়নি, তারা ছুটির আগেই দেবে।

অন্যদিকে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, দুটি কারখানায় বেতন-ভাতা নিয়ে সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। ৯০ শতাংশ কারখানা ছুটি দিয়ে দিয়েছে। বাকিরা বেতন-ভাতা দিল শনিবার ছুটি দিয়ে দেবে।

তৈরি পোশাকের বাইলে অন্য শিল্পকারখানাতেও শ্রমিকদের বেতন বোনাস বাকি। সাভার-আশুলিয়া, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লা ও সিলেটের বিভিন্ন খাতের ৬ হাজার ৮০৫ কারখানা তদারকি করে শিল্প পুলিশ বলেছে, গতকাল পর্যন্ত ২০ শতাংশ কারখানা বোনাস দেয়নি। এখনো মার্চের বেতন দেয়নি ৪৭ শতাংশ কারখানা।

জানতে চাইলে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, সরকার আগে থেকে কঠোর হলে শ্রমিকের পাওনা নিয়ে সমস্যা কম হতো। শ্রমিকদের সঙ্গে অন্যায় করেও মালিকেরা পার পেয়ে যাচ্ছেন, এমন অভিযোগ করেন তিনি।

শ্রম ভবনের সামনে টিএনজেড শ্রমিকেরা

পাওনা বেতনসহ বোনাসের দাবিতে টিএনজেড গ্রুপের অ্যাপারেল প্লাস ইকো, টি অ্যান্ড জেড অ্যাপারেলস ও অ্যাপারেল আর্ট কারখানার শ্রমিকেরা গতকাল ষষ্ঠ দিনের মতো রাজধানীর বিজয়নগরের শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। শ্রমিকদের আন্দোলনে সংহতি জানান গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।

বেলা সাড়ে ১১টায় সেখানেই সংবাদ সম্মেলন করেন টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিক-কর্মচারীরা। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন টিএনজেড অ্যাপারেলসের শ্রমিক শহিদুল ইসলাম। তিনি ‘মালিকের গাড়ি বিক্রি করে শ্রমিকদের টাকা দেওয়া হয়েছে’ বলে দেওয়া বক্তব্যকে মিথ্যা অভিহিত করে বলেন, টিএনজেড গ্রুপের একটি কারখানা (অ্যাপারেল প্লাস ইকো) শ্রমিকদের সামান্য টাকা দেওয়া হয়েছে। এভাবে শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ তৈরির চক্রান্ত চলছে।

সরকার আগে থেকে কঠোর হলে শ্রমিকের পাওনা নিয়ে সমস্যা কম হতো। শ্রমিকদের সঙ্গে অন্যায় করেও মালিকেরা পার পেয়ে যাচ্ছেন, এমন অভিযোগ করেন তিনি। গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, টিএনজেড অ্যাপারেলসে কর্মরত ২ হাজার ১০০ শ্রমিকের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের বেতন, ঈদ বোনাসসহ পাওনা প্রায় ৯ কোটি টাকা। অ্যাপারেল প্লাস ইকো কারখানার ৮২৬ শ্রমিকের জানুয়ারি-মার্চ মাসের বেতন, ঈদ বোনাসসহ অন্যান্য পাওনা ৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যার মধ্যে গতকাল দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা। অ্যাপারেল আর্ট কারখানার ২৪০ শ্রমিকের ডিসেম্বর-মার্চ পর্যন্ত বেতন-বোনাসসহ অন্যান্য পাওনা ২ কোটি ৪ লাখ টাকা, যা এখনো পরিশোধ করা হয়নি।

জানতে চাইলে নিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কারখানার মালিক থানায় আছেন। বেতন-ভাতা পরিশোধের চেষ্টা চলছে। মালিক টাকা না দিতে পারলে কারখানা ও যন্ত্রপাতি বিক্রি করে টাকা দেওয়া হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মালিকের পাওনা মালিককেই দিতে হবে। সরকারের পক্ষে টাকা দেওয়ার সুযোগ নেই।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ট এনজ ড গ র প র অ য প র লস পর শ ধ গতক ল সমস য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বাস্তবায়িত হোক শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ

শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দিন ১ মে। মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন। সেই আত্মদানের পথ ধরেই পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষ ন্যায্য মজুরি, মানবিক আচরণ, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবিতে এখনো আন্দোলন করছেন।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে আছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেনি বলে শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকেরা দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করে যে মজুরি পান, তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্রমিকদের অসামান্য অবদান সত্ত্বেও তাঁরা ন্যায্য মজুরি ও সুযোগ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে মজুরি সবচেয়ে কম। তৈরি পোশাকশিল্পসহ কিছু খাতে ন্যূনতম মজুরি বেঁধে দেওয়া হলেও অনেক খাতে নির্দিষ্ট মজুরি নেই। কম মজুরি দিয়ে ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশে রেখে শ্রমিকদের কাছ থেকে উপযুক্ত কাজ আশা করা যায় না।

এবার বাংলাদেশে শ্রমিক দিবস পালিত হচ্ছে ভিন্ন পরিবেশে। গত বছর আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান হওয়ার পর শ্রমিকদের সামনে যেমন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তেমনি চ্যালেঞ্জও বাড়ছে। তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সূত্র অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৫ মাসে বিজিএমইএর সদস্য, এমন ১১৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে কাজ হারিয়েছেন ৯৬ হাজার ১০৪ জন। অন্য খাতের শিল্পকারখানার খবর আরও উদ্বেগজনক।

শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংস্কার কমিশন তিন বছর পরপর শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ, অবকাশ, বার্ষিক মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে মজুরি সমন্বয়, ট্রেড ইউনিয়নের শর্ত শিথিল করা ও মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করাসহ শ্রমিকদের সুরক্ষায় অনেকগুলো সুপারিশ করেছে।

যেসব কমিশনের সঙ্গে নির্বাচন ও রাজনীতি জড়িত, তাদের সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। কিন্তু আরও অনেক কমিশনের মতো শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করতে পারে।

 শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, শ্রমিক ও মালিক উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে শিগগিরই শ্রম আইন সংশোধন করা হবে। শ্রম আইন সংশোধন হলে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে আশা করা যায়।

মে দিবস উপলক্ষে রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন পৃথক কর্মসূচি পালন করবে। কিন্তু এসব কর্মসূচি যেন নিছক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমিত না থাকে। বাংলাদেশে মে দিবস পালন তখনই সার্থক হবে, যখন শ্রমিকেরা সব ধরনের শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্ত হবেন। মালিকদেরও মনে রাখতে হবে, শ্রমিকদের ঠকিয়ে শিল্পের বিকাশ কিংবা অর্থনীতির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করা যাবে না। শ্রমিক বাঁচলেই শিল্প বাঁচবে, আর শিল্প বাঁচলে দেশ বাঁচবে।

শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা সুরক্ষিত হোক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাস্তবায়িত হোক শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ