কাগজে-কলমেই পৌর নাগরিক জোটে না কোনো সুবিধা
Published: 29th, March 2025 GMT
‘পৌরসভার আওতাভুক্ত হয়ে আট বছর কোনো সুবিধা তো পাইনি, উল্টো বিপদে আছি। মানুষের ওপর পৌরসভা হোল্ডিং ট্যাক্স, পানির বিল, বিদ্যুৎ বিল, বাড়ির খাজনা-করগুলো এক প্রকার চাপিয়ে দিয়েছে। তার বিপরীতে পৌর কোনো সুযোগ-সুবিধাই দেওয়া হয় না। এখন এক কৃষকের যে পরিমাণ খাজনা দিতে হয়, শহরের বাসিন্দাকেও একই খাজনা দিতে হয়। তাহলে পৌর নাগরিক হয়ে লাভটা হলো কী!’
আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন শহিদুল ইসলাম, যিনি ফরিদপুর সদর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলেন। তাঁর মতো আরও চার ইউনিয়ের বাসিন্দাদের একই আক্ষেপ। কারণ হিসেবে তারা জানান, ১৮৬৯ সালে ফরিদপুর শহরকে পৌরসভায় রূপান্তর করা হয়। সিটি করপোরেশন গঠনের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে সীমানা বাড়ানো হয় ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এই পৌরসভার। সদর উপজেলার পৌর এলাকা সংলগ্ন কৃষ্ণনগরসহ পাঁচটি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামকে সীমানা নির্ধারণ করে আগের ৯ ওয়ার্ড মিলিয়ে গঠন করা হয় মোট ২৭টি ওয়ার্ড। নানা জটিলতায় নতুন এলাকাগুলোকে নিয়ে সরকার সিটি করপোরেশন অনুমোদন না দেওয়ায় অবশেষে ‘ফরিদপুর বর্ধিত পৌরসভা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, সদর আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন এই হঠকারী সিদ্ধান্ত নেন। কোনো যাচাই-বাছাই ও মতামত ছাড়াই দ্রুত পৌরসভার এলাকা বর্ধিত করা হয়। বর্ধিত গ্রামীণ জনপদের বাসিন্দারা পৌরসভার কোনো সুযোগ-সুবিধা না পেলেও জমির খাজনা, হোল্ডিং ট্যাক্সসহ বাড়তি পৌর করের বোঝার চাপ তাদের ওপর। জমি কেনাবেচা করতে রেজিস্ট্রেশন ফি বেড়েছে জমির শ্রেণিভেদে ৫ থেকে ১২ গুণ। আট বছর আগে ফরিদপুর পৌরসভা থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায়, বর্ধিত পৌরসভা থেকে মুক্তি চায় প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ।
জানা গেছে, কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের প্রায় পাঁচটি গ্রামের সিংহভাগ জমি কৃষি ফসলের এলাকা, যা বর্তমান বর্ধিত পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত। এমন অনেক গ্রাম, মাঠসহ ফসলি জমি এই পৌরসভার সীমানায় পড়েছে। এলাকাগুলোতে বড় ধরনের স্থাপনা, কারখানাসহ কোনো অফিস নেই; নেই ন্যূনতম নাগরিক সেবার ব্যবস্থা। নতুন এলাকাগুলোতে আলোক বাতি, পানির ড্রেন, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকার অভিযোগ পৌরবাসীর। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কৃষ্ণনগর, গেরদা, কৈজুরীসহ কয়েকটি ইউনিয়ন থেকে কেটে সংযুক্ত হওয়া বর্ধিত পৌরবাসী বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। পৌরসভার নামে বৈষম্যের শিকার হয়ে আগের ইউনিয়নে ফিরে যেতে চান তারা।
কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদ পুনর্বহাল আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক ফরিদ শেখ বলেন, ফরিদপুর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার ৮০ শতাংশ কৃষি এলাকা। এটি আগে কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্ধিত পৌরসভার মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনটিও বর্তমান রয়েছে। আমাদের পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত করা হলেও নাগরিক সেবার উন্নয়ন হয়নি।
ফরিদপুর পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শামসুল আরেফিন সাগর বলেন, আমরা কাউন্সিলর থাকা অবস্থায় বর্ধিত এলাকার জনসাধারণকে নিয়ে বিপাকে ছিলাম। আমি পরপর দু’বার কাউন্সিলর হয়েছি। কিন্তু বর্ধিত এলাকায় হাজার হাজার মানুষকে তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারিনি। দিনের পর দিন তাদের আক্ষেপের কথা শুনেছি। সমাধানের আশ্বাসও দিয়েছি। এখন বর্তমান সরকারের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব ফরিদপুর পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা এবং জনগণের প্রাপ্য সেবা তাদের বুঝিয়ে দেওয়া।
ফরিদপুর পৌরসভার প্রশাসক চৌধুরী রওশন ইসলাম বলেন, পৌর এলাকায় অন্তর্ভুক্ত কোনো এলাকাকে বাদ দেওয়ার ক্ষমতা পৌরসভার নেই। তবে যদি কোনো এলাকাবাসী পৌরসভায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে না চান, তাহলে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তদন্তের মাধ্যমে দাবি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রসভ র প রসভ র ইউন য ন র ইউন য় র এল ক
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্বকে বাঁচাতে যুদ্ধ থামাতেই হবে
গাজায় চলমান গণহত্যার মধ্যেই ইরানে ইসরায়েলের হামলা এবং তার জের ধরে মধ্যপ্রাচ্যে যে অশান্তির বিষবাষ্পের উদ্গিরণ শুরু হয়েছে, তা বৈশ্বিক আতঙ্ক জাগিয়ে তুলেছে। ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইরানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের হত্যা এবং তার জবাবে ইসরায়েলে ইরানের প্রত্যাঘাত যে নতুন সংঘাতের সূচনা করেছে, তা স্পষ্টতই অঞ্চলটিতে সর্বাত্মক যুদ্ধে মোড় নিচ্ছে।
ইসরায়েলের দিক থেকে ‘তেহরানকে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে’ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এবং ইরান হুঁশিয়ারি দিয়েছে—যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স যদি ইসরায়েলকে রক্ষায় সামরিক হস্তক্ষেপ করে, তাহলে ইরান ওই দেশগুলোর মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানাবে।
প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন মাত্রায় মোড় নিতে থাকা এই উত্তেজনার আঞ্চলিক পরিসর থেকে বৈশ্বিক উত্তেজনায় রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে।
আজকের ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের নেপথ্যে পশ্চিম তথা যুক্তরাষ্ট্রের দায় যে অনেকখানি, তা স্পষ্টতই প্রতিভাত হচ্ছে। বিশেষ করে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর রাশ টেনে ধরা প্রশ্নে ট্রাম্পের ব্যর্থতা অথবা অনিচ্ছা এই অশান্তির পেছনে বড় নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।
ইসরায়েল আঘাত হানার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, এটি ইসরায়েলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত; যুক্তরাষ্ট্র এতে জড়িত নয়। সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই সপ্তাহখানেক আগে নেতানিয়াহুকে অনুরোধ করেছিলেন, অন্তত যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের পারমাণবিক আলোচনার আগে যেন ইসরায়েল এই ধরনের অভিযান চালানো থেকে বিরত থাকে। কিন্তু নেতানিয়াহু সে অনুরোধ রাখেননি।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে, ইসরায়েল কি এই হামলার মাধ্যমে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনাকে ভন্ডুল করে দিতে চেয়েছে? কারণ, ইসরায়েলের কাছে সম্ভাব্য ইরান-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি এক কৌশলগত হুমকি।
যদিও ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইসরায়েলের এই হামলাকে সমর্থন দেননি; কিন্তু ইসরায়েলি পক্ষের দাবি, তারা মার্কিন সম্মতির একটি গোপন সংকেত পেয়েই হামলা চালিয়েছে। ইরান পাল্টা হামলা চালানোর পর ট্রাম্প ইরানের প্রতি ‘আরও ভয়াবহ হামলা আসছে’, ‘চুক্তি করো, নইলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না’ এবং ‘আমরা সব আগেই জানতাম’ ইত্যাদি বলে যে দ্বৈত অবস্থানের জানান দিয়েছেন, তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে এক বিপজ্জনক সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যকে নিজের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক লক্ষ্য অনুযায়ী পুনর্গঠনের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এর অংশ হিসেবে তারা ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করতে চায়। কারণ, ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে ইসরায়েল তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে।
তবে ইসরায়েল যদি বিশ্বাস করে থাকে, কেবল কয়েকজন বিজ্ঞানী ও কিছু অবকাঠামো ধ্বংস করলেই ইরানের পরমাণু হুমকি চিরতরে থেমে যাবে, তাহলে তা হবে একটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও কল্পনাপ্রসূত হিসাব। বরং, এই হামলার ফলে ইরান হয়তো আরও দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে পারে এবং তা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোকেও সেই পথে ঠেলে দিতে পারে।
ট্রাম্প তাঁর শপথ গ্রহণ ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমার সবচেয়ে গর্বের উত্তরাধিকার হবে শান্তি প্রতিষ্ঠার ভূমিকা।’ অথচ এখন তাঁর বক্তব্যে সেই শান্তির ইঙ্গিত অনুপস্থিত। তিনি বলছেন, এই সংঘাত যদি আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নেয়, তাতেও তিনি উদ্বিগ্ন নন। এই মনোভাব বিপজ্জনক।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির বর্তমান অস্পষ্টতা ও আত্মবিরোধিতা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতাই বাড়াচ্ছে না, বরং তা এমন এক পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে, যেখানে ভুল সিদ্ধান্তের পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী। এই সত্যকে সবার উপলব্ধি করতে হবে।