বৎসর ঘুরিয়া আবারও আসিল মুসলমানদিগের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। আজ শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলে আগামীকাল ঈদুল ফিতর; নতুবা উহা পালিত হইবে মঙ্গলবার। এই উপলক্ষে সমকাল পরিবারের পক্ষ হইতে গ্রাহক, পাঠক, সাংবাদিক, কর্মচারী, এজেন্ট, বিজ্ঞাপনদাতাসহ সকল শুভানুধ্যায়ীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।
বরাবরের ন্যায় ঈদুল ফিতর আসিয়াছে এক মাস সিয়াম সাধনার পর, যেইখানে ইবাদত বন্দেগির পাশাপাশি জীবন-যাপনে সংযম পালনই মূল কথা। আত্মশুদ্ধির এই সাধনাশেষে আসে বলিয়াই ঈদুল ফিতর মুসলমানদের নিকট নির্মল আনন্দের উপলক্ষ হইয়া দাঁড়ায়। রমজান মাসে শুধু আহারে-বিহারে সংযম পালন নহে, পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার সৌকর্য দ্বারাও অভিষিক্ত হন একজন মুসলমান। ত্যাগ-তিতিক্ষা, উদারতা, বদান্য, মহানুভবতা ও মানবতারও বিশেষ প্রকার চর্চা হয় এই সময়ে। এই সকল গুণের প্রভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে গড়িয়া উঠে সকলের মাঝে নিজেকে বিলাইয়া দেওয়ার মানসিকতা, যাহার প্রতিফলন ঘটে ঈদের দিনে সকল শ্রেণিগত ও সামাজিক ব্যবধান ঘুচাইয়া সকলের এক কাতারে শামিল হইবার মধ্যে। ইহার ফলস্বরূপ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রতিবেশীও এক অনন্য ভ্রাতৃত্ববোধে প্রাণে প্রাণ মিলায়। ঈদ উৎসব শুধু ধর্মীয় উৎসব থাকে না, হইয়া উঠে সর্বজনীন। সমাজে উগ্র চিন্তা এবং শুদ্ধ-অশুদ্ধের দ্বন্দ্ব আছে, সন্দেহ নাই। মূলত এই কারণে শুধু ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষদের উপর নহে, স্বীয় ধর্মের ভিন্ন জীবনাচরণ ও প্রার্থনারীতির অনুসারীদের উপরও বিগত সময়ে বহু দুর্ভাগ্যজনক হামলা আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। তবে রমজানের প্রকৃত শিক্ষা অনুসরণ ও অনুশীলনের উপর গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে এই সংকটও নিরসন করা যায়; গড়িয়া তোলা যায় মানুষে-মানুষে সম্প্রীতি। প্রকৃত প্রস্তাবে, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এই বিষয়টি জরুরি হইয়া পড়িয়াছে। উক্ত গণঅভ্যুত্থানে কেবল স্বৈরাচারী সরকারকেই বিদায় করা হয় নাই, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য নিরাপদ, বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠারও অঙ্গীকার করা হইয়াছে।
প্রতি বৎসর রমজানকে সম্মুখে রাখিয়া একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর মধ্যে ভোক্তার পকেট কাটিবার প্রতিযোগিতা দুঃখজনক এক রীতি হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। এইবারও বিশেষত রমজান মাস আরম্ভের পূর্বে এহেন দুঃখজনক প্রবণতা দেখা গিয়াছিল। তবে সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ অনেকাংশেই সেই প্রবণতা রুখিয়া দিয়াছে। চাউল, ভোজ্য তৈল এবং আরও দুই-একটা নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামের বিষয়টি বাদ দিলে এইবার রোজাদারেরা মোটামুটি স্বস্তির সহিত মাসটি পার করিতে পারিয়াছেন। তবে নানাবিধ কারণে শিল্পক্ষেত্রে সংকট এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে উক্ত সময়ে বহু মানুষ যে চাকরি হারাইয়াছেন অথবা আয় হ্রাসের শিকার হইয়াছেন, উহাও স্বীকার করা প্রয়োজন। পরিবার-পরিজন লইয়া এই মানুষেরা যাহাতে আনন্দের সহিত ঈদ উদযাপন করিতে পারে, সেই ব্যাপারে সরকার ও সমাজের ধনাঢ্য অংশের সক্রিয় ভূমিকা আমরা প্রত্যাশা করি। উৎসবের আনন্দ প্রিয়জনের সহিত ভাগাভাগি করিতে রাজধানীসহ বড় বড় শহর হইতে এইবার যাহারা দূর-দূরান্তে ছুটিয়া যাইতেছেন তাহাদের ভোগান্তি নাই বলিলে চলে। আবার পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ইহাও সত্য, বিশেষত আর্থিক সংকট ও নিরাপত্তাহীনতাজনিত ভয়ের কারণে এইবার বহু মানুষ স্বগৃহে থাকিয়া যাইবার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন। তবে আমাদের প্রত্যাশা, ঈদযাত্রার ন্যায় উৎসবশেষে কর্মস্থলমুখী মানুষদের যাতায়াতও যেন নির্বিঘ্ন থাকে।
আমাদের বিশ্বাস, ঈদের ছুটিতে হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশসহ জরুরি সেবা কার্যক্রমসমূহ অতীতের ব্যত্য়য়ের অবসান ঘটাইয়া যথাযথভাবে চালু থাকিবে। বিশেষত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রয়োজনমতো চিকিৎসক, তাহাদের সহকারী এবং চিকিৎসাসামগ্রী থাকিবে। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষসমূহের ধারাবাহিক নজরদারির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীগণ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকিবেন– এই প্রত্যাশাও আমাদের।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রাম ঘেঁষে তুলশীগঙ্গা নদীর অদূরে সন্ন্যাসতলীর বটতলা। জায়গাটিতে প্রায় একশ বছর আগে থেকে বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার আয়োজন হয় ঘুড়ির মেলা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তত ৫০ গ্রামের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শুক্রবার সন্ন্যাসতলী ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মেলার দিনক্ষণ মনে রেখে সময়মতো দোকানিদের পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ভিড় জমান নিভৃত পল্লীতে। আগে মেলার দিন বৃষ্টি হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। প্রচণ্ড গরম ও তাপপ্রবাহের মধ্যেই চলে এ আয়োজন। বৈরী পরিবেশের কারণে উৎসবের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সন্ন্যাসতলীর এ ঘুড়ি উৎসব শুরুর দিন বিকেলে বটতলায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় সন্ন্যাস পূজা পালন করেন। তাদের এ পূজা-অর্চনা ঘিরেই মূলত এ মেলার উৎপত্তি। তবে শুরুর কথা কেউ বলতে পারেননি। প্রবীণরা শুধু জানেন, একশ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এ মেলার আয়োজন দেখে আসছেন।
মেলার নিজস্ব জায়গা না থাকলেও এর ব্যাপ্তি প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই এক দিনের এ মেলা ঘিরেই জেলার জামালগঞ্জ চারমাথা থেকে ঐতিহাসিক আছরাঙ্গাদীঘি পর্যন্ত রকমারি পণ্যের দোকান বসে। এখান থেকে সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আসবাব থেকে শুরু করে ছোট মাছ ধরার বাঁশের তৈরি পণ্য খলসানি, টোপা, ডালা, চালুন কিনে নেন অনেকে।
সুতার তৈরি তৌরা জাল, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, মিষ্টান্ন, প্রসাধনী, মাটির তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলার ব্যবস্থাও। আর মেলার বড় আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো ও বিক্রি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন ঘুড়ি বিক্রি করতে।
প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি তেমন হাওয়া-বাতাস না থাকায় এবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা সেভাবে জমে ওঠেনি। তবে ঘুড়ি বেচাকেনা ও শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এ উপলক্ষে আসা হাজার হাজার দর্শনার্থীর নিরাপত্তার জন্য মেলায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল ছিল।
আদমদীঘির শিববাটি গ্রামের ঘুড়ি ব্যবসায়ী সালাম হোসেনের ভাষ্য, সন্ন্যাসতলীর মেলা বড় হওয়ায় তিনি এসেছেন ঘুড়ি বিক্রির জন্য। মেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুড়ি বিক্রি করতে পেরে তিনি খুশি। জয়পুরহাটের পার্বতীপুর এলাকার ঘুড়ি ব্যবসায়ী মফিজ উদ্দিন ও মজনু সরদার বলেন, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এ মেলার কথা শুনে আসছেন তারা।
মেলা উদযাপন ও পূজা কমিটির সদস্য মহব্বতপুর গ্রামের মন্টু মণ্ডল বলেন, মেলাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও এটি আসলে সব ধর্মালম্বীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন হোসেনের ভাষ্য, এক দিনের আয়োজনে যে এত লোকের সমাগম হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেলায় যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড না হয়, সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ক্ষেতলাল থানার ওসি মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক আছে। মেলায় অনৈতিক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।