একে একে সব কটি আলো নিভে গেল রফিকুল ইসলামের পরিবারটির। নিহতের তালিকায় শেষ নাম তাসনিয়া ইসলাম প্রেমা। আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁর মরদেহ ঢাকায় নেওয়ার তোড়জোড় চলছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মর্গে। তাঁকে দাফন করা হবে মিরপুরের কবরস্থানে মা, বাবা ও দুই বোনের পাশে। একসঙ্গে পুরো পরিবার নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন স্বজনেরা।

লাশ নিতে আসা তাসনিয়ার মামা রবিউল হাসানের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে এই কদিনে। রবিউল হাসান বললেন, ‘একটা পরিবার পুরোপুরি শেষ হয়ে গেল। আমার বৃদ্ধ মা এই ঘটনার পর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চোখের সামনে মেয়ে, জামাতা, নাতনিদের মৃত্যু দেখতে হলো তাঁকে। এই দুর্ঘটনা আমাদের দিকে তিন মায়ের বুক খালি করেছে। এ ছাড়া দিলীপ বাবুর মা-বাবাও দেখলেন ছেলে ও পুত্রবধূর লাশ। এক দুর্ঘটনা কত মায়ের বুক খালি করল!’

চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় গত বুধবার এ সড়ক দুর্ঘটনায় তাসনিয়াসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে তাসনিয়ার মা, বাবা, দুই বোনসহ একই পরিবারের পাঁচজন রয়েছেন। ঘটনাস্থলে মারা যাওয়া তাসনিয়ার মা লুৎফুন নাহার, বাবা রফিকুল ইসলাম এবং দুই বোন আনিশা আক্তার ও লিয়ানার মরদেহ বৃহস্পতিবার মিরপুর–১১ নম্বরে কালশী কবরস্থানে দাফন করা হয়। একই স্থানে দাফন করা হয় রফিকুল ইসলামের ভাগনি তানিফা ইয়াসমিনকেও। এখন তাসনিয়াকেও তাঁদের পাশে কবর দেওয়া হবে বলে জানান তাঁর মামা রবিউল হাসান।

সড়ক দুর্ঘটনার পর থেকে তাসনিয়ার মামা রবিউল হাসান ঢাকা-চট্টগ্রাম দৌড়ের মধ্যে রয়েছেন। পাঁচজনের লাশ দাফন করে আজ শুক্রবার সকালে তিনি ও অন্যরা চট্টগ্রামে ফিরেছেন। সঙ্গে রয়েছেন নিহত তানিফার ভাই সাকিব আহমেদ। মামাতো বোনের লাশ নিতে তিনিও আসেন।

সাকিব আহমেদ বলেন, ‘মামাদের সঙ্গে আমার ছোট বোনকে দাফন করা হয়েছে। এখন প্রেমাকে নিতে এসেছি। নিজের মেয়ে এবং ভাইয়ের পরিবারকে হারিয়ে আমার মা (নাসরিন বেগম) খুব ভেঙে পড়েছেন।’

নিহত রফিকুল ইসলাম ঢাকায় একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা ছিলেন। বাড়ি পিরোজপুরে। তিনি ঢাকায় মা ও পরিবার নিয়ে থাকতেন। ঈদের ছুটিতে রফিকুল ইসলাম নিজের পরিবার, সহকর্মী দিলীপ বিশ্বাসের পরিবারসহ কক্সবাজারে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। বুধবার সকালে তাঁদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়ার জাঙ্গালিয়া এলাকায় পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাসের সঙ্গে ধাক্কা খায়। ওই দিনই ১০ জন মারা যান। আজ তাসনিয়ার মৃত্যু হলো।

নিহত বাকিরা হলেন দিলীপ বিশ্বাস ও তাঁর স্ত্রী সাধনা মণ্ডল, সাধনার স্বজন আশীষ মণ্ডল, রফিকুলের স্বজন মোক্তার আহমেদ এবং চালক ইউছুফ আলী।

একই দুর্ঘটনায় নিহত দিলীপ বিশ্বাস ও তাঁর স্ত্রী সাধনা মণ্ডলের মা–ও এমন মৃত্যু কোনোভাবে মেনে নিতে পারছেন না।

রবিউল হাসান বলেন, ‘দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমরা চট্টগ্রাম আসি। এখানে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং স্বেচ্ছাসেবকেরা যেভাবে আমরা আসার আগে থেকেই আহতদের সেবা দিয়েছে, তা অনেক বড় পাওয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের পরিবারের কাউকে বাঁচাতে পারলাম না।’

এ ঘটনায় নিহত দিলীপ বিশ্বাসের মেয়ে আহত আরাধ্য বিশ্বাসকে আজ ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছে। আরাধ্যর মামাতো ভাই আহত দুর্জয় মণ্ডল চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র পর ব র দ র ঘটন ঘটন য়

এছাড়াও পড়ুন:

দুই বন্ধু ও দুটি স্বপ্নের বিদায় 

উত্তরার ১৭ নম্বর সেক্টরের ৬ নম্বর অ্যাভিনিউতে বিজিএমইএ ভবন। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিবের জানাজায় শোকাবহ পরিবেশ। প্রিয় মানুষকে চিরবিদায় জানাতে এসেছেন দীর্ঘদিনের সহকর্মী, বন্ধু, পরিবারের সদস্য ও পরিচিতজন। শোক ও অশ্রুতে তারা রাকিবকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন। রাকিবের অসমাপ্ত কাজ ও স্বপ্ন এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার করেন সহকর্মীরা। 

৯ জুন কানাডায় একটি লেকে ভ্রমণের সময় নৌকাডুবে মারা যান আবদুল্লাহ হিল রাকিব ও তাঁর বন্ধু বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন মো. সাইফুজ্জামান। কানাডায় বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়ের সঙ্গে সাইফুজ্জামান ঈদের ছুটি কাটাতে স্ত্রী ও আরেক মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে বন্ধু ব্যবসায়ী রাকিব ও তাঁর ছেলের সঙ্গে একটি লেকে ঘুরতে গিয়েছিলেন। অন্টারিও প্রদেশের স্টারজিয়ন লেকে ক্যানুতে (সরু লম্বা ছোট্ট নৌকা) চড়ে ভ্রমণে বের হন। নৌকাটি উল্টে গেলে পানিতে ডুবে প্রাণ হারান দু’জন। বিদেশের মাটিতে একসঙ্গে দুই বন্ধুর মৃত্যু, একই ফ্লাইটে ফেরা, দেশে ফিরে একই কবরস্থানে শেষ শয্যা! 

অশ্রুসজল চোখে রাকিবের কানাডাপ্রবাসী মেয়ে লামিয়া তাবাসসুম বলেন, ‘বাবা স্বপ্ন দেখতেন, দেখাতেন। তিনি যেসব স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছেন, যেসব কাজ রেখে গেছেন, আমরা যেন সুন্দরভাবে তা বাস্তবায়ন করতে পারি। পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে কানাডায় গিয়েছিলেন বাবা।’ 

রাকিব ও সাইফুজ্জামান ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাদের মরদেহ বিমানের একই ফ্লাইটে শুক্রবার রাতে ঢাকায় আনা হয়। জানাজা শেষে ঢাকায় বিমানবাহিনীর কবরস্থানে দু’জনকে সমাহিত করা হয়। তাদের সহকর্মী ও বন্ধুরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে অকালে দুটি স্বপ্ন বিদায় নিল। 

রাকিবের সহকর্মীরা বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানিকে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করার স্বপ্ন দেখতেন রাকিব। তারা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহায়তা করবেন বলে জানান। 

উত্তরায় জানাজার আগে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আবদুল্লাহ হিল রাকিবের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছি। সব সময়ই দেখেছি, তিনি নিজের পরিবার, বন্ধু, ব্যবসা ও বিজিএমইএকে সমান অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তৈরি পোশাকশিল্প খাতের যে কোনো সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি সামনে চলে যেতেন। রাকিবের দর্শন ছিল– সফলতার মাত্রা নেই। তবে একজন ব্যক্তি কতটা সফল, সেটি তাঁর কর্মযজ্ঞ দেখলে বোঝা যায়।’ 

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এস এম ফজলুল হক বলেন, রাকিব উজ্জ্বল প্রদীপ। স্বপ্ন ছিল অনেক। ঝোড়ো হাওয়ায় সেই প্রদীপ নিভে গেছে। সবাই তাঁর জন্য দোয়া করবেন। 

রাকিবের জন্য সবার কাছে দোয়া চান বিজিএমইএর সর্বশেষ নির্বাচনে বিজয়ী রাইজিং ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান। স্মৃতিচারণা করে বক্তব্য দেন রাকিবের বড় ভাই আবদুল্লাহ হিল নকীব। 

ক্যাপ্টেন সাইফুজ্জামানের সহকর্মীরা জানান, শুক্রবার তাঁর মরদেহ কানাডা থেকে ঢাকায় আনার সময় তাঁর সঙ্গে স্ত্রী, দুই মেয়ে, বোন এবং ভগ্নিপতি ছিলেন। মরদেহ পৌঁছার পর উপস্থিত পাইলটরা সহকর্মীর মরদেহে স্যালুট দেন। এর পর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও পাইলটস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে মরদেহ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মর্গে রাখা হয়। সেখান থেকে মরদেহ নেওয়া হয় তাঁর বনানীর ডিওএইচএসের বাসায়। বেলা ১১টার দিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঘাঁটি বাশারের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা হয়। সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল মোহাম্মদ ইনামুল বারীসহ পাইলট, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এতে অংশ নেন। পরে জোহরের নামাজ শেষে ডিওএইচএস মাঠে একসঙ্গে ক্যাপ্টেন সাইফুজ্জামান ও রাকিবের জানাজা হয়। সাইফুজ্জামানকে বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়। একই কবরস্থানে দাফন করা হয় রাকিবকে। তাঁর বাবা বিমানবাহিনীর সদস্য ছিলেন। 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাশাপাশি খোঁড়া হচ্ছে মা-ছেলের কবর, সেই দৃশ্য কাঁদাচ্ছে এলাকার মানুষকে
  • দুই বন্ধু ও দুটি স্বপ্নের বিদায় 
  • সরকারি হিসাবের চেয়ে করোনায় মৃত্যু ছিল বেশি
  • দেশে ফিরেছে ব্যবসায়ী রাকিব ও পাইলট সাইফুজ্জামানের মরদেহ