পাল্টা শুল্ক কার্যকরে সময় চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি দেওয়ার পরামর্শ ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের
Published: 5th, April 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দ্রুত আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠিয়ে পাল্টা শুল্ক কার্যকরের বিষয়ে কিছু সময় চেয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন রপ্তানি খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ চিঠি পাঠাতে হবে। কারণ, ইতিমধ্যে প্রতিযোগী দেশগুলো এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।
আজ শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভায় এ পরামর্শ দেওয়া হয়। বৈঠকটি চার ঘণ্টাব্যাপী চলে। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ট্রাম্প প্রশাসনকে দেওয়ার জন্য একটি চিঠির খসড়াও তৈরি করা হয়েছে বৈঠকে। পরে সেই চিঠি উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।
সভায় বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি শামীম এহসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান জায়েদী সাত্তার, গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং বা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রমুখ অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্যবিশেষজ্ঞ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
সভায় উপস্থিত একাধিক ব্যবসায়ী নেতা প্রথম আলোকে জানান, মার্কিন সরকারের নতুন পাল্টা শুল্ক আরোপ নিয়ে খুব দ্রুত দেশের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা। সে আলোকে আজ দুপুরে দেশের বিভিন্ন রপ্তানি খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করে বিডা।
এ দিকে আজ সন্ধ্যায় মার্কিন পাল্টা শুল্ক নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। বিডায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা যেসব সুপারিশ দিয়েছেন, সেগুলো প্রধান উপদেষ্টার সামনে উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন বিডার কর্মকর্তারা।
বিডায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা আহ্বান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দ্রুত আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠিয়ে কিছু সময় চাওয়া যেতে পারে। ইতিমধ্যে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া পাল্টা শুল্ক কার্যকরের সময় তিন মাস স্থগিত চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। বাংলাদেশেরও এটি দ্রুততম সময়ে করা প্রয়োজন।
বৈঠকে তাঁরা আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার প্রায় ৮০০ কোটি ডলারের। এর ফলে পাল্টা শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশ বেশ চাপে পড়বে। এ জন্য দ্রুত করণীয় ঠিক করতে হবে। কারণ, ইতিমধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। এর ফলে বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।’
বিনিয়োগ সম্মেলন ঘিরেও প্রস্তুতি৭ থেকে ৯ এপ্রিল দেশে বিনিয়োগ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনে পাঁচ শতাধিক বিদেশি বিনিয়োগকারী যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। এই সম্মেলন ঘিরে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়েও বিডায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
সম্মেলন প্রসঙ্গে বৈঠক শেষে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘সম্মেলন ঘিরে আমাদের প্রত্যাশা কী, আমরা কীভাবে সহায়তা করতে পারি, সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সংগত কারণে এখানে মার্কিন নতুন শুল্কনীতির প্রভাব বিষয়েও কথাবার্তা হয়েছে। শুল্কনীতি নিয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে কী জানাতে পারি, সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ এসেছে বৈঠকে।’
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘আসন্ন বিনিয়োগ সম্মেলন নিয়ে যখন পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তখন মার্কিন পাল্টা শুল্কের বিষয়টি সামনে ছিল না। তবে এখন সম্মেলনে এসে বিনিয়োগকারীদের প্রথম প্রশ্ন থাকবে, এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া কী। তাই আমরা আশা করছি, অবশ্যই ৯ তারিখের আগে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটা যথাযথ উত্তর আসবে। এটি যে আসবে, সে বিষয়ে আমরা আশাবাদী। কারণ, প্রধান উপদেষ্টা নিজে বিষয়টিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ল ক ক র যকর অন ষ ঠ ত ব যবস য় উপস থ
এছাড়াও পড়ুন:
পাল্টা শুল্কের কারণে ক্রয়াদেশ কম
তৃতীয় দফা আনুষ্ঠানিক আলোচনা চলমান থাকা অবস্থায় আজ শুক্রবার থেকে বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের আরোপ করা ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হচ্ছে। বাড়তি শুল্কহার শেষ পর্যন্ত কত শতাংশে স্থির হয় সেটি ফয়সালা না হওয়ায় মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আগামী মৌসুমে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ ২০ শতাংশ পর্যন্ত কম দিচ্ছে। আবার কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত ক্রয়াদেশ না দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
পাল্টা শুল্ক কার্যকরের সময় চলে এলেও তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা আগের মতো উদ্বিগ্ন নন। কারণ, দুই-তিন দিন ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও মার্কিন বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে যে ইঙ্গিত পাচ্ছেন তাতে বাংলাদেশের পাল্টা শুল্ক ভিয়েতনামের কাছাকাছি চলে আসতে পারে। এ ছাড়া প্রতিযোগী দেশ ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, বর্তমানে বসন্ত ও গ্রীষ্মের ক্রয়াদেশ আসার মৌসুম। তবে পাল্টা শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বাড়বে। তাতে তৈরি পোশাকের বিক্রি কমবে। সেটি অনুমান করে মার্কিন বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিশ্রুতির চেয়ে ১০-২০ শতাংশ কম ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত ক্রয়াদেশ দিতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার কথা জানিয়েছে। শেষ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার কাছাকাছি নামিয়ে আনা গেলে বাংলাদেশের ভালো সম্ভাবনা তৈরি হবে। তার কারণ চীন থেকে ব্যাপক হারে ক্রয়াদেশ সরবে।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘পাল্টা শুল্ক নিয়ে আমরা খুব বেশি ভয় পাচ্ছি না এখন। তবে বাড়তি শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের চাহিদা কমবে। তাতে স্বাভাবিকভাবেই ক্রয়াদেশও কিছুটা কমতে পারে। বাড়তি শুল্ক কার্যকর ও শুল্কহার নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলে আগামী ৩-৪ মাস হয়তো ক্রয়াদেশ কম থাকতে পারে। শেষ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক ভিয়েতনামের কাছাকাছি নামিয়ে আনতে পারলে ক্রয়াদেশ বাড়বে।’
যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে, সেসব দেশের ওপর গত ২ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক বা রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ আরোপ করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের ৫৭টি দেশের ওপর বিভিন্ন হারে বাড়তি পাল্টা শুল্ক বসানো হয়। তখন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক ছিল ৩৭ শতাংশ। তিন মাসের জন্য এ সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প ৮ জুলাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের জন্য পাল্টা শুল্ক হবে ৩৫ শতাংশ, যা কার্যকর হবে ১ আগস্ট থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রপ্তানি করেন। নতুন হার কার্যকর হলে তা ৫০ শতাংশে দাঁড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্কহার কমাতে তৃতীয় দফার আলোচনা করতে বর্তমানে ওয়াশিংটনে রয়েছে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। এই দলটি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের আলোচনা শেষ করেছে। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
দেশের তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী ইভিন্স গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। তাদের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ২৫ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।
জানতে চাইলে ইভিন্স গ্রুপের পরিচালক শাহ রাঈদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রয়াদেশ আসার গতি বর্তমানে কিছুটা ধীর। পাল্টা শুল্ক শেষ পর্যন্ত কত দাঁড়ায় তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে বাড়তি এই শুল্ক শেষ পর্যন্ত মার্কিন ক্রেতাদের দিতে হবে। ফলে বাড়তি শুল্ক কার্যকর হলে দেশটিতে বেসিক বা নিত্য ব্যবহার্য তৈরি পোশাকের বিক্রি কমবে। আমরা এসব সস্তা পোশাকই বেশি রপ্তানি করি। ফলে আমাদের রপ্তানি কমতে পারে।’
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। ১৯৮৪ সালে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে রপ্তানি করে ৩০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। তার একটি বড় অংশই যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে।
স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম বলেন, ‘মার্কিন বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক সোর্সিং অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রতিশ্রুত ক্রয়াদেশ ১০-২০ শতাংশ কমিয়ে দিচ্ছে। এপ্রিলে আমরা যেসব ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে ৫ শতাংশের মতো মূল্যছাড় দিয়েছিলাম, সেটি বসন্ত ও গ্রীষ্ম মৌসুম পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে অনুরোধ করছে।’
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একক শীর্ষ বড় বাজার। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৫ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। এ ছাড়া মাথার টুপি বা ক্যাপ, চামড়ার জুতা, হোম টেক্সটাইল, পরচুলা ইত্যাদি বেশি রপ্তানি হয়।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুল্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় বর্তমানে ক্রয়াদেশ কিছুটা কম। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশের পণ্যে শুল্ক কত দাঁড়াচ্ছে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এ ছাড়া আমাদের পাল্টা শুল্ক কমবে বলে আমরা আশাবাদী।’