বাঁশঝাড়ের পাশে রাখা আলুর স্তূপের পাশে বসে আলু কাটছিলেন রোকেয়া বেগম (৪৫)। কেটেকুটে আলুর ভালো অংশটুকু নিচ্ছিলেন, সেদ্ধ করে গরুকে খাওয়াবেন। এর জন্য আলুচাষিকে কোনো পয়সা দিতে হবে না।

কলেজছাত্র নাহিদ ও ফয়সাল বেছে বেছে লাল বস্তায় আলু ভরছিলেন। সেই আলুর দাম কেজিপ্রতি দুই টাকা।

পাশে রাস্তার ওপর রাখা ট্রাকে বোঝাই করা হচ্ছে যে আলু, তার দাম সাড়ে ১২ টাকা কেজি।

শনিবার বিকেলে রাজশাহীর তানোরের রাইতান বড়শো গ্রামে আলু বেচাকেনার এসব দৃশ্য দেখা গেল। হিমাগারে আলু রাখার জায়গা না পেয়ে চাষিরা এভাবেই আলুর গতি করার চেষ্টা করছেন।

রাজশাহী কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর আলুর কেজিপ্রতি উৎপাদন খরচ পড়েছে ২২ থেকে ২৫ টাকা। সেই আলু নিয়ে বিপদে পড়েছেন চাষিরা। তাঁরা এখন যে দামে আলু বিক্রি করছেন, তাতে উৎপাদন খরচের অর্ধেকও উঠছে না। কেউ কেউ অগ্রিম বুকিং দিয়ে হিমাগারে আলু রাখতে পেরেছেন; কিন্তু প্রান্তিক চাষিরা তা পারেননি। ফলে আলু নিয়ে তাঁদের বিপদের শেষ নেই।

প্রান্তিক চাষিরা বস্তায় ভরে বাসায় বাসায় আলু মজুদ করে রেখেছিলেন। কেউ কেউ রাস্তার পাশে আমবাগান ও বাঁশঝাড়ের ভেতরে আলু স্তূপ করে রেখেছেন। যাঁরা বস্তায় ভরে রেখেছেন তাঁদের আলু অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সব আলু ঢেলে বাছাই করে ভালোগুলো সাড়ে ১২ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। আর কিছুটা নষ্ট আলু দুই টাকা কেজিতে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। নষ্টগুলো পুরোটাই ফেলে দিতে হচ্ছে। গ্রামের মানুষ গরুকে খাওয়ানোর জন্য আলু কুড়িয়ে নিচ্ছেন। কোথাও কোথাও রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া পচা আলু থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলায় ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বাস্তবে আরও সাড়ে তিন হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে ১০ লাখ ৩০ হাজার টন। গত বছর আলুর উৎপাদন হয়েছিল ৯ লাখ ৪০ হাজার টন। সেই হিসাবে এবার ৯০ হাজার টন আলু উৎপাদন বেশি হওয়ার আশা করা হচ্ছে।

তানোরের রাইতান বড়শো গ্রামের চাষি নওশাদ আলী (৫০) এবার ৭২ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। আলু তোলার পর ২ হাজার ৫০০ বস্তা আলু হিমাগারে রাখতে পেরেছেন। হিমাগারে জায়গা না হওয়ার কারণে বাকি ৯০০ বস্তা আলু রাখার ব্যবস্থা করতে পারেননি। দাম বাড়ার আশায় সেই আলু বাড়ির পাশে বস্তায় ভরে রেখেছিলেন। কিন্তু দিন দিন আলুর বাজার পড়ে যাচ্ছে। ১৪ টাকা কেজি থেকে দাম সাড়ে ১২ টাকায় নেমে এসেছে। সর্বশেষ তাঁর ৩৫০ বস্তা আলু অবিক্রীত ছিল। বিক্রি করার জন্য বস্তা থেকে বের করতে গিয়ে ২১৬ বস্তা আলু ভালো পেয়েছেন। বাকি ১৩৪ বস্তা আলু নষ্ট হয়ে গেছে।

শনিবার সন্ধ্যার আগে নওশাদের বাড়ির পাশে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশবাগানের ভেতরে তিনি শ্রমিকদের নিয়ে বসে পচা আলু বাছাই করছেন। সেখান থেকে তানোর কলেজের ছাত্র নাহিদ ও ফয়সাল দুই টাকা কেজি দরে অপেক্ষাকৃত ভালো আলু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। কথা হয় নাহিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, গোখাদ্য হিসেবে তাঁরা এই আলু নিয়ে গিয়ে বাজারে বিক্রি করবেন। বিক্রি করার পর আলুর মালিককে টাকা দিতে হবে। ঈদের মধ্যে কলেজ ছুটি থাকার কারণে তাঁরা বাড়তি আয়ের জন্য এই কাজ করছেন।

মালিক নওশাদ আলী নিজের শ্রমিক দিয়ে বাছাই করে যেগুলো ফেলে দিচ্ছেন, তার ভেতর থেকে আলু বাছাই করে নিয়ে যাচ্ছেন রোকেয়া বেগমের মতো নারীরা। তিনি বলেন, কষ্ট করে কেটেকুটে পচা আলুর ভেতর থেকে যেটুকু ভালো পাচ্ছেন, তা সেদ্ধ করে গরুকে খাওয়াবেন।

রাজশাহীর পবা উপজেলার বায়া এলাকার ব্যবসায়ী শামীম হোসেন সাড়ে ১২ টাকা কেজি দরে আলু কিনছেন। তানোর উপজেলার আলোকছত্র গ্রামে তাঁর সঙ্গে সন্ধ্যায় দেখা হয়। তিনি শনিবার ১৫ টন আলু কিনেছেন। এক দিন আগে কিনেছিলেন ১৪ টন। তিনি এই আলু ঢাকার বাইপাইল এলাকায় খাউতি বাজারে বিক্রি করবেন বলে জানান। তিনি শনিবার পাঁচ–ছয়জন কৃষকের আলু কিনেছেন। তিনি বলেন, কেজিপ্রতি এখানেই দুই টাকা খরচ হবে। গাড়িভাড়া পড়বে ১ টাকা ৪ আনা। ঢাকায় ১৫ থেকে সাড়ে ১৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব ছ ই কর র জন য ১২ ট ক করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

মিরাজে দুর্দান্ত জয় বাংলাদেশের

এমন পারফরম্যান্সই তো চাওয়ার থাকে ভালো দলের কাছে। মেহেদী হাসান মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্য, সাদমান ইসলামের সেঞ্চুরি, তাইজুল ইসলামের ৯ উইকেট শিকারে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইনিংস ও ১০৬ রানের বিশাল জয় এনে দেয় বাংলাদেশকে। প্রথম টেস্ট হারের পর যে সমালোচনা হয়েছিল, তার জবাবটা বোধ হয় দ্বিতীয় টেস্ট তিন দিনে জিতে দিয়ে দিলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। ‘বাউন্স ব্যাক’ করে সিরিজ ড্র ১-১-এ।

চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে বীরোচিত পারফরম্যান্স ছিল টাইগারদের। এটি সম্ভব হয়েছে পছন্দের উইকেটে খেলা হওয়ায়। স্পিন ভুবনে উইকেট উৎসব করেছেন তাইজুল, মিরাজ গাঁটছড়া বেঁধে। সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি দারুণ অর্জন অধারাবাহিক ব্যাটিং লাইনআপের। এই টেস্টে ওপেনিং জুটি ভালো করেছে। লম্বা সময় পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া এনামুল হক বিজয় ভালোই সঙ্গ দেন সাদমানকে। লোয়ার মিডলঅর্ডারে মিরাজের লড়াই ছিল দেখার মতো।

টেলএন্ডারদের নিয়ে রীতিমতো বাজিমাত করেছেন তিনি। শেষ ৩ উইকেটে তৃতীয় দিন ১৫৩ রান যোগ করেন। বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন ৪৪৪ রানে। ২১৭ রানের লিড থাকায় ইনিংস ব্যবধানে জয়ের স্বপ্ন দেখায়। মিরাজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সে স্বপ্ন পূরণ হয়। সাকিব আল হাসান ও সোহাগ গাজীর পর তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার তাঁর। 

গত বছর দেশের মাটিতে টেস্টে ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুটাও ভালো ছিল না। সিলেটে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরেছে। সিরিজ বাঁচাতে চট্টগ্রামে জিততেই হতো। লক্ষ্যে পৌঁছাতে কন্ডিশনেও পরিবর্তন আনা হয়। চট্টগ্রামের উইকেটে খেলা হয় দ্বিতীয় টেস্ট। যেখানে শাসন ছিল স্পিনারদের। পছন্দের উইকেট পাওয়ায় তিন স্পিনার নিয়ে খেলে বাংলাদেশ। তিনজনই দারুণ বোলিং করেন প্রথম থেকে।

দীর্ঘ বিরতির পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া অফস্পিনার নাঈম হাসান চ্যালেঞ্জ নিয়ে বোলিং করে গেছেন। বেশি উইকেট না পেলেও এক প্রান্তে ব্যাটারদের চাপে ফেলেছেন। যার সুফল তাইজুল ও মিরাজ পেয়েছেন অন্য প্রান্তে। প্রথম দিন শেষ সেশনে ব্রেক থ্রু দেন তিনি। বাঁহাতি স্পিনার পরে পিক করে ৬ উইকেট শিকার করেন। জিম্বাবুয়ে ৯ উইকেটে ২২৭ রানে প্রথম দিন শেষ করে। পরের দিন এক বল খেলে ওই রানেই অলআউট হয়। বাংলাদেশ ব্যাটিং শুরু করে বড় লক্ষ্য নিয়ে। সাদমান ইসলাম ও এনামুল হক বিজয় ১১৮ রানের ওপেনিং জুটি করায় প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়। সাদমানের সেঞ্চুরি ও মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম কিছু রান করায় ৭ উইকেটে ২৯১ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে বাংলাদেশ।

সেদিন সংবাদ সম্মেলনে সাদমান আশা প্রকাশ করেন, মিরাজ ও তাইজুল জুটি করবেন। অষ্টম উইকেটে ৬৪ রানের জুটি দু’জনের। বেশি ভালো করেছেন পেসার তানজিম হাসান সাকিব। মিরাজের সঙ্গে ১৫৬ বলে ৯৬ রানের জুটি। অভিষেক টেস্টে সাকিবের ব্যাটিং দারুণ লেগেছে অধিনায়ক শান্তর কাছে। ৮০ বলে ৪১ রান করেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, মাথায় বল লাগার পরও বিচলিত হননি তিনি। মিরাজ ছাড়া চট্টগ্রাম টেস্টের প্রাপ্তি হিসেবে ওপেনিং জুটির ভালো খেলা, সাদমানের সেঞ্চুরি, তাইজুলের ৫ উইকেট শিকার ও সাকিবের রান করাকে মনে করেন শান্ত। 

শেষের তিন উইকেটে তৃতীয় দিন প্রায় দুই সেশন ব্যাট করে বাংলাদেশ। তাইজুল, সাকিব ও হাসানকে নিয়ে ১৫৩ রান যোগ করে। মিরাজ ১০৪ রান করে ওয়েলিংটন মাসাকাদজাকে উইকেট দেন। নার্ভাস নাইটির ঘরে প্রবেশ করে কিছুটা ঝুঁকির মুখে ছিলেন মিরাজ। ৯৮ রানে পৌঁছানোর পর সেঞ্চুরি ছুঁতে দুই রান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফিল্ডারের কাছে বল চলে যাওয়ায় এক রানে থামতে হয়। তখন স্ট্রাইকে হাসান থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সবাই। ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। কখন হাসান আউট হয়ে যায়, সে ভয় কাজ করছিল হয়তো। কিন্তু হাসান ছিলেন দৃঢ়চেতা। মাসাকাদজাকে ডিফেন্স করে স্বস্তি দেন।

মিরাজ স্ট্রাইকে এসে মেদেভেরের প্রথম দুই বলে ঝুঁকি নেননি। তৃতীয় বলে এক রান নিয়ে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ নেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ ও দ্বিতীয় টেস্টের সেরা খেলোয়াড় মিরাজ। প্রথম ম্যাচের উভয় ইনিংসে ৫ উইকেট করে ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে অতীতের সব পারফরম্যান্স ছাড়িয়ে গেছেন। সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫ উইকেটপ্রাপ্তি, দুই হাজার রানের মাইলফলক পেয়েছেন। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ২১৭ রানে পিছিয়ে থাকা জিম্বাবুয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয় ১১১ রানে। ফ্লাডলাইটের আলো জ্বেলে নির্ধারিত সময়ের বেশি খেলান আম্পায়াররা। প্রায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খেলা হয়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটাররা তাতে আপত্তি করেননি। তাইজুল ৩, নাঈম ১ ও মিরাজ ৫ উইকেট নিলে ম্যাচ শেষ হয়।  

সিলেটে প্রথম টেস্ট হারের পর চট্টগ্রামে প্রভাব বিস্তার করে খেলে ম্যাচ জেতার পরও খুশি নন অধিনায়ক শান্ত, ‘আমি টেস্ট সিরিজ ড্র করে খুশি না। কারণ, প্রথম টেস্টে আমরা একেবারেই ভালো খেলিনি। এই টেস্টে একপেশে খেলে জিতলেও সিরিজে আরও ভালো খেলা উচিত ছিল। সিরিজটি জিততে হতো।’ টাইগার দলপতি জানান, এই পারফরম্যান্স শ্রীলঙ্কা সফরে কাজে দেবে। দেশের মাটিতে স্পোর্টিং উইকেট বানিয়ে বিদেশে খেলার পরিবেশ তৈরি করছিল বিসিবি। ২০২৩ সালে নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকে স্পোর্টিং উইকেটে খেলা হচ্ছে। কিউইদের বিপক্ষে সিলেটে ঐতিহাসিক জয় পেলেও মিরপুর থেকে হারতে শুরু করে। দেশের মাটিতে টানা ছয় হারের পর জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ