যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় ইয়েমেনে নিহত ১০
Published: 10th, April 2025 GMT
ইয়েমেনের বন্দরশহর হোদেইদারে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। বুধবার এ হামলা চালানো হয়। বৃহস্পতিবার টেলিভিশন চ্যানেল আল মাশিরার বরাতে এক প্রতিবেদনে গালফ নিউজ এ তথ্য জানায়।
দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আনিস আল আসবাহি জানিয়েছেন, নিহতদের মধ্যে ৪ জন শিশু এবং ২ জন নারী আছেন।
২০২৩ সালের অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরুর পর গাজা নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী হামাসের প্রতি সংহতি জানিয়ে লোহিত সাগরে চলাচলকারী ইসরায়েলি কিংবা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত জাহাজগুলোকে লক্ষ্য করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। কয়েক মাস এ অবস্থা চলার পর হুথিদের সতর্কবার্তা দিতে ইয়েমেনে বিমান হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র; তারপর থেকে লোহিত সাগরে চলাচলকারী মার্কিন বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা শুরু করে হুথিরা।
হামলা বন্ধে কয়েক দফায় সতর্কবার্তা দেওয়ার পর গত ১৫ মার্চ থেকে ফের ইয়েমেনে বিমান অভিযান শুরু মার্কিন বিমান বাহিনী। এর তিন দিন পর ১৮ মার্চ থেকে দুই মাসের যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় ফের সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েলও।
অবশ্য হুথি বিদ্রোহীরাও থেমে নেই। হুথি বাহিনীর মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারি জানিয়েছেন, বুধবার হুথি যোদ্ধারা একটি মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করেছে, তেল আবিবে ইসরায়েলের একটি সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালিয়েছে এবং লোহিত সাগরে টহলরত মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার জাহাজ হ্যারি এস ট্রুম্যানকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা করেছে।
ইরানের মদতপুষ্ট হুথি গোষ্ঠী ২০১৪ সালে ইয়েমেনের সরকারকে হটিয়ে রাজধানী সানা দখল করে। তবে এখনও পুরো ইয়েমেন নিজের কব্জায় আনতে পারেনি গোষ্ঠীটি। বর্তমানে ইয়েমেনের অর্ধেক অঞ্চল হুথিদের দখলে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
নেতানিয়াহুর ইরান আক্রমণ: পরিকল্পিত ফাঁদে ট্রাম্প
১৩ জুন, শুক্রবার ভোরে একের পর এক বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হলো তেহরানের আকাশ। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, এই হামলার লক্ষ্য ছিল ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা।
আগের হামলাগুলোর মতো এবারের হামলাটি কৌশলগতভাবে গোপন রাখা হয়নি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু খোলাখুলিভাবে এই অভিযানের অনুমোদন দিয়েছেন।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে ইরান। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থাপনায় ও তেল আবিব ও জেরুজালেমে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এই উসকানি ও প্রতিশোধের চক্র মধ্যপ্রাচ্যে নতুন নয়। কিন্তু এবারের পাল্টাপাল্টি হামলার সময়, এর আন্তর্জাতিক অভিঘাত এবং যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর সম্ভাব্য যে প্রভাব ফেলবে, তার কারণে ভিন্ন।
মাত্র কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় ফিরেছেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ট্রাম্প বলেছিলেন, রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসার ক্ষেত্রে জেলেনস্কির অনিচ্ছাই হচ্ছে ইউরোপের এই প্রলম্বিত সংঘাতের মূল কারণ। তাঁর মতে, কিয়েভের এই অবস্থান বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
কিন্তু নতুন সংকটের সূত্রপাত ইউক্রেন থেকে হয়নি; বরং এটি এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র নেতানিয়াহুর কাছ থেকে। নেতানিয়াহু এমন একতরফা একটি সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন, যেখানে তিনি ওয়াশিংটনকে টেনে আনতে পারেন। এটি এমন এক সংঘাত, যেটি ওয়াশিংটন শুরু করেনি। এটিকে তারা নিয়ন্ত্রণও করতে পারবে না।
এখানে বিরোধাভাসটি সুস্পষ্ট। নেতানিয়াহুর এই হামলা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় ছাড়াই হয়েছে (যদিও এ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে)। হামলাটি ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন বাইডেনের পর ট্রাম্প প্রশাসনও মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে ক্লান্তি প্রকাশ করেছে।
ইরাক ও আফগানিস্তানে দুই দশকের যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংঘাতে জড়ানোর আগ্রহ, এখন সর্বনিম্ন। অথচ একজন মিত্র নেতার একক সিদ্ধান্তের ফলে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আবারও নতুন এক সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাত ইউক্রেনের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
ইরান যে তাৎক্ষণিক পাল্টা জবাব দেবে, সেটা অবাক করার মতো বিষয় ছিল না। বিশ্বের ১০০ কোটির বেশি মুসলমানের জন্য শুক্রবার আধ্যাত্মিক ঐক্যের দিন। ফলে এটি সামরিক সিদ্ধান্তের চেয়ে বেশি কিছু ছিল। এটি ছিল প্রতীকী একটি পদক্ষেপ।
কে কতটা বড় শক্তি, তার বিচার অনেক সময় যুদ্ধ শুরু করার ধরনে নয়; বরং যুদ্ধ ঠেকানোর দক্ষতা দিয়ে মাপা হয়। নেতানিয়াহুর এই হামলা যেন বিস্ফোরকের সুতায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এখন অন্যদের দায়িত্ব, এই আগুন যেন বিস্ফোরকের গুদামে না পৌঁছায়, তার ব্যবস্থা করা।সন্ধ্যার আগেই ইরানের ড্রোন ইসরায়েলে আঘাত হানতে শুরু করে। রাত বাড়তে না বাড়তে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলে আঘাত হানে। সামনে আরও হামলার আশঙ্কা প্রবল। তেহরান ইতিমধ্যে সতর্ক করে দিয়েছে, ইরাক, সিরিয়া, কাতার ও বাহরাইনে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোও তাদের বৈধ টার্গেট হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা, ইরানের দৃষ্টিতে, ইসরায়েলের এই হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
এটাই হচ্ছে একটা ফাঁদ। মিত্ররা যখন এককভাবে পদক্ষেপ নেয় (বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মতো স্পর্শকাতর অঞ্চলে) তখন তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের সহযোগীদেরও একধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে।
যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার সরাসরি অনুমোদন দেয়নি। কিন্তু যতক্ষণ না তারা ইসরায়েলের রক্ষক এবং অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, ততক্ষণ দেশটি এর প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকিতেও রয়েছে। নেতানিয়াহুর বেপরোয়া সিদ্ধান্তের সামনে ওয়াশিংটনের নীরবতা ও অস্পষ্টতা—অনেকের চোখে সম্মতির ইঙ্গিত হিসেবে ধরা পড়তে পারে। আর ভূরাজনীতিতে, অনেক সময় ধ্যান-ধারণাই বাস্তবতা হয়ে ওঠে।
ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের পরিণতিও ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান। মালয়েশিয়ায় অপরিশোধিত তেলের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, সংঘাত যদি আরও বিস্তৃত হয়, তবে বাজারে অস্থিরতা আরও বাড়বে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো যে দেশগুলো তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তারা নতুন করে মূল্যস্ফীতির চাপে পড়বে। ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে এরই মধ্যে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা পুঁজিবাজারগুলোকেও আরও চাপে ফেলবে।
নেতানিয়াহু হয়তো বিশ্বাস করেন, ইরানে হামলা ঘরোয়া রাজনীতিতে তাঁর অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক সংকটে রয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগ, গণবিক্ষোভ এবং অতি জাতীয়তাবাদী জোটসঙ্গীদের চাপ—সব মিলিয়ে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সংকটে।
ইরানে হামলা চালিয়ে নেতানিয়াহু হয়তো তাঁর সমর্থকদের উজ্জীবিত করতে চাইছেন এবং ঘরোয়া অসন্তোষ থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে চাইছেন। নেতানিয়াহু হয়তো নিজেকে ইসরায়েলের শেষ প্রতিরক্ষা প্রাচীর হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছেন। কিন্তু এটি একটি বিপজ্জনক জুয়া।
যদি ইরানের পাল্টা আরও বিস্তৃত বা প্রাণঘাতী হয়, তবে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ বিভাজন আরও গভীর হবে। কেননা, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার ট্রমা এখনো তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
ইসরায়েলে পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, নেতানিয়াহুর নেতৃত্ব নিয়ে জনমনে হতাশা ক্রমে বাড়ছে। সে কারণেই শক্তিশালী নেতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করার এই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে।
ট্রাম্পের জন্যও এই মুহূর্ত সমানভাবে নাজুক। তিনি আবার ক্ষমতায় এসেছেন নতুন কোনো যুদ্ধে না জড়িয়েই ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু আগামী কয়েক দিনে ইরান যদি নিজেদের দেওয়া হুমকির মতো করে মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলা চালায়, তবে ট্রাম্পকে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এই মুহূর্তে যা সবচেয়ে বেশি দরকার তা হলো, জরুরি কূটনীতি। যুক্তরাষ্ট্রকে, তুরস্ক, কাতার—এমনকি নিরপেক্ষ ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে, তেহরানের সঙ্গে গোপনে সংলাপ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
ইসরায়েলকে দৃঢ়ভাবে এই পরামর্শ দেওয়া উচিত যে উত্তেজনা বাড়ানো কৌশলগত স্বার্থ সিদ্ধি করতে পারবে না। ইরানকেও বুঝতে হবে যে অতিরিক্ত প্রতিশোধ আন্তর্জাতিক মহলে তাদের প্রতি যে সামান্য সহানুভূতি এখনো আছে, সেটুকুও নষ্ট করে দিতে পারে।
এই সংকট এখনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা প্রয়োজন। নীরবতা কেবল ভুল–বোঝাবুঝিকে বাড়িয়ে তুলবে।
কে কতটা বড় শক্তি, তার বিচার অনেক সময় যুদ্ধ শুরু করার ধরনে নয়; বরং যুদ্ধ ঠেকানোর দক্ষতা দিয়ে মাপা হয়। নেতানিয়াহুর এই হামলা যেন বিস্ফোরকের সুতায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এখন অন্যদের দায়িত্ব, এই আগুন যেন বিস্ফোরকের গুদামে না পৌঁছায়, তার ব্যবস্থা করা।
ফার কিম বেং মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটির আসিয়ান স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত