নগর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নাগরিকদের সেবা দেওয়া। কিন্তু আমাদের সিটি করপোরেশন দিন দিন নিজেদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপান্তর করছে। নগর কর্তৃপক্ষ মশা নিধন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। পথচারী পারাপারে নিরাপদ জেব্রা ক্রসিংও দিতে পারে না।
সাধারণ সেবা পাবলিক টয়লেট, তাও অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করতে হয়। বছরের পর বছর সেবার মান না বাড়লেও সিটি করপোরেশনের বাজেট বেড়েছে। সর্বশেষ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ‘মাঠ অপারেটর’ নিয়োগের নামে ইজারা দিয়েছে। সেটাও আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে। সিটি করপোরেশনের এ ধরনের বাণিজ্যিক পদক্ষেপে প্রশ্ন তোলাই যায়, এটা সেবা প্রতিষ্ঠান, নাকি লিমিটেড কোম্পানি?
খেলার মাঠ ইজারা কীভাবে
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ২০২৩ সালে এক টেন্ডারের মাধ্যমে ঢাকার পাঁচটি মাঠে অপারেটর নিয়োগ দেয়। যার মধ্যে রয়েছে শহীদ তাজউদ্দীন পার্ক ও বনানী চেয়ারম্যানবাড়ী মাঠ। মাঠগুলো ইজারা দেওয়ার পর এর বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়। মাঠের খেলাধুলার জন্য ফি এবং নানা কর্মকাণ্ডে ভাড়া আদায় শুরু হয়, যার পুরোটাই যায় ক্লাব কর্তাদের কাছে। শহীদ তাজউদ্দীন স্মৃতি পার্ক ও মাঠের মাস্টারপ্ল্যান লঙ্ঘন এবং অবকাঠামো পরিবর্তন করে ক্লাব তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয়। সবচেয়ে দুঃখজনক, এই মাঠে সাধারণ মানুষের প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়।
সম্প্রতি এক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যায়, শহীদ তাজউদ্দীন স্মৃতি পার্কের অপারেটর হিসেবে নিযুক্ত গুলশান ইয়ুথ ক্লাব সব খেলার ক্ষেত্রে ফি অনেক বাড়িয়েছে। এ মাঠ ইজারা বা ভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা সিটি করপোরেশনের নেই। তারপরও তাদের নিযুক্ত অপারেটর বা ইজারাদার এ মাঠে ইচ্ছামতো ফি বাড়িয়ে তা আদায় করছে।
বছরখানেক ধরে ক্রিকেট খেলার জন্য পরিশোধ করতে হয় দুপুরে ৩ হাজার, বিকেলে ৪ হাজার টাকা। দেড় ঘণ্টা ফুটবল খেলার জন্য দুপুরে ৫ হাজার এবং বিকেলে ৮ হাজার টাকা লাগে। ৪৫ মিনিট টেনিস খেলার জন্য দুপুরে ৮ হাজার ও বিকেলে ১০ হাজার টাকা। সুইমিংপুল ব্যবহারের জন্য ভর্তি হতে লাগে ৫ হাজার টাকা। প্রতি ঘণ্টা পুল ব্যবহারের জন্য গুনতে হয় ৭০০ টাকা।
পাবলিক মাঠ কীভাবে ইজারা দেওয়া হয়; ইজারাদার কীভাবে মাঠের ফি বাড়ায়– তা বিস্ময়ের। বিদ্যমান আইন অনুসারে এটি বেআইনি। সিটি করপোরেশন নানা জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান চালালেও এসব অনিয়ম বিষয়ে উদাসীন বা না দেখার ভান করে থাকে।
আদালতের নির্দেশনা ভঙ্গে চালাকি
ঢাকা শহরের মাঠ-পার্ক উদ্ধারে আদালত একাধিকবার নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু সিটি করপোরেশন আদালতের নির্দেশনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। বরং খুবই চতুরতার সঙ্গে শহীদ তাজউদ্দীন স্মৃতি পার্ক হস্তান্তর করেছে ক্লাবকে।
গুলশানের ১৩০-এ নম্বর প্লটে ৮ একর আয়তনের একটি মাঠ ও পার্ক ছিল। এ মাঠ ও পার্ক একটি ক্লাব ধ্বংস করে কিছু লোকের প্রাইভেট সম্পত্তিতে রূপান্তর করছে। বৃষ্টির পানি শোষণের জন্য রাখা উন্মুক্ত স্থানটি তারা ঢালাই দিয়ে বন্ধ করে ফুটবলের টার্ফ বানাচ্ছে। এভাবে পার্কের ঘাসে ঢাকা সবুজ চত্বর তারা ধ্বংস করেছে এবং এই পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা পার্ক ও মাঠকে নিজেদের দখলে নিয়েছে। মাঠ ও পার্কের সব প্রবেশপথে নিরাপত্তা প্রহরী বসিয়ে জনসাধারণের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এভাবে পার্ক ও মাঠ দখল, এতে ইচ্ছামতো স্থাপনা তৈরিসহ আইনিভাবে এর প্রকৃতি ও শ্রেণির পরিবর্তন করে ভাড়া বা ইজারা দেওয়ার মাধ্যমে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার সুস্পষ্টভাবে আইন পরিপন্থি। এই পার্ক ও মাঠ নিয়ে উচ্চ আদালতে তিনটি রিট হয়। তিনটিতেই আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ রাজউককে দখল উচ্ছেদ এবং সিটি করপোরেশনকে লিজ বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছেন।
রাজউক ২০১৩ সালে মাঠ থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য নির্দেশনা দেয়। গুলশান ইয়ুথ ক্লাব এ নির্দেশনার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে। পরে আদালত রিটটি খারিজ এবং মাঠের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশনা দেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আদালতের নির্দেশনা প্রতিপালনের বদলে পার্কটি ব্যবস্থাপনার জন্য ইয়ুথ ক্লাবকে অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেয়। উল্লেখ্য, এ সময় সিটি করপোরেশন মোট পাঁচটি মাঠ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে অপারেটরের নামে তুলে দেয়। ফলে সেগুলোতে জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়।
মাঠ নয় স্টেডিয়াম
কমিউনিটি মাঠ শুধু কমিউনিটিভিত্তিক খেলাধুলার জন্য। এ মাঠ উন্মুক্ত থাকবে, যাতে শিশু-কিশোর অবাধে ও মুক্তভাবে খেলতে পারে। কিন্তু কমিউনিটির মাঠগুলো স্টেডিয়াম বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বানিয়ে দখল করে নিচ্ছে বিভিন্ন ক্লাব বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
মাঠের পাশে প্রথমে একটি ক্লাব হাউস তৈরি করা হচ্ছে। ক্লাবের উদ্যোগে মাঠে প্রথমে প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। নিয়োজিত থাকে তাদের নিজস্ব সিকিউরিটি। ধীরে ধীরে নানা স্থাপনা তৈরি করে। যার মধ্যে রয়েছে ভবনসহ ব্যাডমিন্টন কোর্ট, টেনিস কোর্ট, একাধিক ক্রিকেট প্র্যাকটিস ম্যাচ। এগুলোর মাধ্যমে মাঠ চলে যায় ক্লাবগুলোর দখলে। ক্লাবগুলো প্রশিক্ষণের জন্য মাঠ অধিকাংশ সময় ব্যস্ত রাখে। স্থানীয় কিশোর, তরুণরা মাঠে খেলতে পারে না। এভাবে পাবলিক মাঠগুলো প্রতিনিয়ত প্রাইভেট ক্লাবের দখলে চলে যাচ্ছে।
কিশোর ও তরুণদের উদ্যমহীনতা, মাদক ব্যবহার, শারীরিক স্থূলতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসসহ নানা বিষয়ে আমাদের সমাজের হতাশা রয়েছে। আমরা আক্ষেপ করে বলি, কিশোর-তরুণরা ‘ফার্মের মুরগির মতো’ বড় হচ্ছে। কিন্তু এ অবস্থার জন্য আমরাই দায়ী। আমাদের নীরবতার কারণে ঢাকার বিভিন্ন মাঠ, পার্ক দখল করে নিচ্ছে কতিপয় গোষ্ঠী। এ অবস্থার সৃষ্টি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক, নগর কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, সামাজিক- সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর উদাসীনতায়।
মাঠ রক্ষায় আইন ও আদালত: সীমাবদ্ধতা
মাঠ রক্ষায় পরিবেশবাদী এবং সাধারণ নাগরিকরা একাধিকবার আদালতে গিয়েছেন। আদালত মাঠ-পার্ক রক্ষায় কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু সরকারের নির্বাহী বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার আদালতের নির্দেশনা কোনোভাবেই আমলে নেয়নি। বরং আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে মাঠ-পার্ক পুনরায় ইজারা দিয়েছে এবং সেটি রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দেশের নগর-মহানগরীর মাঠ-পার্ক রক্ষায় মাঠ, পার্ক, জলাধার রক্ষা আইন ২০০০ রয়েছে। বিদ্যমান আইন সব মাঠ-পার্ক রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে না। এ আইনের দুর্বলতার সুযোগে দখলদার ক্লাবগুলো মাঠ দখল করে নিচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তা ছাড়া এ আইনে কেউ মামলা করতে পারে না। দখলদার ক্লাব, প্রতিষ্ঠানের শাস্তির ব্যবস্থা আরও কঠোর করা দরকার। যেমন ক্লাব, প্রতিষ্ঠান মাঠ-পার্ক দখল করলে তাদের নিবন্ধন বাতিল, কার্যনির্বাহী পরিষদকে জরিমানা ইত্যাদি।
মাঠ ও পার্ক নাগরিক সেবার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব স্থান ইজারা দেওয়া বা দখল উচ্ছেদ করতে না পারা সিটি করপোরেশনের বড় ব্যর্থতা। হাজার কোটি টাকা বাজেট থাকার পরও এই ন্যূনতম সেবা নিশ্চিত করতে না পারলে নাগরিকরা শারীরিক সুস্থতা ও মানসিক প্রফুল্লতার জন্য যাবে কোথায়?
সৈয়দ মাহবুবুল আলম: আইনজীবী ও নীতি বিশ্লেষক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ল র জন য ব যবহ র ব যবস থ প রব শ দখল ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
অফিসে আপনি কি ১১ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন
প্ল্যান ওয়ান জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা নিয়ে চলছে আলোচনা। সেখানে দুই হাজার ফুলটাইম কর্মজীবীর ওপর একটা জরিপ পরিচালনা করা হয়। পেশাগত কাজ বা চাপের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক নিয়ে পরিচালিত গবেষণাটি থেকে পাওয়া গেছে চমকপ্রদ তথ্য।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, যাঁরা কর্মক্ষেত্রে ১১ ঘণ্টা বা তার বেশি কাজ করেন, তাঁদের খাদ্যাভ্যাস তুলনামূলকভাবে অস্বাস্থ্যকর, তাঁরা অন্যদের তুলনায় মানসিক চাপে ভোগেন বেশি। ঠিকমতো পানি খাওয়ার প্রবণতা কম। পরিবার, প্রকৃতি ও পোষা প্রাণীর সঙ্গে সময় কাটানোর প্রবণতাও কম। কম ঘুমান। আর যেকোনো মানসিক আঘাত থেকে সেরে ওঠার পর্যাপ্ত সময় বা সুযোগ পান না। এই মানুষেরাই বেশি হতাশায় ভোগেন।
শুধু তা-ই নয়, দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া এবং হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের মতো কার্ডিওভাস্কুলার রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি। যাঁরা ১১ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় অফিস করেন, তাঁদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সংখ্যাও অনেক।
আরও পড়ুন২৫ বছর ধরে অফিসে যাননি তিনি১৩ মার্চ ২০২৫যদি ১১ ঘণ্টা কর্মক্ষেত্রে থাকতেই হয়, তাহলে যেসব বিষয় খেয়াল রাখবেনরাতে ৮ ঘণ্টা ঘুমাতেই হবে। তাতে শরীর ও মস্তিষ্ক দিনের শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের ধকল কাটিয়ে ওঠার সুযোগ পাবে।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিরতি নিন। সবুজের দিকে তাকান। ডেস্কে গাছ রাখতে পারেন। উঠে একটু হাঁটুন। ব্যায়াম করুন। সহকর্মীর সঙ্গে চা খেতে খেতে গল্প করুন। গবেষণা জানাচ্ছে, ছোট ছোট বিরতি কাজে মনোযোগ পুনঃস্থাপন করতে সাহায্য করে এবং কাজের গুণমান বাড়ায়।
দুপুরে খাওয়ার পর একটা ন্যাপ নিতে পারেন।
২ লিটারের একটা বোতলে পানি রাখবেন। প্রতিদিন ১ বোতল পানি অবশ্যই শেষ করবেন। তা ছাড়া পানি, শরবত, জুস, ডাবের পানি, তরমুজ, শসা, আনারস ইত্যাদি খাবেন। হাইড্রেটেড থাকলে এনার্জি ধরে রেখে কাজ করা সহজ হয়।
প্রক্রিয়াজাত খাবার, কার্বোনেটেড ড্রিংক, চিনিযুক্ত খাবার বাদ দিন। এসব কেবল আপনার ক্লান্তি বাড়াবে।
আর সম্ভব হলে কর্মক্ষেত্রে কথা বলে আপনার কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টায় নিয়ে আসতে পারলে তো কথাই নেই।
সূত্র: এনবিসি নিউজ
আরও পড়ুনঅফিসের বাড়তি কাজকে যেভাবে ‘না’ বলবেন১৩ মার্চ ২০২৫