জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশের প্রতিবাদে খুলনার কয়রায় বিক্ষোভ মিছিলে গুলি করে দলটির এক কর্মীকে হত্যার ঘটনায় ১২ বছর পর মামলা হয়েছে। মামলায় খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) সোহরাব আলী, আক্তারুজ্জামানসহ ১১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এক যুগ আগের ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে নিহত জামায়াত কর্মী জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী ছবিরন নেছা কয়রার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার আবেদন করেন। আদালত শুনানি শেষে আবেদনটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করতে কয়রা থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন। আজ শুক্রবার কয়রা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পেশকার মাইনুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

মামলায় আসামিদের মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ আইনজীবী ও  সাংবাদিকদের নামও আছে। উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন কয়রা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম, কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাহারুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিজয় কুমার, সহসভাপতি আবদুস সাত্তার পাড়, আইনজীবী আরাফাত হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, কয়রা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন, ভোরের কাগজের কয়রা প্রতিনিধি সিরাজুদ্দৌলা (লিংকন) প্রমুখ।

মামলার আরজিতে বলা হয়, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের উদ্যোগে কয়রা সদরে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মিছিল প্রতিহত করতে তখন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বে হামলা হয়। হামলায় অন্তত ৩১ জন আহত হন। তাঁদের মধ্যে বাদীর স্বামী জাহিদুল ইসলাম ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ সময় আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নিতেও বাধা দেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা।

মামলার ৫২ নম্বর আসামি কয়রা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলায় উল্লিখিত ঘটনার সময় ‌আমি খুলনা জেলা শহরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলাম। ঘটনার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। মামলায় আমার নাম থাকাটা বিব্রতকর।’

মামলার বাদী ছবিরন নেছা জানান, তাঁর স্বামী জাহিদুল ইসলাম দিনমজুর ছিলেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় জানতে পারেন তাঁর স্বামী গুলিতে নিহত হয়েছেন। তখনকার সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। তাই তিনি এই হত্যার বিচারের দাবিতে মামলাটি করেছেন। তবে মামলার আসামি তালিকায় সাংবাদিকদের নাম থাকার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না বলে মুঠোফোনে জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জামায়াতের উপজেলা আমির মিজানুর রহমান বলেন, ঘটনার দিন শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশে আওয়ামী লীগ সশস্ত্র হামলা চালায়। এ সময় বহু নেতা-কর্মী আহত হন। এর মধ্যে ঘটনাস্থলে একজন নিহত হন। সে সময় মামলা করার সাহস করেনি কেউ। এখন দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ভুক্তভোগীর পরিবার হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার বলছি, মামলায় যাতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কারও নাম জড়ানো না হয়। কেউ যদি অপরাধে জড়িত থাকে, অবশ্যই তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কিন্তু কাউকে হেয়প্রতিপন্ন কিংবা হয়রানি করতে মামলায় আসামি করা উচিত নয়। এতে সুবিচার করার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল ইসল ম ঘটন র উপজ ল আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি

বরেন্দ্র অঞ্চলে বছরে বৃষ্টি হয় প্রায় ১,২০০ থেকে ১,৫০০ মিলিমিটার পর্যন্ত। বৃষ্টি কম হওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানিও ক্রমাগত নিচে নামছে। ফলে দিনকে দিন অঞ্চলটি খরাপ্রবণ হয়ে উঠছে। তবে, গত শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) রাতের স্মরণকালের ভারী বর্ষণে বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মাটির বাড়ি ধসে পড়ার পাশাপাশি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে এবং মাঠের ধান শুয়ে পড়েছে।

রবিবার (২ নভেম্বর) সকালে রাজশাহীর কাঁকনহাট পৌরসভার দরগাপাড়া গ্রামে কৃষক জহিরুল ইসলাম নিজের জমির পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, “মাঠের ৮০ ভাগ ধান শুয়ে পড়েছে। এই ধান তুইলতে লোকও পাওয়া যাবে না। সবাইকে একসঙ্গে ধান তুইলতে হবে। আমরা এবারের খুব ক্ষতির শিকার।”

আরো পড়ুন:

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভারী বর্ষণে ৪০০ পুকুর ভেসে গেছে

পদ্মা-মেঘনায় ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে পাঙ্গাস

সরেজমিনে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কৃষকের কথার সত্যতা পাওয়া গেছে।

বরেন্দ্র অঞ্চলের ফসলি মাঠ উঁচুনিচু সিঁড়ির মতো। দুই পাশ উঁচু হলেও মাঝের অংশ তুলনামূলক নিচু থাকে, যা স্থানীয়রা ‘কান্দর’ বলেন। এবার এই কান্দরগুলো তলিয়ে গিয়ে বিলের মতো হয়েছে। এসব জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। কখনো কখনো বিলের ধান পানিতে ডুবলেও কান্দর কখনো ডুবে না। শুক্রবার রাতের বৃষ্টিতে সবই তলিয়েছে।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম বলেন, “গ্রামের দিকে খুব বৃষ্টি হয়েছে। তবে, শহরে আমরা মাত্র ১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছি।”

এদিকে, বিলের পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় মানুষ দলবেঁধে মাছ ধরতে নেমেছেন। শনিবার (১ নভেম্বর) থেকেই মাছ ধরার মহোৎসব চলছে। পবা উপজেলার শুলিতলা ভিমারডাইং এলাকায় জোয়াখালি নদীতে অর্ধশতাধিক মানুষ মাছ ধরছিলেন।

ক্ষেত থেকে শুয়ে পড়া ধান কাটছেন এক কৃষক

আলোকছত্র গ্রামের কৃষক মো. মনিরুজ্জামান (৬৫) বলেন, “জাল ফেললেই বড় বড় মাছ পাওয়া যাচ্ছে। আমি আমার জীবনে এবার দ্বিতীয়বার উত্তরা পেলি দেখছি। সাধারণত নদীর স্রোত উত্তর দিকে যায়, কিন্তু এবার উত্তরেই এত বেশি বৃষ্টি হয়েছে যে পানি দক্ষিণে যাচ্ছে।”

বিলের মধ্যে খনন করা পুকুরগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মাছচাষিরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। গোদাগাড়ীর কালোসাঁকো বিলে চারটি পুকুরে মাছচাষ করতেন মারিফুল ইসলাম। তিনি জানান, প্রায় ৪ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। অন্তত ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

রিশিকুল ইউনিয়নের খড়িয়াকান্দি এলাকায় দুটি স্থানে পাকা রাস্তা প্লাবিত হয়ে একপাশ থেকে অন্যপাশে পানি যাচ্ছে। স্থানীয়রা সেখানে জাল দিয়ে মাছ ধরছেন। রাস্তার দুই পাশে শত শত বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে। খড়িয়াকান্দি খালের পাশে ১০–১২টি বাড়ির মাটির দেয়াল ভেঙে পড়েছে।

মান্ডইল নলপুকুর গ্রামের বিশ্বনাথ সরেন জানান, তার বাড়ির দুটি ঘর ধসে পড়েছে।

জালে বড় মাছ উঠায় খুশি স্থানীয় এক বাসিন্দা

রিশিকুল এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, “আমাদের এলাকায় এমন বন্যা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। তারপর এত বৃষ্টি ও বন্যা হয়নি। এবার প্রথম।”

এলাকাবাসী জানান, পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় রান্নাবান্না সম্ভব হচ্ছে না। স্বেচ্ছাসেবীরা খিচুড়ি রান্না করে বাড়ি বাড়ি বিতরণ করছেন। গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট, আলোকছত্র হয়ে তানোরের সরনজাই ও কালীগঞ্জ এলাকায় মাঠের পর মাঠের ধান শুয়ে পড়েছে।

কালীগঞ্জের কৃষক সাবিয়ার রহমান বলেন, “আমার ১২ বিঘা জমির ধান শেষ। আধাপাকা ধান ঘরে তুলতেও লোক পাওয়া যাবে না।”

এবার মাঠ তলিয়ে যাওয়ায় আলু ও শীতকালীন সবজি চাষে বিলম্ব হবে। পার্শ্ববর্তী মোহনপুর ও বাগমারায় ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি ঢুকে যাওয়ায় পানবরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দুই পাশের জমি প্লাবিত করে বৃষ্টির পানি সড়কে উঠেছে

শনিবার বাগমারার বাসুপাড়ায় নুর মোহম্মাদ নামের এক পানচাষির মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয়দের ধারণা, বরজে পানি ঢুকে যাওয়ায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গিয়ে থাকতে পারেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন দাবি করেছেন, “ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি।” তিনি বলেন, “৫০০ হেক্টর ধানের ক্ষতির প্রতিবেদন আমরা দিচ্ছি। ধান শুয়ে পড়লেই কিন্তু ক্ষতি হবে না। মাঠে যাচ্ছি, দেখছি।”

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “কিছু উপজেলা থেকে পুকুর ভেসে যাওয়ার খবর পেয়েছি। মাছ বেরিয়ে গেছে। এটি অপরিকল্পিত পুকুর খননের কারণে হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানার জন্য উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি।”

ঢাকা/কেয়া/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ