যেভাবে লবণের কারণে ফসলের উৎপাদন কমছে কুতুবদিয়ায়
Published: 24th, April 2025 GMT
কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলা কৃষি বিভাগের কার্যালয়ে ঢুকলে চোখে পড়ে দেয়ালে টাঙানো একটি মানচিত্র। ধান-পেঁয়াজ, আঙুর, বাদামসহ বিভিন্ন শস্যদানা দিয়ে তৈরি হয়েছে কুতুবদিয়া উপজেলার মানচিত্রটি। মানচিত্রে উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নকে শস্যচিত্রে ভরিয়ে রাখা হলেও সেখানে লবণের ঠাঁই হয়নি। যদিও উপজেলার ৬ হাজার ৭৬৮ একরজুড়ে এখন লবণ উৎপাদন হচ্ছে। অন্যদিকে উপজেলার আলী আকবরডেইল, কৈয়ারবিল, বড়ঘোপ ও লেমশীখালী ইউনিয়নের অন্তত ৩ হাজার একর জমিতে বোরো ধানের চাষ হচ্ছে। অবশিষ্ট জমি খালি পড়ে আছে। উপজেলায় কৃষিজমির পরিমাণ ১১ হাজার ১১৫ একর। চাষির সংখ্যা ১৫ হাজার ৫০০।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, গত বছর উপজেলার প্রায় ১১ হাজার একর জমিতে চাল উৎপাদন হয়েছিল ২০ হাজার ৩৮৩ মেট্রিক টন। চাহিদা ছিল ২১ হাজার ১১৫ মেট্রিক টন। ঘাটতির পরিমাণ ১ হাজার ২৯৮ মেট্রিক টন। উপজেলার লোকসংখ্যা ১ লাখ ৫৩ হাজার। লবণ আগ্রাসনের কারণে ধান চাষের জমি কমছে জানিয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.
কমছে ফসলের জমি
উপজেলার সবচেয়ে বেশি ধান ও সবজি চাষ হয় আলী আকবরডেইল ইউনিয়নে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিও বেশি এই ইউনিয়নে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের খুদিয়ারটেক সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। এক যুগ আগে তাবলেরচর এলাকায় ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশের বৃহৎ বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রেটিও সাগরের পানিতে লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি আলী আকবরডেইল ইউনিয়নের পুতিন্যার পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, শতাধিক কৃষক বোরো ধানের চারা রোপণ করছেন। পরিত্যক্ত বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশেও কিছু জমিতে তরমুজসহ শাকসবজির চাষ চোখে পড়ে। তবে বেশির ভাগ এলাকায় লবণ চাষ হচ্ছে।
পুতিন্যার পাড়ায় চার কানি জমিতে বোরো চাষ করছেন স্থানীয় কৃষক আবু মুছা। প্রতি কানি জমি তিনি বর্গা নিয়েছেন ৭ হাজার টাকায়। আবু মুছা (৫৫) বলেন, ২৮ হাজার টাকা দিয়ে চার কানি জমি বর্গা নিয়ে তিনি ধান চাষে নামলেও ভয় দূর হচ্ছে না। কারণ, খেত থেকে আধা কিলোমিটার দূরে (পশ্চিমে) ভাঙা বেড়িবাঁধ। শুষ্ক মৌসুমে সাগর শান্ত থাকায় ভাঙা বাঁধ দিয়ে লোনা পানি ঢুকছে না। কিন্তু বর্ষাকাল কিংবা বৈরী পরিবেশে সাগরে উত্তাল হলে কিংবা নিম্নচাপ-ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে ফসল রক্ষার উপায় নেই।
কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবরডেইলে ধান চাষ কৃষকের। সম্প্রতি তোলাউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপজ ল র
এছাড়াও পড়ুন:
পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে
অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।
১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’
এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।
পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)