কক্সবাজারের চকরিয়া ও রামু উপজেলার নদীঘেঁষা অঞ্চলে যেভাবে তামাক চাষ অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে, তা নিছক কোনো আঞ্চলিক সংকট নয়; এ এক ভয়াবহ জাতীয় বিপর্যয়ের পূর্বাভাস। সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও সচেতনতামূলক প্রচেষ্টার অস্তিত্ব থাকলেও তা মাঠে কার্যত নিষ্প্রভ; তামাক কোম্পানির লোভনীয় প্রতিশ্রুতি আর কৃষকদের আর্থিক অনিশ্চয়তার কাছে তা পরাভূত। 

মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর চরভূমি, বনাঞ্চল ও কৃষিজমি ধীরে ধীরে তামাকের দখলে চলে যাচ্ছে। এই অশনিপ্রবণতা কেবল কৃষকের জীবিকা নয়, পরিবেশের সাম্য, জনস্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টিকে থাকার সম্ভাবনাকেও চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। 

চকরিয়ার বরইতলী ইউনিয়নে গোলাপ চাষের ব্যর্থতা আর তামাকের ক্ষণস্থায়ী লাভের মোহ এই সংকটকে আরও গাঢ় করেছে। অথচ এই সাময়িক আর্থিক সুবিধার আবরণে লুকিয়ে আছে মাটির উর্বরতার অবলুপ্তি, নদীর দূষণ, মানবদেহে মরণব্যাধির অনুপ্রবেশসহ নানা ক্ষতি। 

নদীতটে তামাকের আগ্রাসী চাষ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যাহত করে বন্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। তামাকপাতা শুকানোর জন্য বিপুল পরিমাণ কাঠের চাহিদা বনের উজাড়কে ত্বরান্বিত করছে। উবিনীগের গবেষণায় উঠে এসেছে, এই অঞ্চল ইতিমধ্যেই ভয়াবহ বন ধ্বংসের শিকার, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রবাহও দ্রুততর করছে। 

স্বাস্থ্যের ওপরও এর অভিঘাত ভয়াল। তামাকপাতার সরাসরি সংস্পর্শে এসে কৃষকের শরীরে নিকোটিনের প্রবেশ ঘটছে; যার ফলাফল চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, এমনকি ক্যানসারের মতো মরণব্যাধির করাল গ্রাস। চকরিয়া ও রামুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর প্রতিবেদনে এই রোগগুলোর বাড়বাড়ন্তের স্পষ্ট স্বাক্ষর মিলছে।

তামাক কোম্পানিগুলো নগদ অর্থ, বীজ ও কৃষিসামগ্রী প্রদানের মোহে কৃষকদের বন্দী করছে। গোলাপ বা অন্যান্য বিকল্প ফসলের বাজার সমস্যাকে হাতিয়ার করে তারা তামাকের লাভগাথা প্রচার করছে, অথচ বাস্তবে কৃষকেরা ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ হচ্ছেন, জমির শক্তি বিলীন হচ্ছে। 

সরকারি প্রচারণা ও নীতিমালা যে যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না, তার পেছনে রয়েছে তামাক কোম্পানির দুর্ধর্ষ প্রভাববলয় এবং বিকল্প আয়ের সুনিশ্চিত পথের অভাব। এই সংকট নিরসনে সময়ক্ষেপণ আর বিলাসিতা নয়, চূড়ান্ত কর্তব্য। নদীর চর, বনভূমি ও সরকারি জমিতে অবিলম্বে তামাক চাষ নিষিদ্ধ করতে হবে; দখলদারি উচ্ছেদে সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনকে মাঠপর্যায়ে তদারকি জোরদার করতে হবে, কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি সংলাপ বাড়াতে হবে। 

একই সঙ্গে গোলাপ, শাকসবজি ও মসলাজাতীয় বিকল্প ফসলের চাষে নগদ সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও বিপণন সংযোগের নিরবচ্ছিন্ন ধারা নিশ্চিত করতে হবে। ফুলচাষিদের উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণের জন্য আধুনিক গুদাম এবং পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন। তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কৃষি ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব কল প

এছাড়াও পড়ুন:

পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে

অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।

১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’

এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।

পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।

পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)

সম্পর্কিত নিবন্ধ