দুই সপ্তাহেও ক্লাসে ফেরেননি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষকরা। লাঞ্ছনাকারীদের শাস্তির দাবিতে আজ সোমবার অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। এই আন্দোলনে একাত্মতা জানিয়ে অংশ নেয় শিক্ষার্থীদের একাংশ।

আজ দুপুর ১২টায় কুয়েটের শিক্ষকরা প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় উপাচার্যের কক্ষে গিয়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। কিছু সময় পর তারা প্রশাসনিক ভবনের নিচে আসেন এবং বেলা ১টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। শিক্ষকদের আন্দোলনস্থলে এসে একাত্মতা প্রকাশ করেন ১৯ ব্যাচের প্রায় ১০০ শিক্ষার্থী।

শিক্ষার্থী শাফতি আশারি, জিহাদ, ইউসুফ ও শিহাব বলেন, ‘আর এক মাস একাডেমিক কার্যক্রম চালু থাকলে আমরা পাস করে বেরিয়ে যেতাম। কিন্তু তিন মাস ধরে অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছি। আমরা চাই, দ্রুত ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হোক।’

তারা বলেন, ‘যারা শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করেছে, তাদের শাস্তি চাই। তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তার ভিত্তিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সঙ্গে আমরা একমত। তবে নিরপরাধ কেউ যেন শাস্তি না পায়।’

অন্যদিকে তিন মাস ধরে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী মো.

মহিরুজ্জামান উপল, সৈকত ও ঝলক জানান, তারা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী ও শিক্ষকদের লাঞ্ছনাকারীদের শাস্তি চান। কিন্তু অপসারিত উপাচার্যের সময়ে করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী নয়। নতুন করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির মাধ্যমে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা জানান, আপাতত তাদের কোনো কর্মসূচি নেই।

তারা আরও জানান, বিচার বিভাগীয় তদন্তে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী ও শিক্ষকদের লাঞ্ছনাকারী হিসেবে দোষী সাব্যস্তদের পক্ষে কেউ দাঁড়াবে না।

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. ফারুক হোসেন জানান, লাঞ্ছনাকারী শিক্ষার্থীদের শাস্তি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত তারা ক্লাস-পরীক্ষা নেবেন না। গত ৪ মে থেকে তারা ক্লাস বর্জন ও গত রোববার থেকে প্রশাসনিক কাজ বর্জন করছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মসূচির কথা আগেই উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হযরত আলীকে জানিয়েছিলাম। তিনি শিক্ষকদের না জানিয়ে ঢাকায় গেছেন। একজন শিক্ষককে উপাচার্যের রুটিন কাজ চালানোর জন্য মৌখিকভাবে বলেছেন। মঙ্গলবার ক্যাম্পাসে ফিরবেন।’

শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. সাহিদুল ইসলাম জানান, আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তারা প্রশাসনিক ভবনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বাইরে গিয়ে প্রশাসন দোষীদের বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে। এ কারণে কুয়েটের শিক্ষা কার্যক্রম সংকটের মধ্যে পড়েছে।

শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক পক্ষ শিক্ষকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। আর যারা বিভিন্ন দাবিতে গত তিন মাস আন্দোলন করেছে, তারা আপাতত চুপচাপ রয়েছে। কিছুটা চাপেও পড়েছে। এখন তারা কী করবে তা বুঝে উঠতে পারছেন না।

এ ব্যাপারে কুয়েটের ছাত্র কল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ ইলিয়াছ আক্তার বলেন, সংকট নিরসনের জন্য কুয়েট কর্তৃপক্ষ সাধ্যমতো চেষ্টা করছে।

প্রসঙ্গত, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংঘর্ষের জের ধরে কুয়েটে বন্ধ রয়েছে ক্লাস ও পরীক্ষা। তিন মাস অচলাবস্থা চলায় সেশনজট বেড়েছে। নতুন ব্যাচের ক্লাস এখনও শুরু হয়নি। ফলে বিপাকে পড়েছেন কুয়েটের ৭ হাজার ৫৬৫ জন শিক্ষার্থী।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ ক ষকদ র উপ চ র য তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

ব্রিটিশ ভারত থেকে হজযাত্রা

ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশে হজযাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক ঘটনা ছিল, যা বাষ্পীয় জাহাজের আগমনের সঙ্গে আরও সংগঠিত ও নিরাপদ রূপ লাভ করে। ব্রিটিশ সরকার এই যাত্রার ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা শুধু ধর্মীয় নয়, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

বাষ্পীয় জাহাজে

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাষ্পীয় জাহাজের বাণিজ্যিক চলাচল শুরু হলে হজযাত্রা আরও সহজ ও দ্রুততর হয়। ব্রিটিশ সরকার হজযাত্রী পরিবহনের দায়িত্ব দেয় সে সময়ের বিখ্যাত পর্যটন কোম্পানি টমাস কুককে। বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং মুসলিমদের ধর্মীয় ভ্রমণ নিরাপদ করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ প্রশাসন হজ এবং ইরাকের কারবালায় ভ্রমণের জন্য নিরাপদ জাহাজ ব্যবস্থার উদ্যোগ নেয়।

১৯২৭ সালে হজযাত্রার দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি হজ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি হজযাত্রীদের জন্য পরিবহন, থাকা-খাওয়া এবং অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করে।

মোগল শিপিং লাইনস ও হজযাত্রী পরিবহন

ভারতীয় সমুদ্রবন্দর থেকে হজযাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ‘মোগল শিপিং লাইনস’-এর। এই কোম্পানি, যার পূর্বনাম ছিল ‘বোম্বে অ্যান্ড পার্শিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি’, ১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাণিজ্যিক কার্যক্রমের পাশাপাশি এটি হজযাত্রীদের জেদ্দায় পরিবহনের দায়িত্ব পালন করে। ১৯২৭ সালে মোগল শিপিং লাইনস ২০ হাজার থেকে ৩৬ হাজার হজযাত্রী পরিবহন করে, এবং ১৯৩০ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ হজযাত্রী তাদের জাহাজে ভ্রমণ করে। বছরের ছয় থেকে সাত মাস ধরে এই কোম্পানির জাহাজ বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের হজযাত্রীদের লোহিত সাগরের জেদ্দা ও এডেন বন্দরে নিয়ে যেত।

বোম্বে থেকে জেদ্দায় যাত্রায় বাষ্পীয় জাহাজগুলো সাধারণত ১০-১২ দিন সময় নিত, যদিও অশান্ত সমুদ্র প্রায়ই যাত্রাকে চ্যালেঞ্জিং করে তুলত। এই জাহাজে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আশপাশের দেশের হজযাত্রীরাও ভ্রমণ করতেন।

আরও পড়ুনমদিনার হজ কার্যালয় যেন 'বাংলাদেশ'২২ জুন ২০২৪

মোগল শিপিং লাইনস তাদের একচেটিয়া ব্যবসার কারণে আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং কলকাতা বন্দর থেকে হজযাত্রী পরিবহন বন্ধ করতে ভারত সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এর প্রতিক্রিয়ায়, বিশেষ করে বাঙালি মুসলিমরা বিকল্প হিসেবে ভারতীয় মালিকানাধীন ‘সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি’কে পৃষ্ঠপোষকতা করে। সিন্ধিয়ার জাহাজ ‘আল মদিনা’ হজযাত্রীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়।

মোগল শিপিং লাইনস এবং সিন্ধিয়ার মধ্যে হজযাত্রী পরিবহন নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। উভয় কোম্পানি টিকিটের মূল্য কমিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চেষ্টা করে। সিন্ধিয়া প্রায় বিনা মূল্যে হজযাত্রী পরিবহন করে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অন্যদিকে মোগল শিপিং লাইনস বিনা মূল্যে পরিবহনের পাশাপাশি হজযাত্রীদের ছাতা এবং জমজমের পানি বহনের জন্য কনটেইনার উপহার দিত। এই প্রতিযোগিতা তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক মহলে আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে।

প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব স্যার মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খানের উদ্যোগে দুই কোম্পানির মধ্যে একটি সমঝোতা হয়, যেখানে হজযাত্রীপ্রতি সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ১১৫ রুপি। তবে মোগল শিপিং লাইনস এই সমঝোতা মেনে চলেনি এবং সিন্ধিয়ার তুলনায় কম ভাড়ায় হজযাত্রী পরিবহন অব্যাহত রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে হজযাত্রী পরিবহন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

আরও পড়ুনহজ করতে গিয়ে মক্কা মদিনায় হারিয়ে গেলে কী করবেন০৮ মে ২০২৪

ব্রিটিশ শাসনের পরে

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ভারত সরকার বিভিন্ন জাহাজ কোম্পানিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করে, এবং ১৯৬২ সালে মোগল শিপিং লাইনস ভারত শিপিং করপোরেশনের অংশ হয়ে যায়। ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রই হজযাত্রীদের জন্য পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলে।

পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮ সালে হজযাত্রী পরিবহনের জন্য ‘এম্পায়ার অরওয়েল’, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘সারধানা’, এবং মোগল লাইনসের ‘ইসলামি’ ও ‘মুহাম্মদি’ জাহাজ ভাড়া করে। এর মধ্যে ‘সারধানা’ চট্টগ্রাম ও করাচি বন্দর থেকে জেদ্দায় হজযাত্রী পরিবহন করত। ১৯৬০ সালে প্যান ইসলামিক স্টিমশিপ কোম্পানি চট্টগ্রাম ও করাচি থেকে হজযাত্রী পরিবহনের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

আরও পড়ুনমদিনার হজ কার্যালয় যেন 'বাংলাদেশ'২২ জুন ২০২৪

সমুদ্রপথ থেকে বিমানে

ভারত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বোম্বে-জেদ্দা রুটে ইন্ডিয়া শিপিং করপোরেশনের জাহাজ সার্ভিস ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চলে। এর পর থেকে বিমান হজযাত্রার প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। বিমানযাত্রার সহজলভ্যতা ও দ্রুততার কারণে সমুদ্রপথে হজযাত্রা ক্রমেই বিলুপ্ত হয়।

ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশে হজযাত্রা ছিল ধর্মীয়, সামাজিক ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। টমাস কুকের মতো এজেন্ট, হজ কমিটি এবং মোগল শিপিং লাইনসের মতো জাহাজ কোম্পানিগুলো এই যাত্রাকে সংগঠিত ও নিরাপদ করতে অবদান রাখে। মোগল শিপিং লাইনস এবং সিন্ধিয়ার প্রতিযোগিতা হজযাত্রীদের জন্য ভাড়া কমালেও ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণ হয়। কালের পরিক্রমায় সমুদ্রপথের পরিবর্তে বিমানযাত্রা হজযাত্রার প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে, তবে ব্রিটিশ আমলের এই ঐতিহ্য ইতিহাসের একটি অমূল্য অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে।

আরও পড়ুনবিরে শিফা: একটি অলৌকিক কুয়ার গল্প০৫ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ