জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে (১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট) ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৯৫ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র সাতজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিবর্ষণের তথ্য দিয়েছেন।

ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়ের নথি পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তকাজে সহায়তায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয় এই নথি পাঠায়।

নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৯৫ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের মধ্যে সাতজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজেদের আওতাধীন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিবর্ষণের তথ্য দিয়েছেন। অন্যরা ‘গুলিবর্ষণ হয়ে থাকলে সংখ্যা, অস্ত্রের ধরন’-সংক্রান্ত তথ্যে ‘না’ উল্লেখ করেছেন।

যে সাতজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গুলিবর্ষণের তথ্য দিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের দাবি, তাঁরা গুলিবর্ষণের অনুমতি দেননি। ঘটনার কয়েক দিন পর তাঁদের কাছ থেকে গুলিবর্ষণের অনুমতিসংক্রান্ত কাগজে সই নেওয়া হয়। আর তখন সই না দিয়ে তাঁদের কোনো উপায় ছিল না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর অনুমতি ছাড়াই দায়িত্বের আওতাধীন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলির ঘটনা ঘটেছিল। তবে এতে কোনো আহত-নিহত ছিল না। ঘটনার দিন কয়েক পরে তিনি গুলির অনুমতির কাগজে সই করেছিলেন।

আরেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলন চলাকালে তিনি দুই দিন দায়িত্ব পালন করেছেন। গুলিবর্ষণের অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

উল্লিখিত পাঁচজনের বাইরে আরেকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নথিতে নাম থাকলেও আন্দোলন চলাকালে তিনি মাঠে ছিলেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর আহমেদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি ফোন ধরেননি। তাঁর মুঠোফোন খুদে বার্তা পাঠালে সাড়া দেননি।

হাজারো গুলি

ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়ের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা সাত ধরনের তথ্য চায়।

যেসব তথ্য চাওয়া হয়, সেগুলো হলো, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নাম ও পরিচিতি নম্বর। কর্তব্যে নিয়োজিত হওয়ার তারিখ, সময় ও স্থান। গুলিবর্ষণ হয়ে থাকলে সংখ্যা ও অস্ত্রের ধরন। অস্ত্র ব্যবহারকারী সদস্যের নাম ও পরিচিতি। হতাহত হয়ে থাকলে তার বিবরণ। নির্বাহী তদন্ত হয়ে থাকলে তার প্রতিবেদনের অনুলিপি। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়ের নথিতে ১ হাজার ১৩২টি গুলি ছোড়ার তথ্যের উল্লেখ আছে। তবে হতাহত হওয়ার কোনো তথ্য নেই।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একটি সূত্র বলছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে ডিএমডির বিভিন্ন থানায় করা ২৮টি মামলার এজাহারে ৪ দিনেই প্রায় ২৫ হাজার গুলি ছোড়ার তথ্য পাওয়া যায়।

ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়ের নথির তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে রামপুরা এলাকায়। বাকি গুলির ঘটনা ঘটেছে যাত্রাবাড়ী, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, বিজয় সরণি ও সংসদ ভবন এলাকায়। এসব স্থানে যাঁরা গুলি করেছেন, তাঁদের নাম নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। গুলির ধরন হিসেবে উল্লেখ আছে এসএমজি ও আরএফএল।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ডিএমপির একটি থানায় দায়িত্ব পালককারী ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ১৮ জুলাই থেকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এরপরই পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ম প রক শ ন প রথম আল ক ন এল ক য় উল ল খ তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

জনসাধারণের সমস্যা নিয়ে সরকার কতটা চিন্তিত

গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের পর যখন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের আশা ছিল, দেশে স্থিতিশীলতা ও স্বস্তি ফিরে আসবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক পরিচিতি, অরাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল সহজ-সরল ও বাস্তবঘনিষ্ঠ: হয়তো জীবন কিছুটা সহজ হবে। বাস্তবে সে প্রত্যাশার ফল মিলছে না।

দেশের জনসাধারণের প্রতিদিনের বাস্তবতা– খাবার জোগাড়, বাসা ভাড়া, সন্তানের পড়ালেখা, অসুখ হলে চিকিৎসা, মাস শেষে ধার না করে চলার চেষ্টা। এসবই তাদের জীবনের মুখ্য বিষয়; শহর-পল্লি নির্বিশেষে। কোথাও হয়তো বাসা ভাড়ার প্রশ্নটি নেই; আছে অন্যান্য খরচের বিষয়। লেখাপড়ার কারণে বাড়ি থেকে দূরে থাকা সন্তানের হোস্টেল বা মেস ভাড়া দেওয়ার চিন্তা।

এমন বাস্তবতায় আম জনতা রাজনীতিতে সরাসরি আগ্রহ না দেখালেও রাজনীতির যে কোনো পট পরিবর্তন তাদের জীবনে প্রবল প্রভাব ফেলে। গত এক বছরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আয় না বাড়া, খরচের চাপ মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন আরও সংকটময় হয়ে উঠেছে। টিসিবির পণ্যের লাইনে ভিড় বেড়েছে, অথচ স্বস্তির আশা কমেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত তিনটি লক্ষ্য– সংস্কার, বিচার এবং অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন রাজনৈতিক দলগুলোরও দাবি। সাধারণ মানুষও এগুলোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। কিন্তু এসব উদ্যোগ তাদের জীবনের বাস্তব সংকট দূর করার সঙ্গে কতটা যুক্ত– তা নিয়ে এখন সংশয় তৈরি হয়েছে। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পার হয়েছে, কিন্তু স্বস্তির দেখা মেলা ভার।

দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য ক্রেতার নাগালে নিয়ে আসা, কর্মসংস্থানের সুযোগ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন– এসব বিষয়ে জনগণ যে ধরনের অগ্রগতি দেখতে চেয়েছিল, তা হচ্ছে না। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের বড় তিনটি কাজের ঘোষণা সাধারণ মানুষের কাছে ‘বিমূর্ত ছবি’ হয়ে উঠছে। আম জনতার প্রাথমিক চাওয়া– নিরাপদ জীবন, শান্তিতে ঘুমানো, সঞ্চয়ের সামান্য সুযোগ, আত্মমর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকা। এই মৌলিক প্রয়োজনগুলো পূরণেও যদি সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন কেবল রাজনৈতিক শব্দ হয়েই থাকবে।

১২ মাসের মাথায় দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে বলা যায়– অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো স্বচ্ছতা ও নিয়মিত জনসংযোগের অভাব। শুরু থেকেই যদি সরকারের পক্ষে প্রতি সপ্তাহে কিংবা অন্তত ১৫ দিন অন্তর জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়া হতো; তাদের কাজের অগ্রগতি, উদ্দেশ্য এবং সাধারণ মানুষের জীবনে সরকারের কাজের প্রভাব ব্যাখ্যা করা হতো; তাহলে অনিশ্চয়তা, গুজব ও ভুল ব্যাখ্যার জায়গা তৈরি হতো না।

পাশাপাশি আরেকটি সংকট জনমানসে জায়গা করে নিচ্ছে। সরকার যেন কেবল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর দাবি পূরণেই বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছে। এতে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিশেষত বেসরকারি খাত, খেটে খাওয়া, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ নিজেদের বঞ্চিত মনে করছে। এ বঞ্চনা থেকে তৈরি হচ্ছে গভীর বিচ্ছিন্নতাবোধ, যা দীর্ঘস্থায়ী হলে সরকারের জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে এখন সবচেয়ে জরুরি সরকারের এমন একটি রোডম্যাপ, যা জনগণের মৌলিক চাহিদার প্রতিফলন ঘটায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মসংস্থানমুখী আর্থিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখানো না গেলে সংস্কার-বিচার-নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি অর্থহীন হয়ে যাবে। এমনিতেই এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশের অন্যতম বৃহত্তম আবাসন খাত স্থবির হয়ে পড়ায় সংশ্লিষ্ট শিল্পকারখানা ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ লক্ষাধিক মানুষের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। টাকার হাতবদল কমে যাওয়ায় স্থবির হয়ে পড়েছে কর্মসংস্থানের অন্যান্য খাত। এ নিয়ে সরকারের দিক থেকে কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।  

অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন যা করতে হবে: জনগণের বাস্তব সমস্যার সঙ্গে সরকারের পরিকল্পনাকে যুক্ত করা; আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দৃঢ় পদক্ষেপ এবং মানুষের অর্থনৈতিক কষ্ট লাঘবে কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকৃত সাফল্য বিচার হবে এই প্রশ্নে– সাধারণ মানুষের কতটা পাশে দাঁড়িয়েছে; তাদের কতটা শোনার চেষ্টা করেছে এবং তাদের কতটা মর্যাদা দিয়েছে।

জনগণ বড় বড় প্রতিশ্রুতি চায় না। তারা চায় দেশের সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন আয়োজনের আড়ালে যেন তাদের বেঁচে থাকার মতো জীবন বিনষ্ট বা বিপর্যস্ত না হয়। তারা চায় যেন বেঁচে থাকার মতো পরিবেশ বহাল থাকে। যেখানে খাদ্যের নিশ্চয়তা থাকবে, শোনার মতো সরকার থাকবে এবং সম্মান নিয়ে বাঁচার সুযোগ থাকবে। যদি সরকার সেই মৌলিক মানবিক শর্তগুলোও পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে নির্বাচনের আগে সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি হতে পারে। কারণ জনগণ যদি পাশে না থাকে, তাহলে কোনো সরকারই টিকতে পারে না। সেটা অন্তর্বর্তী হোক বা নির্বাচিত।

মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আর কতদিন আইনহীনতায় বসবাস
  • এ. কে. আজাদের বাড়িতে মিছিল নিয়ে চড়াও হওয়ার ঘটনায় গণসংহতি আন্দোলনের ক্ষোভ
  • এ. কে. আজাদের বাড়িতে চড়াও হওয়ার ঘটনায় গণসংহতি আন্দোলনের ক্ষোভ
  • ‌‘মব’ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা অন্তর্বর্তী সরকারের বিশাল ব্যর্থতা: গণসংহতি আন্দোলন
  • আইনশৃঙ্খলার অবনতি স্পষ্ট
  • অব্যাহত ‘মব সন্ত্রাস’ করে বিচার-সংস্কার ও নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস চলছে: বাম গণতান্ত্রিক জোট
  • ঢাকাসহ সারা দেশে গত এক সপ্তাহে যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক ৩৮০
  • জনসাধারণের সমস্যা নিয়ে সরকার কতটা চিন্তিত
  • আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিই, ‘রক্ত মাড়িয়ে সংলাপ নয়’: হাসনাত আবদুল্লাহ