‘কর্ণাটকের সমাজ বাস্তবতাই আমাকে গড়ে তুলেছে’– বানু মুশতাক আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার ২০২৫ বিজয়ী ‘হার্ট ল্যাম্প’ গ্রন্থের ১২টি গল্পে বানু মুশতাক দক্ষভাবে তুলে ধরেছেন দক্ষিণ ভারতের মুসলিম নারীদের দৈনন্দিন জীবন ও অভিজ্ঞতা। ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কন্নড় ভাষায় প্রকাশিত এই গল্পগুলোতে বাস্তবের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, সেখানে রসবোধ ছিল প্রশংসিত। পরিবার ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে নারীর দ্বন্দ্বের চিত্র যেমন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, তেমনি তা বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল বুকার সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেছে। এটি এমন একটি সংগ্রহ, যা বহু বছর পাঠকদের হৃদয়ে থাকবে। বুকার কর্তৃপক্ষের নেওয়া এই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন শাহেরীন আরাফাত
১.


‘হার্ট ল্যাম্প’-এর পেছনের অনুপ্রেরণা এবং আমার লেখার ধরন

বানু মুশতাক: আমার গল্পগুলো নারীদের সম্পর্কে– কীভাবে ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি তাদের কাছ থেকে প্রশ্নাতীত আজ্ঞাবহতা দাবি করে; আর এভাবে অমানবিক নিষ্ঠুরতা চালানোর মধ্য দিয়ে তাদের কেবল অধীন করে তোলে। দৈনন্দিন সংবাদ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই আমার লেখার মূল অনুপ্রেরণা। নারীদের বেদনা, কষ্ট ও অসহায়ত্ব আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে– এটাই আমার লেখার প্রেরণা।

‘হার্ট ল্যাম্প’ সংগ্রহের গল্পগুলো ১৯৯০ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে লেখা ছয়টি সংকলনের ৫০টির মতো গল্প থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে। সাধারণত প্রথম খসড়ার পরই দ্বিতীয়টি চূড়ান্ত রূপ নেয়। আমি লেখার আগে তেমন গবেষণা করি না; হৃদয়ই আমার সবচেয়ে বড় পাঠশালা। যে ঘটনা হৃদয়ে গভীরভাবে নাড়া দেয়, সেটাই আমার কলমে হয়ে ওঠে সবচেয়ে আবেগময়।

আমাকে পড়ার প্রতি আকৃষ্ট করা বই

বানু মুশতাক: একক কোনো বইয়ের নাম না নিয়ে বলব, অসংখ্য বইয়ের প্রভাব আমার ওপর আছে। ছোটবেলায় হাতেখড়ি হওয়ার পর থেকেই আমি লিখতে শুরু করি।
যে বই আমাকে লেখক হতে সাহায্য করেছে বানু মুশতাক: ১৯৭০-এর দশকে কর্ণাটকের আন্দোলনগুলো– দলিত আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, নারীর সংগ্রাম, পরিবেশ আন্দোলন ও থিয়েটার চর্চা– আমার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বঞ্চিত সম্প্রদায় ও নারীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। কর্ণাটকের সমাজ বাস্তবতাই আমাকে গড়ে তুলেছে।

যে বই আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে

বানু মুশতাক: নির্দিষ্ট একটি বই নয়, বরং বহুমাত্রিক পাঠ ও অভিজ্ঞতাই আমার সাহিত্যজীবনে রং এনেছে।

২.

‘হার্ট ল্যাম্প’ অনুবাদের অনুপ্রেরণা ও পদ্ধতি

দীপা ভাস্তি: আমার জন্য অনুবাদ একটি স্বাভাবিক কাজ এবং প্রতিটি বই আলাদা পদ্ধতি দাবি করে। বানু মুশতাকের গল্পগুলো পড়ার আগে আমি তাঁর প্রকাশিত সব কথাসাহিত্য পড়েছি। পরে ‘হার্ট ল্যাম্প’-এর গল্পগুলো বেছে নিলাম। গল্প বাছাই ও কাজ করার ক্ষেত্রে আমাকে পুরো স্বাধীনতা দিয়েছিলেন বানু মুশতাক, যা আমি পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছি।গল্পগুলোর যে সমাজপ্রেক্ষিত, সে সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত ছিল– এ বিষয়ে আমি সচেতন থেকেছি। তাই আমি নিজেকে সেই সমাজবাস্তবতা ও শিল্পরুচির গভীরে ডুবিয়ে রাখতাম। প্রথম খসড়া করার সময় আমি পাকিস্তানি টিভি নাটক; নুসরাত ফতেহ আলি খান, আলি শেঠি, আরজ আফতাবের গান শুনতাম; এমনকি উর্দু লিপি শেখার ক্লাসও করেছি। এসব কিছু আমাকে গল্প এবং ভাষার গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছে।

আমাকে পড়তে অনুপ্রাণিত করা বই

দীপা ভাস্তি: জীবনভর আমি বইয়ের সঙ্গেই থেকেছি। তবে কোনো একক বই সেভাবে আগ্রহ সৃষ্টি করেনি। আমার দাদি; যিনি আমাদের সঙ্গে থাকতেন, তিনিই আমাকে গল্পের প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন। দিনে দু-তিনটি গল্প বলতেন; অনুরোধ করলে শুনিয়ে দিতেন আরও অনেক গল্প। গল্প বলার সময় তিনি চরিত্রগুলোর কণ্ঠস্বর, অঙ্গভঙ্গি ও ভাষা অনুকরণ করতেন। আমি মুগ্ধ হতাম, এখনও সেই স্মৃতিতে মুগ্ধ হই। তিনিই আমাকে লেখক এবং অনুবাদক হিসেবে গল্প বলিয়েছেন। আমি চেয়েছি, পাঠকও যেন সেই বিস্ময় ও মুগ্ধতা অনুভব করেন, যেমনটা আমি দাদির গল্পে অনুভব করতাম। আমি চাই লেখার মাধ্যমে সেই জাদুকরি প্রভাবটা সৃষ্টি করতে, যেটা তিনি নিঃসন্দেহে তাঁর হাত, মুখ আর শরীরের অভিব্যক্তি দিয়ে করে যেতেন।

যে অনুবাদকের কাজ আমি সব সময় অনুসরণ করি

দীপা ভাস্তি: জয়শ্রী কালাথিল, যিনি মালায়লাম থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। বিশেষ করে নবীন লেখকদের যেসব বই তিনি অনুবাদ করেছেন, তাতে সব সময়ই রূপ ও শৈলীর নতুনত্ব খুঁজে পাই। তাঁর অনুবাদ শৈলী থেকে আমি সব সময় কিছু না কিছু নতুন শিখি।

এখন আমি যা পড়ছি

দীপা ভাস্তি: আমি সব সময় কুভেম্পুর কোনো না কোনো বই পড়ি। তিনি কন্নড় সাহিত্যে শেকসপিয়র, অস্টেন বা উল্ফের মতো। এবার আমি তাঁর মহান কাব্যিক উপন্যাস ‘মালেগালালি মাধুমাগালু’ ফের পড়ছি, যা আমার মতে কন্নড় সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপন করেছে। সম্প্রতি ভানামালা বিষ্ণুয়াথার করা গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আমি এখন মোহাম্মদ আল-কুর্দের ‘পারফেক্ট ভিকটিমস অ্যান্ড দ্য পলিটিকস অব আপিল’ পড়া শুরু করেছি, যা অবশ্যই অসাধারণ ও সময়োপযোগী।

একটি আরবি ফিকশন, যা আমি ইংরেজি পাঠকদের পড়ার জন্য সুপারিশ করব

দীপা ভাস্তি: ২০১৪ সালে যখন আমি মাহমুদ দারবিশের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হই, তখন থেকে আমি আরবি সাহিত্যে মুগ্ধ। আমি ঘাসান জাকতান ও নাগুইব মাহফুজের সব ইংরেজি অনুবাদ পড়েছি। যদি একটিকেই বেছে নিতে বাধ্য করা হয়, তাহলে সেটি হবে জাব্বুর ডুয়ারিহির ‘ফায়ারফ্লাই’; যা পাউলা হায়দার ও নাদিন সিনো অনুবাদ করেছেন। এটি ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে বৈরুত শহরের গল্প, যেখানে লেবাননের গৃহযুদ্ধের মাঝে এক যুবকের কলেজ, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও আপাত স্বাভাবিক জীবনের সন্ধান উঠে এসেছে। আগুনের পোকার প্রতীক ব্যবহার করে ডুয়ারিহি শব্দ আর অনুভব দিয়ে বৈরুতের এক অসাধারণ চিত্র এঁকেছেন। বৈরুত আমার প্রিয় শহর হওয়ায় বইটি আমার জন্য আরও বিশেষ।

আন্তর্জাতিক বুকার মনোনীত বই, যা সবার পড়া উচিত

দীপা ভাস্তি: রবার্ট সিথলারের ‘আ হোল লাইফ’, অনুবাদ করেছেন শার্লট কলিন্স– আমার প্রিয় বইগুলোর একটি। উপন্যাসের নীরবতায় সাধারণ মানুষের সৌন্দর্য এত সুন্দরভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, যা আমাকে মুগ্ধ করে।

কেন নতুন প্রজন্ম ইংরেজি ভাষার অনূদিত উপন্যাসে আকৃষ্ট?

দীপা ভাস্তি: আমার মনে হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব এখানে বড় ভূমিকা রাখে। ৩৫ বছরের কম বয়সী অনেকেই পুরো জীবনটাই প্রায় অনলাইনে কাটিয়েছেন। হয়তো এ কারণে তারা বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির সাহিত্য গ্রহণে বেশি মুক্ত। এ ছাড়া অনূদিত সাহিত্য নাকি মানুষকে আরও স্মার্ট ও আকর্ষণীয় করে তোলে– অন্তত কোরীয় সাহিত্যের খ্যাতিমান অনুবাদক অ্যান্টন হুরের মতে। আর আজকের তরুণরা– কে না চায় এমন স্মার্ট ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে? v
সূত্র : দ্য বুকার প্রাইজেস
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব ক র প রস ক র সব সময় ই আম র ত ই আম প রক শ ই আম ক ম শত ক অন প র

এছাড়াও পড়ুন:

জরিপের ভুলে বিলীনের ঝুঁকিতে দেড় শ পাহাড়

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বড় দিঘির পাড় থেকে ভাটিয়ারী যাওয়ার সংযোগ সড়ক ধরে কিছু দূর এগোলেই ৩ নম্বর বাজার। হাটহাজারী উপজেলার এই বাজার পেরোতেই সড়কের পশ্চিম পাশে ৫০ থেকে ৬০ ফুট উচ্চতার একটি পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে আধা পাকা কিছু বসতঘর। ফটক দিয়ে উঁকি দিতেই দেখা গেল বসতি সম্প্রসারণের জন্য কাটা হচ্ছে পাহাড়ের পাদদেশ।

খালি চোখে বিশাল পাহাড় দেখা গেলেও ৩ নম্বর বাজার এলাকার এই পাহাড়কে বাংলাদেশ সার্ভে বা বিএস জরিপে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে ‘নাল’ জমি হিসেবে। স্থানীয় ভূমি কার্যালয়ে যোগাযোগ করে জানা গেল, জঙ্গল দক্ষিণ পাহাড়তলী মৌজার বিএস ৩৫৭৩ নম্বর দাগে থাকা পাহাড়টির আয়তন প্রায় সাড়ে ৭ একর। বিএস জরিপে ভুলবশত ব্যক্তিমালিকানাধীন এই পাহাড়টিকে নাল শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদিও নাল বলতে সাধারণত নিচু সমতল কৃষিজমিকে বোঝায়।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিশাল পাহাড়টির পাদদেশে বেশ কিছু বসতি গড়ে উঠেছে। পাহাড়টির ওপর বড় কোনো গাছপালা নেই। তবে ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। পাহাড়ের কিছু অংশে মাটি ধসে পড়ছে। ভূমি কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ার পাহাড়ের অন্তত ১৬০ শতক টিলা শ্রেণির জমিকে ‘নাল’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে বিএস জরিপে।

চট্টগ্রাম নগর এবং এর পাশের দুই উপজেলা হাটহাজারী ও সীতাকুণ্ডে দেড় শতাধিক পাহাড়-টিলাকে বিএস জরিপে ভুলভাবে শ্রেণিভুক্ত করার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব পাহাড়-টিলার জমির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৪০০ একর। তবে ১৯৭০ সালে জরিপ শুরুর সময় কত পরিমাণ জমির পাহাড়-টিলা এমন ভুলভাবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছিল এবং কাটা হয়েছিল, সে হিসাব পাওয়া যায়নি। কোথাও এসব পাহাড়-টিলার পুরোটাই, কোথাও আবার অংশবিশেষকে ‘শণখোলা’, ‘নাল’, ‘খিলা’, ‘বাড়ি’ ইত্যাদি শ্রেণিতে নথিভুক্ত করা হয়েছে। সরকারি জরিপের এমন ভুলের সুযোগ নিয়ে চলছে পাহাড়-টিলা কেটে স্থাপনা নির্মাণ।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য অনুযায়ী, বিএস জরিপ শুরু হয় ১৯৭০ সালে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে (সংশোধিত) বলা হয়েছে, পাহাড় ও টিলা বলতে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট পার্শ্ববর্তী সমতল ভূপৃষ্ঠ থেকে উঁচু মাটি অথবা মাটি ও পাথর অথবা পাথর অথবা মাটি ও কাঁকড় অথবা অন্য কোনো কঠিন পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত স্তূপ বা স্থান এবং সরকারি রেকর্ডপত্রে পাহাড় বা টিলা হিসেবে উল্লিখিত ভূমিকে বোঝায়।

ভূমি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে শণ নামক উদ্ভিদ জন্মায়, সেটিকে শণখোলা বলা হয়। অকর্ষিত বা পতিত জমিকে বলা হয় খিলা।

পাহাড়টির ওপর বড় কোনো গাছপালা নেই। তবে ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। পাহাড়ের কিছু অংশে মাটি ধসে পড়ছে। ভূমি কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ার পাহাড়ের অন্তত ১৬০ শতক টিলা শ্রেণির জমিকে ‘নাল’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে বিএস জরিপে।শ্রেণীকরণের ভুলে যে ক্ষতিবিএস জরিপে ‘শণখোলা’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত পাহাড় কেটে প্লট বিক্রি করা হচ্ছে। গত সোমবার চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম খুলশীর রূপসী পাহাড় এলাকায়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জরিপের ভুলে বিলীনের ঝুঁকিতে দেড় শ পাহাড়