কক্সবাজারে বাড়ির আঙিনায়ও বসছে তামাকের চুল্লি, কাজ করছে শিশুরাও
Published: 29th, May 2025 GMT
কক্সবাজার শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে রামুর দুর্গম গর্জনিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম বোমাংখিল গ্রাম। চলতি মৌসুমে গ্রামের অন্তত ৭০০ একর ফসলি জমিতে তামাকের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে গ্রামে স্থাপন করা ৪৫টি চুল্লিতে তামাকপাতা পোড়ানো শুরু হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও নেই এসব চুল্লির। বনাঞ্চলের কাঠ পুড়িয়ে এসব চুল্লিতে তামাক উৎপাদন করা হচ্ছে। কেবল তা–ই নয়, এসব তামাক উৎপাদনের চুল্লির ৭০ শতাংশ শ্রমিকই নারী ও শিশু।
গত সোমবার দুপুরে গর্জনিয়া ইউনিয়নের বোমাংখিল গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির আঙিনায় স্থাপন করা একটি চুল্লিতে তামাকপাতা পোড়ানো হচ্ছে। বাড়িটি নুরুল ইসলাম নামের এক তামাকচাষির, চুল্লিটিও তাঁর। চুল্লির পাশে পড়ে আছে কাঠের স্তূপ। পাশের মাঠে রোদে শুকানো হচ্ছে তামাকপাতা। কয়েকজন শ্রমিক চুল্লিতে তামাকপাতা পোড়ানোর কাজে ব্যস্ত। শ্রমিকদের মধ্যে কয়েকটি শিশুও আছে। চুল্লির আরেক পাশে অবস্থিত তামাকখেতে তামাকপাতা কাটছিলেন দুজন নারী। আলাপ করতে চাইলে তাঁদের একজন বলেন, সকাল সাতটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত গাছ থেকে তামাকপাতা কাটতে হয়। মজুরি পাওয়া যায় ৫০০-৬০০ টাকা। তামাকের তাজা রস হাতে লাগলে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, চামড়া উঠে যায়। চর্মরোগ হয়, সব সময় চুলকাতে থাকে। এলাকায় আয়রোজগারের কাজ নেই বলে তামাকপাতা কাটতে হচ্ছে।
চুল্লির মালিক নুরুল আবছার (৪৫) ছয় বছর ধরে তামাক চাষ করছেন। আগে চুল্লিটি বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি ছিল, আগুনে পুড়ে চুল্লির বেড়া নষ্ট হয় বলে তিন মাস আগে ইট দিয়ে স্থায়ী চুলা তৈরি করেছেন। ১৫-২০ দিন ধরে এখানে তামাকপাতা পোড়ানো হচ্ছে। এই পাতা বিভিন্ন তামাক কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হবে।
কেবল বোমাংখিল নয়, গর্জনিয়া ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামেই এমন চুল্লি আছে। সব মিলিয়ে ৮০০টির বেশি বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পরিবেশবিষয়ক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা জানান। বিষয়টি স্বীকার করেছে বন বিভাগও। বনকর্মীদের দেওয়া তথ্যমতে, রামুর গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, ঈদগড়, কাওয়ারখোপ, ফতেখাঁরকুল এবং পার্শ্ববর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর, সোনাইছড়ি দোছড়ি, বাইশারী ইউনিয়নে চুল্লি আছে তিন হাজারের বেশি। এর বাইরে কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, ঈদগাঁও ও উখিয়া উপজেলাতে চুল্লি আছে আরও অন্তত দুই হাজার। সর্বমোট পাঁচ হাজার চুল্লিতে তামাকপাতা পোড়ানো হয় বনাঞ্চলের কাঠ দিয়ে। চলতি মৌসুমে এসব অঞ্চলে তামাকের চাষ হয়েছে ১২ হাজার একরের বেশি জমিতে।
কক্সবাজারের রামুর গর্জনিয়া ইউনিয়নে তামাকপাতা পোড়ানোর জন্য চুল্লিতে মজুত কাঠের স্তূপ। সম্প্রতি তোলা.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।