রেলব্যবস্থায় দুর্নীতি ও অনিয়মের যে দীর্ঘ চর্চা চলমান, চট্টগ্রাম স্টেশনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাম্প্রতিক অভিযান তারই আরেকটি পরিচিত পুনরাবৃত্তি হিসেবে ধরা দিয়েছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, সেখানে দুদক কালোবাজারে টিকিট বিক্রির অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। দুদক বলেছে, এর সঙ্গে সরাসরি রেলকর্মীরা জড়িত।

স্টেশনের বুকিং সহকারী থেকে শুরু করে নিরাপত্তাকর্মী পর্যন্ত টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত থাকার বহু প্রমাণ নানা সময়ে সামনে আসে। সর্বশেষ ঘটনায় দুদক চট্টগ্রাম স্টেশনে ১৯০ টাকার টিকিট ৩০০ টাকায় বিক্রির প্রমাণ পেয়েছে। তারা এ ঘটনায় জড়িত রেলকর্মীদের হাতেনাতে ধরেছে। তাঁদের হাতে যে টিকিট থাকার কথা নয়, সে টিকিট পাওয়া গেছে। তাঁদের সঙ্গে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের যোগসাজশও উদ্‌ঘাটিত হয়েছে।

প্রশ্ন জাগে—এই টিকিট কোথা থেকে আসে, কাদের অনুমোদনে তা বণ্টিত হয় আর কারা এই প্রক্রিয়ায় মৌন সম্মতি দিয়ে থাকেন? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের অতি অপ্রীতিকর সত্যের মুখোমুখি হতে হয়। রেলব্যবস্থায় দুর্নীতির শিকড় যে গভীর এবং তা যে প্রশাসনিক কাঠামোর প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে আছে, সেটি তখন জনসমক্ষে চলে আসে।

বাস্তবতা হলো যাত্রীসাধারণের জন্য ট্রেনের টিকিট পাওয়া আজ দুরূহ হয়ে উঠেছে। রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘কাউন্টারে তদারক করে কিছুই পাননি’। দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তার কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য আমরা আশা করতে পারি না। এতে বরং টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আশকারা পান।

আমরা মনে করি, দুদক প্রাথমিকভাবে যেসব অনিয়ম উদ্‌ঘাটন করেছে, তা পরিপূর্ণ চিত্র নয়। এটি বরং বৃহত্তর দুর্নীতির প্রান্তচ্ছেদ। কালোবাজারি শুধু অর্থনৈতিক অপরাধ নয়, এটি রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যকার আস্থাবন্ধকে ভেঙে দেওয়ার এক ভয়াবহ প্রক্রিয়া। একবার যদি রাষ্ট্রীয় সেবাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ মানুষের আস্থা বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে সে ক্ষয় পুনরুদ্ধার দুরূহ।

রেলব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের সময় এসেছে। প্রথমত, রেল টিকিট বিতরণে প্রযুক্তিনির্ভর স্বচ্ছ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে কোনোভাবেই ‘মনুষ্যসৃষ্ট ফাঁক’ দুর্নীতির সুযোগ করে না দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, টিকিটের মজুত, বিতরণ ও বিক্রির প্রতিটি স্তরকে তদারকির আওতায় এনে স্বয়ংক্রিয় নিরীক্ষা চালু করতে হবে। তৃতীয়ত, যাঁরা দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শুধু নিম্নপদস্থ কর্মী নয়, বরং প্রশাসনিক উচ্চপদস্থদের ভূমিকাও খতিয়ে দেখতে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

চট্টগ্রামে বছর শেষে বাড়ছে ডেঙ্গু, কমেছে চিকুনগুনিয়া

চট্টগ্রামে বছরের শেষে এসে আবারও বাড়ছে ডেঙ্গুর সংক্রমণ। চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম দুই দিনেই ৮৭ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। গতকাল রোববার বেলা একটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৪১ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। গত বছরও এই সময়ে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েছিল। এদিকে বছরের শেষ দিকে এসে চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ কমেছে। গতকাল ২৪ ঘণ্টায় চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল শূন্য।

ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া—দুটিই মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ। দুটিই এডিস মশার কামড়ে হয়। এডিসের বংশ বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে বৃষ্টি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, নভেম্বরের শুরুতে লঘুচাপের কারণে বৃষ্টি হতে পারে। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

চট্টগ্রামে বছরের শুরু থেকে গতকাল বেলা একটা পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৯২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে গত অক্টোবর মাসে। পুরো জেলায় ওই মাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৯৯০ জন। এর আগের মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ৯৩৫। চলতি নভেম্বর মাসে এ সংখ্যা নির্ভর করছে বৃষ্টির ওপর। কারণ, শীত শুরু হলে এডিসের বংশবৃদ্ধির আশঙ্কা কম। তবে বৃষ্টি হলে সেটি বাড়তে পারে।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে সর্বশেষ মৃত্যু গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এদিন বেলা সাড়ে তিনটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জয় তারা (১৬) নামের এক কিশোরীর মৃত্যু হয়। এ নিয়ে চলতি বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নিহতের সংখ্যা ২০।

এদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত কমেছে। গতকাল পর্যন্ত জেলায় চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৬৯। তবে চিকুনগুনিয়ায় মাসভিত্তিক তথ্য দেয়নি সিভিল সার্জন কার্যালয়। যদিও প্রতিদিনের আক্রান্তের হিসাব দেয় তারা। প্রাথমিক হিসাবে, গত সেপ্টেম্বর মাসে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭০৪। গত অক্টোবর মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১২১ জন। এ মাসে কেবল একজন।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে সর্বশেষ মৃত্যু গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এদিন বেলা সাড়ে তিনটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জয় তারা (১৬) নামের এক কিশোরীর মৃত্যু হয়। এ নিয়ে চলতি বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নিহতের সংখ্যা ২০।

এদিকে গত বছরের তুলনায় এ বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অবস্থা গুরুতর। তাঁদের উপসর্গগুলোও কিছুটা ভিন্ন বলে জানা গেছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ৪১ জন রোগী জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩ জন ভর্তি হয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসে (বিআইটিআইডি) এবং ১২ জন ভর্তি হয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

আমাদের হাসপাতালে ১৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। ডায়রিয়া ও বমি হলো ডেঙ্গু ওয়ার্নিং সাইন (সতর্ক সংকেত)। এগুলো দেখলে বোঝা যায় রোগীর অবস্থা গুরুতর হচ্ছে।এ এস এম লুৎফুল কবির, মেডিসিন বিভাগের প্রধান, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট দেখা গেছে। তবে এ বছর যাঁরা আসছেন, তাঁদের মধ্যে শক সিনড্রোম বেশি। পাশাপাশি ডায়রিয়ার উপসর্গও আছে। শক সিনড্রোম হলে রোগীর রক্তচাপ বোঝা যায় না। এই দুটি উপসর্গ গুরুতর। কারণ, সময়মতো ফ্লুইড (তরল খাবার) না পেলে রোগীর অবস্থা আরও গুরুতর হতে পারে।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান এ এস এম লুৎফুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ১৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। ডায়রিয়া ও বমি হলো ডেঙ্গু ওয়ার্নিং সাইন (সতর্ক সংকেত)। এগুলো দেখলে বোঝা যায় রোগীর অবস্থা গুরুতর হচ্ছে।’

চলতি বছর এপ্রিল থেকে মোটামুটি বৃষ্টি হচ্ছে। জুনে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হলেও পরের মাসগুলোয় স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়। আর থেমে থেমে বৃষ্টির সঙ্গে গরম কিন্তু কমেনি। এই বৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রা চলতি বছর ডেঙ্গুর বিস্তারে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদেরা। তবে সংক্রমণ কমাতে সিভিল সার্জন কার্যালয় ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

নগরের ২৫টি এলাকাকে ডেঙ্গু ও ২৫টি এলাকাকে চিকুনগুনিয়ার জন্য হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। এর মধ্যে বন্দর, ইপিজেড, হালিশহর, কোতোয়ালি, বায়েজিদ, পাহাড়তলী, কাট্টলী, খুলশী, ডবলমুরিং, লালখান বাজার, আগ্রাবাদ, চান্দগাঁও, দেওয়ানহাট, আন্দরকিল্লা, মুরাদপুর, সদরঘাট—এসব এলাকায় ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এসব এলাকায় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।

সিটি করপোরেশনের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সরফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বিশেষ দল করা হয়েছে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার জন্য। নিয়ম করে এলাকা ভাগ করে রুটিন অনুযায়ী ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।’

চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত বৃষ্টি হওয়ার ২৮ দিন পর্যন্ত মশার প্রকোপ থাকে বলে ধারণা করা হয়। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এ মাসে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। এতে ডেঙ্গু বাড়তে পারে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ